Logo

ফিচার

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ডায়েরি

Icon

নয়ন কুমার বর্মন

প্রকাশ: ২৪ অক্টোবর ২০২৫, ১২:৩৫

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ডায়েরি

জুলাই বিপ্লব আমার দেখা সবচেয়ে বড় ছাত্র আন্দোলন। যে আন্দোলন কোটা সংস্কার থেকে শুরু হলেও ৫ আগস্ট এক ফ্যাসিস্ট শাসকের পতন ঘটায়। কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রায় সমস্ত ঘটনাই চোখের সামনে ঘটতে দেখেছি। সেসময় আমি দৈনিক মানবকণ্ঠে সাংবাদিকতা করতাম। যার কারণে সংবাদ সংগ্রহের জন্য প্রতিদিনই আন্দোলনে যেতাম। টিয়ারগ্যাস, সাউন্ডগ্রেনেড এবং পুলিশের লাঠিচার্জে দুবার আহতও হয়েছি।

আন্দোলনের সূচনা : ৫ জুন–৬ জুলাই
আন্দোলনের শুরুটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে হলেও ধীরে ধীরে কোটা সংস্কার আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। আন্দোলনের সূচনাপ্রকাশ ঘটে ২০২৪ সালের ৫ জুন হাইকোর্টের দেওয়া একটি রায় থেকে। রায়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরির কোটাব্যবস্থা বাতিল করে যে পরিপত্র জারি করা হয়েছিল তা অবৈধ ঘোষণা করে।

এই রায়ের পরপরই সেদিন সন্ধ্যায় শিক্ষার্থীরা কোটা পুনর্বহাল না করে মেধাভিত্তিক নিয়োগ দিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ মিছিল করে। পরবর্তীতে ৯ জুন রাষ্ট্রপক্ষ হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে আবেদন করলে ১০ জুন আন্দোলনকারীরা দাবিটি মেনে সরকারকে ৩০ জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয় এবং ঈদুল আযহার কারণে আন্দোলনে বিরতি ঘোষণা করে।

জুলাইয়ের শুরু থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলন দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। পহেলা জুলাই সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহাল না করার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করে ও তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করে। মূলত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে পহেলা জুলাই থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলন বেগবান হয়।

এরপর ২ থেকে ৬ জুলাই দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ, মানববন্ধন, মহাসড়ক অবরোধ ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করে। কর্মসূচি শেষে শাহবাগে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি ঘোষণা করেন আন্দোলনকারীরা।

বাংলা ব্লকেড : ৭–৯ জুলাই
রবিবার (৭ জুলাই) বিকেল ৩টা থেকে বাংলা ব্লকেডের আওতায় শাহবাগ মোড়সহ সারা দেশের গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়ক অবরোধ করে আন্দোলনকারীরা। ৮ ও ৯ জুলাইও সারাদেশে একই রকম কর্মসূচি পালিত হয়। এসময় আন্দোলনকারীরা ‘মেধা না কোটা, মেধা মেধা’, ‘সারা বাংলায় খবর দে, কোটা প্রথার কবর দে’, ‘জেগেছে রে জেগেছে, ছাত্র সমাজ জেগেছে’, ‘সংগ্রাম না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ’সহ বিভিন্ন স্লোগান দেন।

রায় স্থগিত, রেল ও সড়কপথ অবরোধ, শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশি হামলা, রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি প্রদান এবং গণভবনে শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলন : ১০–১৪ জুলাই
১০ জুলাই ঢাবির শিক্ষার্থীরা শাহবাগ মোড় অবরোধ করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা শিক্ষার্থীদের সামনে ব্যারিকেড দিয়ে অবস্থান নেন। এদিকে দুপুর ১২টায় হাইকোর্টের রায়ে কোটাব্যবস্থা বাতিল করে চার সপ্তাহের স্থিতাবস্থা দেন আপিল বিভাগ। শিক্ষার্থীরা এই রায় মেনে নেননি এবং কর্মসূচি চালিয়ে যান। ফলে ঢাকাসহ দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

