কেয়া কসমেটিকস : একটি জনপ্রিয় ব্র্যান্ড যেভাবে বাজার হারিয়েছে

মো. খশরু আহসান
প্রকাশ: ১৭ আগস্ট ২০২৫, ১৭:০৯

বাংলাদেশে কসমেটিকসের বাজারে এমন কিছু ব্র্যান্ডের নাম আছে, যেগুলো শুধু একটি ব্র্যান্ড নয়, বরং একটি প্রজন্মের স্মৃতি, আবেগ এবং আস্থার প্রতীক। কিন্তু প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ‘নতুনত্ব বা উদ্ভাবন’ ছাড়া দীর্ঘ সময় টিকে থাকার কোনো পথ নেই। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো কেয়া গ্রুপ।
একটি পণ্যকে পছন্দ করে ক্রয় করার ক্ষেত্রে কাস্টমার দুই-তিন সেকেন্ড সময় নেয়। ক্রেতার এই সিদ্ধান্তের অনেকাংশই নির্ভর করে পণ্যের প্যাকেজিংয়ের উপর। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্ট্র্যাটেজিক মার্কেটিং প্রজেক্টের সময় ডিক্লাইনিং ফেজে থাকা কেয়া কসমেটিকস নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে দেখা গেছে, কেয়া কসমেটিকস বা টয়লেটারিজ পণ্যের প্যাকেজিং বর্তমান বাজারে অন্যান্য প্রতিযোগীদের তুলনায় বেশ পিছিয়ে রয়েছে।
নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে যারা বড় হয়েছেন, তাদের কাছে ‘কেয়া কসমেটিকস’ একটি স্মৃতি। কিন্তু উদ্ভাবন বা নতুনত্বের ক্ষেত্রে কেয়া উদাসীন ছিল, যার প্রমাণ তাদের বর্তমান অবস্থান। ফলে বাজারে এক ধরনের গ্যাপ তৈরি হয়েছে। শেষ কবে আপনি কেয়া কসমেটিকসের কোনো বিজ্ঞাপন দেখেছেন, তা মনে করতে হলে যথেষ্ট চেষ্টা করতে হবে। যে নামটি একসময় গুণগত মান, আভিজাত্য এবং মধ্যবিত্তের সৌন্দর্যের আকাঙ্ক্ষার প্রতিশব্দ ছিল, এখন সেই নামটি বাজারে টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেয়া নতুনত্ব থেকে দূরে সরে যাওয়ায়, অন্য ব্র্যান্ডগুলো সুযোগ করে নিয়েছে।
ইতোমধ্যে কারখানা বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে কেয়া কসমেটিকস, যা একটি করুণ সমাপ্তি। এটি আমাদের দেশের শিল্পে নতুনত্বের অভাব, রিসার্চ ও ডেভেলপমেন্টে উদাসীনতা এবং কৌশলগত ব্যর্থতার সাক্ষ্য বহন করছে। আমরা ছোট্ট করে নোকিয়ার কথাও উল্লেখ করতে পারি। নোকিয়া বাজার হারানোর প্রধান কারণ ছিল উদ্ভাবনী চিন্তার প্রতি অবহেলা।
সাফল্যের সোনালী অধ্যায়
১৯৯৬ সালে শিল্পপতি আবদুল খালেক পাঠানের হাত ধরে কেয়া কসমেটিকস লিমিটেডের যাত্রা শুরু হয়। বিদেশি পণ্যের ভিড়ে একটি দেশীয় ব্র্যান্ড হিসেবে কেয়া এগিয়ে আসে। অল্প সময়ে ‘কেয়া সুপার বিউটি সোপ’, ‘কেয়া লেমন সোপ’, ‘লাইফগার্ড সোপ’ এবং ‘কেয়া অ্যাকটিভ টুথপেস্ট’ সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে ওঠে। গ্রীষ্মের দাবদাহে ‘কেয়া প্রিকলি হিট পাউডার’ বা ‘আইস ম্যাজিক পাউডার’ মধ্যবিত্তের পরম স্বস্তির নাম হিসেবে পরিচিত হয়।
আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন ও সৃজনশীল ব্র্যান্ডিং
কেয়া কসমেটিকসের জনপ্রিয়তার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে তাদের আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন। তারা সামাজিক এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটকে কাজে লাগিয়ে টেলিভিশন বিজ্ঞাপন তৈরি করত, যা আধুনিক, রুচিশীল এবং আকর্ষণীয় ছিল।
