
আমাদের জীবনে প্রতিদিন ছোট-বড় নানা খরচ হয়। কখনো তা অপরিহার্য, কখনো তা বিলাসিতা। আশ্চর্যের বিষয় হলো, আমরা বড় খরচের সময় একটুও সংকোচ বোধ করি না, কিন্তু ক্ষুদ্র কোনো ব্যয়ের ক্ষেত্রে আমাদের মনে হয় যেন অযথা ক্ষতি হয়ে গেল। এই বিপরীত মনোভাব আসলে আমাদের সামাজিক মানসিকতার প্রতিচ্ছবি।
বেশ কিছুদিন আগে, একটি ঘটনার সাক্ষী হয়েছিলাম। একজন স্বচ্ছল ভদ্রলোক ১,২৫,০০০ টাকা দিয়ে নতুন একটি রেফ্রিজারেটর কিনলেন। কেনাকাটার সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হলো। ক্যাশ ভাউচার, ওয়ারেন্টি কার্ড এবং সার্ভিস সম্পর্কিত তথ্য তিনি সেলস এক্সিকিউটিভের কাছ থেকে জেনে নিলেন। সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু পরিবহনের সময় সমস্যা দেখা দিল। রেফ্রিজারেটরটি বাসায় নিয়ে যেতে একটি ভ্যান ডাকা হলো। ভ্যানচালক পরিবহনের জন্য ৪০০ টাকা দাবি করলেন, কারণ ফ্রিজটি তিনতলায় উঠাতে হবে।
কিন্তু সদ্য ফ্রিজ কিনে ফেলা ভদ্রলোক জোর দিয়ে বললেন, তিনি কোনোভাবেই ২০০ টাকার বেশি দেবেন না। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, যিনি সহজেই এক লাখের বেশি টাকা ব্যয় করলেন, তিনি মাত্র ২০০ টাকা বাড়তি দিতে গিয়ে তর্ক শুরু করলেন। এই দৃশ্যটি শুধু এক ব্যক্তির নয় বরং আমাদের অনেকের মানসিকতাই এমন। বড় খরচের সময় আমরা অবলীলায় হাত খুলে দিই, অথচ খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে সামান্য বাড়তি দিতে গেলেই মনে করি আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।
আমরা প্রায়ই সুপারশপে গিয়ে ৫ হাজার টাকার বাজার করি কোনো দরদাম ছাড়াই। কারণ সেখানে দরদামের সুযোগ নেই। কিন্তু সেই বাজার নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে রিকশাওয়ালাকে ২০ টাকার জায়গায় ৩০ টাকা ভাড়া দিলে মনে হয় আমাদের অপচয় হলো। অথচ সত্যিটা ভিন্ন, ২০ টাকা বা ৫০ টাকা আমাদের আর্থিকভাবে কোনো ক্ষতি করে না, বরং সেই সামান্য বাড়তি অর্থ শ্রমজীবী মানুষের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। আমাদের কাছে যে টাকাটা তেমন বড় কিছু নয়, সেটাই তাদের কাছে অমূল্য।
ভাবুন তো, একজন রিকশাওয়ালা যদি দিনে ১০ জন যাত্রী থেকে গড়ে ৫ টাকা করে বাড়তি পান, তবে তাঁর হাতে অতিরিক্ত ৫০ টাকা আসবে। মাস শেষে সেটি দাঁড়াবে প্রায় ১৫০০ টাকা। এ অর্থ হয়তো তার মাসিক বাজারের একটি অংশ পূরণ করতে সাহায্য করবে।
আমরা যদি সামান্য সহানুভূতিশীল হই, তবে তাদের জীবনে একফোঁটা হলেও স্বস্তি আনতে পারব। এই সামান্য অতিরিক্ত খরচ সমাজে বৈষম্য কমানোর সহজতম উপায়গুলোর একটি হতে পারে।
অনেকে মনে করেন, বাড়তি টাকা দিলে নিজের আর্থিক ক্ষতি হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ২০/৫০ টাকা বা ১০০ টাকা বেশি খরচ করলে আমাদের আর্থিক সক্ষমতায় কোনো পরিবর্তন হয় না। আমাদের আয়-ব্যয়ের হিসাবের বড় অংকে এ সামান্য বাড়তি ব্যয় খুবই তুচ্ছ। বরং এর মাধ্যমে আমরা যে মানসিক প্রশান্তি পাই, সেটি অনেক মূল্যবান।
মানুষ কেবল নিজের ভোগের জন্য নয়, একে অপরকে সাহায্য করার জন্যও বেঁচে থাকে। সামর্থ্যবান মানুষের দায়িত্ব হলো অসামর্থ্যবানকে সহায়তা করা। আমরা যদি প্রতিদিনের ছোট ছোট কাজে এই নৈতিকতা মেনে চলি, তাহলে সমাজ আরও সুন্দর হবে। দরিদ্র মানুষের কষ্ট লাঘবের জন্য সবসময় বড় উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু প্রতিদিনের জীবনে আমরা ছোট্ট কিছু বাড়তি দিলেই বড় পরিবর্তন আনতে পারি।
আমাদের মনের ভেতরে থাকা ‘লস হয়ে গেল’ ভাবনাটা বদলাতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, অতিরিক্ত সামান্য খরচ আমাদের আর্থিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন আনে না, বরং অন্যের জীবনে আনন্দ ও স্বস্তি আনে। আমাদের সমাজে দারিদ্র্য, বৈষম্য ও কষ্ট কমানোর সবচেয়ে সহজ উপায়গুলোর একটি হলো সামান্য সহমর্মিতা দেখানো। আমরা যদি প্রতিদিনের খরচে সামান্য ২০/৫০ টাকা বেশি দিতে রাজি হই, তাহলে অসংখ্য খেটে খাওয়া মানুষের জীবন কিছুটা হলেও সহজ হবে। এ মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি যদি আমাদের সবার জীবনে প্রবেশ করে, তবে সমাজ আরও সহানুভূতিশীল, সুন্দর ও মানবিক হয়ে উঠবে।
লেখক : যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।