১১ জুলাই বিকেল ৩টায় শাহবাগ অবরোধের কথা থাকলেও বৃষ্টির কারণে শিক্ষার্থীরা পুলিশের বাধা অতিক্রম করে বিকেল ৪:৩০টায় অবরোধ শুরু করে। এছাড়া কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ হামলা চালায়। শাহবাগে রাত ৯টায় আন্দোলন শেষ হওয়ার পর পুলিশি হামলার প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা ১২ জুলাই বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশের ঘোষণা দেয়।

১২ জুলাই বিকেল ৫টায় শিক্ষার্থীরা প্রশাসনের সতর্কবাণী উপেক্ষা করে শাহবাগে জড়ো হয়ে অবরোধ করে। এছাড়াও সারাদেশে ছাত্রসমাজ বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে। ১৩ জুলাই রাজশাহীতে রেলপথ অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করে। সন্ধ্যায় ঢাবিতে শিক্ষার্থীরা সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘মামলা দিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।’

১৪ জুলাই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ঢাকায় গণপদযাত্রা করে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করে। চীন থেকে দেশে ফিরে গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে?’ সাবেক প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য ঘিরে রাত থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস উত্তপ্ত ছিল। এ ঘটনায় পরদিন কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা এবং ছাত্রলীগ রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ঘোষণা করে।

আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা : ১৫ জুলাই
পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ঘিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সকাল থেকেই উত্তেজনা বিরাজ করছিল। কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা দুপুর সাড়ে ১২টার পর রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে জড়ো হতে থাকেন। তাদের এক দফা দাবির মধ্যে ছিল প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবিও। এখানে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কয়েকশ শিক্ষার্থী সমবেত হয়।

ছাত্রলীগ বিকেল ৩টায় সমাবেশের ঘোষণা দিলেও আন্দোলনকারীরা ওই জায়গা দখল করে রাখায় তাদের নেতাকর্মীরা মধুর ক্যান্টিনে জড়ো হন। প্রায় দুই ঘণ্টা রাজু ভাস্কর্যের সামনে সমাবেশের পর আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের একাংশ দুপুর সোয়া দুইটার দিকে ছেলেদের হলের দিকে অগ্রসর হয়। বিভিন্ন হলে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে যেতে বাধা ও আটকে রাখার খবর পেয়ে তারা সেখানে অগ্রসর হয়।

দুপুর পৌনে তিনটার দিকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে বিজয় একাত্তর হলের ভিতর থেকে ইট-পাটকেল ছুড়ে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা আক্রমণ চালায়। তখন হলগুলোর সামনে থেকে আন্দোলনকারীরা মলচত্বরে পিছিয়ে আসে। রাজু ভাস্কর্যে থাকা আন্দোলনকারীরা মলচত্বরে এসে গাছের ডাল ভেঙ্গে হাতে নিয়ে বিজয় একাত্তর হলের সামনে গিয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের লক্ষ্য করে পাল্টা ইট-পাটকেল ছুঁড়ে। এসময় বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী আহত হয়।

বিকেল ধানমন্ডিতে এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘গতরাতে যারা নিজেদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ মানসিকতার প্রকাশ ঘটিয়েছে, তার জবাব ছাত্রলীগ দেবে।’ মূলত তার এই বক্তব্যের পরপরই শিক্ষার্থীদের ওপর জোড়ালো হামলা চালানো হয়।

বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে হলের ভিতরে আগে থেকেই প্রস্তুতি নেয়া ছাত্রলীগ কর্মীরা হাতে রড, লাঠি-সোঠা নিয়ে শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দেয়। আন্দোলনকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে বিভিন্ন দিকে ছুটে যায়। শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নিলে সেখানেও তাদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।

ভিসির বাসভবনের সামনে ছাত্রলীগের ধাওয়া খেয়ে আন্দোলনকারীরা বিভিন্ন দিকে দৌড়াতে থাকে। অনেক শিক্ষার্থী প্রশাসনিক ভবন, কলাভবন, লেকচার থিয়েটারসহ বিভিন্ন স্থানে আটকে পড়েন। সংঘাত প্রায় ঘণ্টাব্যাপী চলে। এছাড়াও সন্ধ্যাপর্যন্ত পুরো ক্যাম্পাসে বিচ্ছিন্নভাবে সংঘর্ষ চলে।