‘রূপের রানী, গুণের রানী, কেয়া সুপার বিউটি সোপের রানী’– এই বিজ্ঞাপন তখন মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত ছিল। বিজ্ঞাপন কেবল পণ্যের প্রচার করত না, বরং মধ্যবিত্তকে একটি সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখাত। এই ধরনের সফল ব্র্যান্ডিং-এর কারণে কেয়া শুধুমাত্র একটি পণ্য নয়, সাংস্কৃতিক প্রতীক হিসেবেও পরিচিত হয়েছিল।
তবে সমস্যা হলো, কেয়া তখন থেকে নতুনত্বের দিকে অগ্রসর হয়নি। একই ধাঁচের বিজ্ঞাপন ও প্যাকেজিং নিয়েই তারা সীমাবদ্ধ ছিল। মার্কেটিং ভাষায় এটিকে ‘স্পেকটিক্স মডেল’ বলা হয়।
একটি জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের বাজার হারানোর কারণ
কেয়ার পতনের পেছনে একক কারণ ছিল না; এটি একাধিক ভুলের সমষ্টি। প্রধান কারণগুলো হলো—
১. সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে ব্যর্থতা : কেয়া তাদের পুরোনো জনপ্রিয় পণ্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। নতুন প্রজন্মের ভোক্তাদের জন্য উদ্ভাবনী পণ্য আনতে ব্যর্থ হয়। বিশ্বজুড়ে লিকুইড সোপ, ফেসওয়াশ, ময়েশ্চারাইজার, সানস্ক্রিন বা শ্যাম্পুর চাহিদা বাড়লেও কেয়া সীমিত পণ্য তালিকাতেই আটকে ছিল।
২. বহুজাতিক কোম্পানির আগ্রাসন : ইউনিলিভার, প্রোক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল, ম্যারিকোসহ বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের বাজারে আধুনিক বিপণন কৌশল ও বিশাল বিনিয়োগ নিয়ে প্রবেশ করে। গবেষণা ও উন্নয়নে তাদের ক্ষমতার সামনে দেশীয় কোম্পানিগুলোর টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে।
৩. বিপণন কৌশলে স্থবিরতা : যে বিজ্ঞাপন কেয়াকে শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছিল, সেই একই ধারায় তারা বহু বছর আটকে থাকে। ডিজিটাল যুগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার না করায় নতুন প্রজন্মের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি হয়নি। ফলে ব্র্যান্ড ইমেজ ‘পুরোনো দিনের ব্র্যান্ড’ হিসেবেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।
৪. অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা ও আর্থিক সংকট : অভ্যন্তরীণ অব্যবস্থাপনা, ব্যাংক ঋণ এবং আর্থিক খাতের বিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠানটিকে দুর্বল করে। ব্যাংক ঋণখেলাপির খবর প্রকাশিত হলে ভোক্তাদের আস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে পণ্যের গবেষণা, উন্নয়ন বা বিজ্ঞাপনে বিনিয়োগের সক্ষমতা হারানো হয়।
দীর্ঘ এক যুগের আভিজাত্যের অবসান
দীর্ঘদিন লোকসান ভোগ করা কেয়া কসমেটিকস অবশেষে তাদের কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। এটি শুধুমাত্র একটি কোম্পানির বন্ধ নয়, বরং কয়েক হাজার শ্রমিকের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায় ফেলে। এটি আমাদের শেখায়, সময়ের সঙ্গে ক্রেতার চাহিদা, পছন্দ-অপছন্দ এবং আচরণ পরিবর্তিত হয়। কোনো ব্র্যান্ড যদি তা হালকাভাবে নেয়, দীর্ঘস্থায়ী ব্যবসা করা অসম্ভব।
মো. খশরু আহসান : শিক্ষার্থী, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ এবং এক্সিলেন্স বাংলাদেশের ব্র্যান্ড ও মার্কেটিং বিভাগের ডেপুটি লিড
এমএইচএস