ছাত্রলীগের হামলায় আহত কয়েকশ শিক্ষার্থী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য যায়। বিকেল ৫টার পর হাসপাতালে ভেতরেও কয়েক দফা আহত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। রাতেও ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হল ও সংলগ্ন এলাকায় থেমে থেমে সংঘর্ষ হয়েছে। এছাড়াও ঢাকা মেডিকেল কলেজ, শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট এলাকায়ও সংঘর্ষ হয়েছে। দুই পক্ষই প্রতিপক্ষকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করতে দেখা গেছে। সন্ধ্যার দিকে সেখানে বিস্ফোরণের শব্দও পাওয়া গেছে। শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছেন, তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছে এবং ককটেলও নিক্ষেপ করা হয়েছে।

এদিকে রাতে ঢাবি ক্যাম্পাসে এক সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ছাত্রলীগের হামলায় এখন পর্যন্ত দুইশ’রও বেশি শিক্ষার্থী আহত হয়েছে এবং এই হামলার প্রতিবাদে মঙ্গলবার সারাদেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। অন্যদিকে ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন দাবি করেন, তাদেরও শতাধিক নেতাকর্মী আহত হয়েছে।

দফায় দফায় সংঘর্ষের পর আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। সোমবার রাতে জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা বিরোধী আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ।

ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে সারাদেশে বিক্ষোভ, আন্দোলনের প্রথম শহীদ আবু সাঈদসহ সারাদেশে নিহত ছয় : ১৬ জুলাই
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে ১৬ জুলাই সারাদেশে বিক্ষোভ চলছিল। কর্মসূচি চলাকালে ছাত্রলীগ ও পুলিশ একজোট হয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায়। এদিন সকাল থেকেই ঢাকাসহ সারা দেশে শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে। এতে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রামসহ দেশের প্রধান সড়কগুলো অচল হয়ে পড়ে। অন্যদিকে রাজধানীর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সড়কে অবস্থান নেয়ায় ঢাকার বিভিন্ন সড়কেও যান চলাচল বন্ধ ছিল।

পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী টিএসসির রাজু ভাস্করের সামনে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অবস্থান নেয় ছাত্রলীগ। অপরদিকে শহীদ মিনারের সামনে অবস্থান নেয় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা। তাদের হাতেও লাঠি-সোটা ছিল। এদিন সকাল থেকেই ঢাবি ক্যাম্পাসসহ আশপাশের অনেক এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিল।

সকাল থেকেই ঢাকা, রংপুর, চট্টগ্রাম, টাঙ্গাইল, রাজশাহী, কুমিল্লা, বগুড়া, ময়মনসিংহ, খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া, বরিশাল, সিলেটসহ বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ-যুবলীগ ও পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এসব ঘটনায় ছয়জন নিহত এবং শত শত শিক্ষার্থী আহত হন।

নিহতদের মধ্যে প্রথমে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের মৃত্যুর খবর আসে। এরপর চট্টগ্রামে ছাত্রলীগের হামলায় তিনজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। ওই দিন বিকেলে রাজধানীর সায়েন্সল্যাব মোড়ে ছাত্রলীগের হামলায় আরও দুজনের মৃত্যুর খবর আসে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দেশজুড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। পাশাপাশি ঢাকা, চট্টগ্রাম, বগুড়া, রাজশাহী ও রংপুরে বিজিবি মোতায়েন করা হয়।

দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষের কারণে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এদিন রাতে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) দেশের সকল সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের নির্দেশনা জারি করে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে আবাসিক হলগুলো খালি করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয়।

গায়েবানা জানাজা ও কফিন মিছিল : ১৭ জুলাই
১৭ জুলাই সকাল ১০টা, রাজু ভাস্কর্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো ক্যাম্পাস শুনশান, চারিদিকে শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিচরণ। সকাল ১০টার কিছু পর রাজুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী আসলে তাদের আটক করে এবং তিনটি সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে পুলিশ। এতে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক আহত হয়। এদিন সকাল থেকেই ঢাবি ক্যাম্পাসে অনেক শিক্ষার্থী হল ছেড়ে যেতে দেখা যায়। সরকারের নির্দেশে সব ধরনের ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয় মোবাইল অপারেটরগুলোতে।

আগের দিন পুলিশ ও ছাত্রলীগের হামলায় নিহত শিক্ষার্থীদের জন্য ২টার দিকে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ‘গায়েবানা জানাজা ও কফিন মিছিল’ করার কথা থাকলেও পুলিশের বাধায় সেখানে যেতে পারেনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারীরা। অপরদিকে সেসময় শাহবাগে চলছিলো মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের বিক্ষোভ সমাবেশ, সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও উপস্থিত ছিলেন।

পরে রাজুতে যেতে না পেরে বাধ্য হয়ে আন্দোলনকারীরা উপাচার্যের বাসভবনের সামনে গায়েবানা জানাজা পালন করে। জানাজা শেষে কফিন মিছিল নিয়ে রাজু ভাস্কর্যের দিকে অগ্রসর হলে পুলিশ সামনে থেকে সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করতে থাকে। সামনে পুলিশ এবং পিছনে বিজিবির হামলায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বিচ্ছিন্ন হয়ে এদিক-ওদিক ছুটতে থাকে।

এরপর পুলিশ সদস্যরা উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নিলে শিক্ষার্থীরা মাস্টারদা সূর্য সেন হলের সামনে অবস্থান নেয়। পুলিশের সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করলে শিক্ষার্থীরা তার জবাবে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। এসময় সাংবাদিকসহ শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়।

অপরদিকে সন্ধ্যায় যাত্রাবাড়িতে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ আক্রমণ চালায়, এতে বেশ কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়। এরপর আন্দোলনকারীরা মেয়র হানিফ উড়ালসড়কের কাজলা অংশের টোল প্লাজায় আগুন ধরিয়ে দেয় এবং মধ্যরাত পর্যন্ত শনির আখড়া ও কাজলার মধ্যবর্তী স্থানে অন্তত ২০টি জায়গায় আগুন জ্বলতে থাকে। রাত ৮টার দিকে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীরা ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার সারা দেশে সর্বাত্মক অবরোধ (কমপ্লিট শাটডাউন) কর্মসূচি ঘোষণা করে।

কমপ্লিট শাটডাউন এবং ৮ দফা দাবি : ১৮-১৯ জুলাই
কমপ্লিট শাটডাউনকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ১৮ জুলাই সকাল থেকেই ঢাকাসহ সারাদেশে ২২৯ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ। সকাল ১১টার দিকে মিরপুর-১০-এ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর আক্রমণ করে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ এবং ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এসময় পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। এতে মিরপুর-১০ রণক্ষেত্রের রূপ নেয়।

অপরদিকে বাড্ডায় একই সময়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে পুলিশ। এরপর দুপুর ২টায় উত্তরায় পুলিশের গুলিতে নর্দান ইউনিভার্সিটির দুই শিক্ষার্থী নিহত ও শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়। এদিন বিকেলে রামপুরায় বিটিভি, বনানীর সেতু ভবন এবং মহাখালীতে দুর্যৃত্তরা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবনে আগুন দেয়।

সর্বাত্মক অবরোধের দ্বিতীয় দিনে, ১৯ জুলাই শুক্রবার, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত রাজধানীতে সব ধরনের সভা-সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ। সেদিন বেলা ৩টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিএনপি এবং বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশ ছিল। এদিন থেকে ঢাকার সাথে সারাদেশের ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেয় সরকার।

বিকেল ৫টার দিকে নরসিংদীতে ঘটে নজিরবিহীন ঘটনা। কয়েক হাজার দুর্যৃত্ত নরসিংদী কারাগারে হামলা, ভাংচুর ও লুটপাটের পর আগুন লাগিয়ে দেয়। এসময় কারারক্ষীদের মারধরের পর অর্ধশতাধিক অস্ত্র ও গুলি লুটে নেয় দুর্যৃত্তরা। এই সুযোগে কারাগার থেকে কয়েকশ কয়েদি পালিয়ে যায়।

সারাদেশে কারফিউ জারি ও সেনা মোতায়েন করে সরকার। শুক্রবার মধ্যরাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম এবং গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরকে আটক করা হয়। নাহিদ ইসলামকে আটক করার কাছাকাছি সময়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন প্রতিনিধির সঙ্গে সরকারের তিনজন প্রতিনিধির একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে তারা সরকারের কাছে ‘আট দফা দাবি’ জানান। বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় সংবাদপত্র অনুযায়ী, ১৯ জুলাই শুক্রবার সারাদেশে কমপক্ষে ৫৬-৬৬ জনের মৃত্যু হয়।

কারফিউ, সাধারণ ছুটি সংলাপ এবং সুপ্রিম কোর্টের রায়, কমপ্লিট শাটডাউন স্থগিত : ২০-২২ জুলাই
২০ জুলাই তৃতীয় দিনের মতো সারাদেশ ইন্টারনেটবিহীন ছিল। কারফিউর অংশ হিসেবে সেনাবাহিনীকে দেশের বিভিন্ন অংশে টহল দিতে দেখা যায়। কারফিউর মধ্যেই ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। দেশব্যাপী সহিংসতা বড় আকার ধারণ করলে ২০ জুলাই শনিবার নির্বাহী আদেশে রবিবার ও সোমবার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

২১ জুলাই ভোরে ঢাকার পূর্বাচল এলাকায় আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে পাওয়া যায়। ১৬ জুলাই রাষ্ট্রপক্ষের করা লিভ টু আপিলের প্রেক্ষিতে সকাল ১০টার দিকে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে কোটা নিয়ে আপিল বিভাগের শুনানি শুরু হয়। সব পক্ষের শুনানি শেষে দুপুর ১টার দিকে রায় ঘোষণা করা হয়। রায়ে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বাতিল করা হয় ও সরকারি চাকরিতে মেধার ভিত্তিতে ৯৩ শতাংশ নিয়োগ দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করা হয়। বাকি পাঁচ শতাংশ থাকবে মুক্তিযোদ্ধা কোটা এবং দুই শতাংশে থাকবে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গ কোটা।

এদিন বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে র‍্যাব, পুলিশ ও বিজিবি ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি পক্ষ ‘৯ দফা’ দাবি জানিয়ে শাটডাউন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়।

২২ জুলাই পঞ্চম দিনের মতো সারাদেশে ইন্টারনেট ছিল না এবং তৃতীয় দিনের মতো কারফিউ বলবৎ ছিল। এক নির্বাহী আদেশে সাধারণ ছুটি আরও একদিন মঙ্গলবার ২৩ জুলাই পর্যন্ত বাড়ানো হয়। দুপুরে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কিছু ব্যবসায়ী বৈঠক করেন। বৈঠকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা ও সহিংসতার জন্য বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও শিবিরকে দায়ী করে ‘আরও শক্ত অ্যাকশন’ নেওয়ার কথা জানান। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম চার দফা দাবি জানিয়ে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়ে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি স্থগিত করেন।

গণগ্রেপ্তার, ডিবি হেফাজতে ছয় সমন্বয়ক, ভিডিও বার্তায় আন্দোলন স্থগিত : ২৩-২৮ জুলাই 
২৩ জুলাই ষষ্ঠ দিনের মতো সারাদেশে ইন্টারনেট ছিল না এবং চতুর্থ দিনের মতো কারফিউ বলবৎ ছিল। ২১ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ের পর ২৩ জুলাই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কোটা সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে।

২৪ জুলাই সীমিত পর্যায়ে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট চালু হয়, সঙ্গে পঞ্চম দিনের মতো শিথিল পর্যায়ে কারফিউ বলবৎ ছিল। ২৪ জুলাই পর্যন্ত বিভিন্ন মামলায় পুলিশ ১,৭৫৮ জনকে গ্রেপ্তার করে। ১৯ জুলাই থেকে নিখোঁজ থাকা সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার ও রিফাত রশীদের খোঁজ পাওয়া যায়। এদিন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেন দেশের শীর্ষস্থানীয় সাংবাদিকেরা।

২৫ জুলাই বিকেল পর্যন্ত ব্রডব্যান্ডে ধীরগতির ইন্টারনেট পাওয়া যায়। তবে সরকার ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ রাখে। আন্দোলনকারীদের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে ৮টি বার্তা দেওয়া হয়। ২৬ জুলাই নাহিদ ইসলামসহ কোটা সংস্কার আন্দোলনের তিন সমন্বয়ককে রাজধানীর গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে তুলে নিয়ে যায় সাদা পোশাকের এক দল ব্যক্তি।

২৭ জুলাই তিন সমন্বয়ককে তুলে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে ডিবি। আন্দোলন ঘিরে সারাদেশে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ভাগ করে ‘ব্লক রেইড’ দিয়ে অভিযান চালানো হয়। এদিন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ২৮ থেকে ৩০ জুলাই পর্যন্ত সকল অফিসের সময়সূচি ছয় ঘণ্টা করার সিদ্ধান্ত জানায়। রাত ৯টার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সংগঠনের আরও দুই সমন্বয়ককে হেফাজতে নেয় গোয়েন্দা শাখা।

২৮ জুলাই ভোরে মিরপুর থেকে সমন্বয়ক নুসরাতকেও ডিবি হেফাজতে নেওয়া হয়। বিকেল ৩টা থেকে মোবাইল ইন্টারনেট চালু করা হয়। সমন্বয়কদের সঙ্গে দেখা করতে পরিবারের সদস্যরা গেলেও দেখা করতে দেওয়া হয়নি। রাত ১০টার দিকে ডিবি হেফাজতে থাকা ৬ সমন্বয়ক এক ভিডিও বার্তায় আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। কিন্তু এই ঘোষণাকে সরকার ও পুলিশের চাপে দেয়া হয়েছে বলে আখ্যায়িত করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয় বাকিরা।

রাত ১১টার দিকে সমন্বয়কদের জিম্মি ও নির্যাতন করে বিবৃতি দেয়ার প্রতিবাদে পরদিন ২৯ জুলাই আবারও রাজপথে আসার ঘোষণা দেন দেশের প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকার বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা।

আন্দোলনের পুনঃসূচনা : ২৯-৩১ জুলাই
২৯ জুলাই রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি, বাড্ডা, ইসিবি সহ দেশের বেশ কয়েকটি শহরে আবারো বিক্ষোভ করার চেষ্টা করে শিক্ষার্থীরা। দশম দিনের মতো দিনের বেলায় শিথিল পর্যায়ে কারফিউ অব্যাহত থাকে। সেদিন মন্ত্রিসভার বৈঠকে কোটা আন্দোলনকে ঘিরে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে ৩০ জুলাই মঙ্গলবার দেশব্যাপী শোক পালন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এদিকে আন্দোলনকারীরা সরকারের এই কর্মসূচি প্রত্যাখ্যান করে ৩০ জুলাই লাল কাপড় মুখে ও চোখে বেঁধে ছবি তোলা এবং অনলাইনে ব্যাপক প্রচার কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেয়।

৩০ জুলাই শোক পালনকে প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলনকারীদের পাশাপাশি জনপ্রিয় ব্যক্তিবর্গ, সাধারণ নাগরিক, সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবি, এমনকি সাবেক সেনাপ্রধানও ফেসবুকে লাল প্রোফাইল ছবি যুক্ত করে আন্দোলনকে সমর্থন করে। হত্যা, গণগ্রেপ্তার, হামলা, মামলা ও গুমের প্রতিবাদে ৩১ জুলাই বুধবার সারাদেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালন করে। এদিন বিকেল ৩টায় ১৪ দিন বন্ধ থাকার পর ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম খুলে দেওয়া হয়।

সমন্বয়কদের মুক্তি, ৯ দফা দাবি ও শিল্পী সমাজের সমাবেশ : ১-২ আগস্ট
১ আগস্ট হেফাজতে থাকা ছয় সমন্বয়ককে দুপুরে ছেড়ে দেয় ডিবি। বিকেলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নির্বাহী আদেশে প্রজ্ঞাপন জারি করে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করে সরকার। সারাদেশে ছাত্র-জনতার ওপর হত্যা, গণগ্রেফতার, হামলা-মামলা, গুম-খুন ও শিক্ষকদের ওপর হামলার প্রতিবাদে এবং ৯ দফা দাবি আদায়ে বৃহস্পতিবার ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ কর্মসূচি পালন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।

২ আগস্ট মুক্তি পাওয়া ছয় সমন্বয়ক এক বিবৃতিতে বলেন, আন্দোলন প্রত্যাহার করে ডিবি অফিস থেকে প্রচারিত ভিডিও বিবৃতি তারা স্বেচ্ছায় দেননি। বিবৃতিদাতাদের ভাষ্য অনুযায়ী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশেই তাদের আটকে রাখা হয়েছিল। এদিন দুপুর ১২টার পর মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ রাখলেও ৫ ঘণ্টা পরে আবার চালু করা হয়। সকালে রাজধানীর ধানমন্ডিতে হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে অবিলম্বে সরকারের পদত্যাগসহ তিন দফা দাবিতে সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল করে শিল্পী সমাজ। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জড়ো হয়ে কোটা আন্দোলনে হতাহতের ঘটনায় বিচার দাবি করে প্রতিবাদী সমাবেশ করে চিকিৎসক, মেডিকেল ও ডেন্টাল শিক্ষার্থীরা।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হামলা ও হত্যার প্রতিবাদসহ পূর্বঘোষিত নয় দফা দাবিতে শনিবার (৩ আগস্ট) সারাদেশে বিক্ষোভ মিছিল ও রোববার (৪ আগস্ট) থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়। রাতে গণভবনে জরুরি বৈঠকে আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত একটি দলকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের সঙ্গে আলোচনা করার নির্দেশনা দেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী।

শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ, এক দফা দাবি এবং সর্বাত্মক অসহযোগ : ৩-৪ আগস্ট
৩ আগস্ট দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীরা ‘ছি ছি হাসিনা, লজ্জায় বাঁচি না’ বলে স্লোগান দিতে থাকেন। প্রধানমন্ত্রী আন্দোলনকারীদের আলোচনার প্রস্তাব দেন, তবে সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম জানান আলোচনায় বসার কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই।

দেশের সকল সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবি নিয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন শিক্ষার্থীরা। বিকেলে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা বিরাট মিছিল নিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমবেত হয়। মুহূর্তেই পুরো শহীদ মিনার চত্বর এবং আশেপাশের এলাকা ভরে উঠে লক্ষাধিক ছাত্র-জনতার উপস্থিতিতে।

বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে শহীদ মিনারে সমবেত ছাত্র-জনতার উদ্দেশে বক্তব্য দেন সমন্বয়ক মো. নাহিদ ইসলাম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার মন্ত্রিসভার পদত্যাগের একদফা দাবি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।

রাত সোয়া ৮টায় গণভবনে শেখ হাসিনা সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, শিক্ষক ও কলেজের অধ্যক্ষদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। রংপুরে কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের মৃত্যুর ঘটনায় দুই পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

৪ আগস্ট পূর্বঘোষিত অনির্দিষ্টকালের জন্য ‘সর্বাত্মক অসহযোগ’ কর্মসূচি পালন করা হয়। দেশের বিভিন্ন জায়গায় অসহযোগ আন্দোলনকে সমর্থন করে বিক্ষোভ মিছিল করে ছাত্র-জনতা।

গণঅভ্যুত্থানের আগের দিন সকালে মিরপুর-১০-এ অবস্থান নেয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ এবং ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। অপরদিকে শাহবাগ এলাকায় শিক্ষার্থীরা অবস্থান নেয়। সকাল ১১টার দিকে শাহবাগে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় ছাত্রলীগ। এক সময় ছাত্রলীগকে হটিয়ে শিক্ষার্থীরা ধাওয়া দিলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে ঢোকে এবং ভিতর থেকে ইট-পাটকেল ছুঁড়ে। এর কিছুক্ষণের মধ্যে পিজিতে আগুন লাগিয়ে দেয়। বিকেল ৩টা পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলন স্বাভাবিকভাবে চলে। পুরো শাহবাগ, টিএসসি, কাঁটাবন, সায়েন্সল্যাব, বাংলামোটর এবং পল্টন শিক্ষার্থীদের দখলে চলে আসে।

অপরদিকে মিরপুর-১০-এ থাকা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ চলে। এক পর্যায়ে সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করে নেতাকর্মীদের হটিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দাঁড়ায়। সন্ধ্যার কিছু আগে কারওয়ান বাজারে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ ছাড়া শিক্ষার্থীদের তেমন সংঘর্ষ হয়নি। এসময় বাসার ভিতর থেকে পুলিশের ছোড়া গুলিতে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী নিহত হন। শাহবাগে সন্ধ্যাপর্যন্ত তেমন কোনো সংঘর্ষ হয়নি। সন্ধ্যায় খবর আসে ৬টা থেকে কঠোর কারফিউ ঘোষণা করা হয়েছে।

ফের কারফিউ ঘোষণা দেওয়ায় নিজেদের কর্মসূচি এগিয়ে এনেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। রোববার (৪ আগস্ট) বিকেলে এক ভিডিও বার্তায় আসিফ মাহমুদ বলেন, পরিস্থিতি পর্যালোচনায় এক জরুরি সিদ্ধান্তে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ৬ আগস্ট থেকে পরিবর্তন করে ৫ আগস্ট করা হলো। অর্থাৎ আগামীকালই সারাদেশের ছাত্র-জনতাকে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করার আহ্বান জানাচ্ছি। ছাত্র-জনতায় এক নতুন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটাবে, উল্লেখ করে আসিফ জানান, চূড়ান্ত লড়াই, এই ছাত্র-নাগরিক অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত স্বাক্ষর রাখার সময় এসে গেছে। ইতিহাসের অংশ হতে ঢাকায় আসুন সকলে। যে যেভাবে পারেন ঢাকায় কালকের মধ্যে চলে আসুন।

মার্চ টু ঢাকা, এক দফা দাবি বাস্তবায়ন এবং ফ্যাসিস্ট শাসনের পতন : ৫ আগস্ট
৪ আগস্ট রাত থেকেই নীরব ছিল রাজধানী। ৫ আগস্ট ভোর ছিল উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে। সকালটা মেঘলা, রাস্তাঘাট ফাঁকা। সকাল ১০টার পর যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, শহীদ মিনার, বাড্ডা, মিরপুরসহ বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভকারীদের জমায়েতের খবর আসে। কোথাও কোথাও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষও শুরু হয়। এদিন সকালে দ্বিতীয়বারের মতো ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়। আন্দোলন ক্রমেই তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠে।

বেলা ২টায় খবর আসে, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জনগণের উদ্দেশে বক্তব্য দেবেন। তখনই মানুষ বুঝে যায়, পরিস্থিতি পরিবর্তন হচ্ছে। এর মধ্যেই ছোট বোন রেহানাকে নিয়ে তেজগাঁওয়ের পুরনো বিমানবন্দরের হেলিপ্যাডে আসেন শেখ হাসিনা। সেখানে তাদের কয়েকটি লাগেজ ওঠানো হয়। এরপর তাঁরা বঙ্গভবনে যান। সেখানে পদত্যাগের আনুষ্ঠিকতা শেষ করে বেলা আড়াইটার দিকে সামরিক হেলিকপ্টারে ছোট বোনসহ ভারতের উদ্দেশ্যে উড্ডয়ন করেন।

এরপর রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লাখ লাখ মানুষ স্লোগান দিতে দিতে গণভবন, সংসদ ভবন এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আসে। সংসদ ভবন, গণভবন এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে রীতিমতো লুটপাট চালানো হয়। বিশেষ করে গণভবন থেকে যে যা পেয়েছে, নিয়ে গেছে। অনেকে আবার কিছু না পেয়ে গণভবনের ইট পর্যন্ত খুলে নিয়ে গেছে।

প্রধানমন্ত্রী পালিয়ে যাওয়ার পর দুপুরে সেনা সদর দপ্তরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠক করেন সেনাপ্রধান। বৈঠকে ডাক পান জাতীয় পার্টির আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও মুজিবুল হক চুন্নু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও মির্জা আব্বাস। এরপর বিকেল ৪টায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। হাসিনা পালানোর মধ্য দিয়ে বাস্তবায়ন হয় এক দফা দাবি এবং ফ্যাসিস্ট শাসন ব্যবস্থার অবসান ঘটে।

রাতে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধান, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে জাতির উদ্দেশে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি জরুরি ভিত্তিতে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা জানান।

নয়ন কুমার বর্মন : সাহসী সাংবাদিক সম্মাননা-২০২৪ প্রাপ্ত সংবাদকর্মী; হেড অব মাল্টিমিডিয়া, দৈনিক যায়যায়দিন।

এমএইচএস

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

জুলাই অভ্যুত্থান

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর