প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, ‘নির্বাচন কমিশন (ইসি) নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। যে সময় তারা (ইসি) নির্বাচনের শিডিউল ঘোষণা দেবে, ঠিক সে সময়েই নির্বাচন হবে। সঠিক সময় নির্বাচন হবে। সব ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে আমরা সক্ষম হব।’ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে নিজের ভাবনা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী। এবার নির্বাচনকালীন সরকারের আকার কমানো নাও হতে পারে বলেও ইঙ্গিত দেন তিনি।
গতকাল সোমবার বিকালে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে তার সম্প্রতি সৌদি আরব সফর নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংবাদকর্মীদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী সৌদি বাদশাহর আমন্ত্রণে গত ১৬ থেকে ১৯ অক্টোবর সৌদি আরবে চার দিনের সরকারি সফর করেন। সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারক, বাদশাহ সালমান ও ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে তার বৈঠকসহ সফরের বিষয় তুলে ধরেন।
এ ছাড়া জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও একে নিয়ে কোনো কোনো মহলের ‘সংশয় প্রকাশ’, ষড়যন্ত্র, সড়ক দুর্ঘটনা ও পথচারীদের ট্রাফিক আইন মানা না মানাসহ সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী তার ভাবনা তুলে ধরেন। লিখিত বক্তব্যের পর প্রায় ৪০ মিনিট প্রধানমন্ত্রী সংবাদকর্মীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। এ সময় মঞ্চে আরো ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। সংবাদ সম্মেলেন পরিচালনা করেন প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে কোনো ষড়যন্ত্র হচ্ছে কি না আর সেই ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে যথাসময়ে নির্বাচনের প্রস্তুতি সরকারের রয়েছে কি না- জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে যারা সংশয় সৃষ্টি করতে চাচ্ছেন, তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশে যেন গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা না থাকে। ধারাবাহিকতা না থাকলে কিছু লোকের সুবিধা হবে। তাই তারা নির্বাচন নিয়ে সংশয় সৃষ্টি করতে চান।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘২০১৪ সালের নির্বাচন ঠেকাতেও বহু চেষ্টা করা হয়েছে। এবারো হচ্ছে। তবে সব ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে যথাসময়ে নির্বাচন হবে। দেশে যেন আর জঙ্গিবাদ আর পেট্রোল বোমা সন্ত্রাস না হতে পারে, সেজন্য জনগণের নিরাপত্তায় যা করার দরকার তাই করা হবে। বাংলাদেশের মানুষকে কেউ জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে মারবে এমন ঘটনা প্রতিরোধে যা যা করার দরকার সবই করব। মানুষ যেন শান্তিতে বসবাস করতে পারে, নিরাপদে বসবাস করতে পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেব।’
ঐক্যফ্রন্ট ছাল-বাকলের তৈরি
নতুন গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে ‘ছাল-বাকল দিয়ে তৈরি’ জোট বলে আখ্যায়িত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে এই জোটকে তিনি স্বাগত জানিয়েছেন। শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘দেশে রাজনৈতিক স্বাধীনতা আছে। এখানে বিচার বিভাগ স্বাধীন, গণমাধ্যম স্বাধীন। যে কেউ ইচ্ছা করলে রাজনীতি করতে পারেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘খুনি, দুর্নীতিবাজ ও নারী কটূক্তিকারীদের ঐক্য হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ও দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে ঐক্য করেছেন ড. কামাল হোসেন। নতুন জোট সফল হলে অসুবিধা কোথায়? তারা রাজনৈতিকভাবে জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারলে করুক। এখানে তো অসুবিধার কিছু নেই। তাদের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে দেশবাসীকে সতর্ক থাকতে হবে।’
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ এটা নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তায় নেই। এখানে (ঐক্যফ্রন্টে) স্বাধীনতাবিরোধী আছেন, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস সৃষ্টিকারী আছেন। সব মিলিয়েই কিন্তু এটা হয়েছে। এর মধ্যে অনেকেই আওয়ামী লীগে ছিলেন। তারা এখন আওয়ামী লীগের বিরোধী হয়েছেন।’
নবগঠিত জোটের সাত দফা দাবি নিয়ে প্রশ্ন করলে শেখ হাসিনা বলেন, ‘তাদের আগে ছিল চার দফা, এখন হয়েছে সাত দফা। দেখি, তারা কতদূর যায়। তারপর সিদ্ধান্ত নেব। সাত দফা আর কত দূর যায়, তার জন্য অপেক্ষা করে আছি। তারপর আমি আমার বক্তব্য দেব।’
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সিলেট সমাবেশকে ঘিরে মানুষের মধ্যে নাশকতার শঙ্কা তৈরি হয়েছে, এ বিষয়ে মানুষকে কীভাবে আশস্ত করবেন- সংবাদ সম্মেলনে এক সংবাদকর্মীর প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সিলেটের মাজার থেকে নির্বাচনী প্রচারণায় নামবে এটা খুবই ভালো কথা, তারা নির্বাচনে আসছে।’
আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, ‘নির্বাচনের প্রস্তুতিতে সরকারের কোনো ভূমিকা নেই। নির্বাচন কমিশন (ইসি) স্বাধীন। তারা প্রস্তুতি নিচ্ছে স্বাধীনভাবে। আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র কম হয়নি। প্রতিনিয়তই ষড়যন্ত্র হচ্ছে, ষড়যন্ত্র থাকবে, ষড়যন্ত্র চলবেই। ষড়যন্ত্র বাংলাদেশের চিরাচরিত বিষয়। এ সবকিছু মোকাবেলা করেই আমরা এগিয়ে যেতে পারছি। এর মধ্য দিয়েই বাংলাদেশকে আর্থসামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। তার কারণ জনগণই আমাদের শক্তি। জনগণের ওপর আস্থা ও বিশ্বাস আমার আছে।’
নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রিসভার আকার কেমন হবে- এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অনেক প্রকল্প চলমান থাকায় রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলাপ করেই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে মন্ত্রিসভার আকার ছোট হলে উন্নয়ন কাজ ব্যাহত হতে পারে। মন্ত্রিসভা ছোট করা হলে একজনকে কয়েকটা মন্ত্রণালয় চালাতে হবে। সেক্ষেত্রে কোনো কোনো উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ দুই তিন মাসের জন্য থমকে যেতে পারে। এ বিষয়গুলোও ভাবতে হবে। তাছাড়া বর্তমান সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সব দলের মন্ত্রী আছে।’
তিনি বলেন, ‘যুক্তরাজ্যের মতো যেসব দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র আছে, কোথাও নির্বাচনের সময় মন্ত্রিসভায় পরিবর্তন আনা হয় না।’ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে মন্ত্রিসভা কেন পুনর্গঠন করা হয়েছিল, সে বিষয়টি ব্যাখ্যা করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘সে সময় বিরোধী দলে থাকা বিএনপি নির্বাচনে আসতে রাজি হচ্ছিল না বলে তখন তাদের নির্বাচনকালীন সরকারে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।
আগামী নির্বাচনের অঙ্গীকার কী- জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছে। দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ দেখতে চাই। আমার লক্ষ্য, উন্নয়নের গতিধারা অব্যাহত রাখা। ২০৪১ সালের মধ্যে বিশ্বের রোল মডেল হিসেবে গড়ে তুলতে চাই।’
তিনি বলেন, ‘২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ যে নির্বাচনী অঙ্গীকার করেছিল, সরকার তার চেয়ে বেশি কাজ করেছে। আরো বেশি অর্জিত হয়েছে।’ আবার ক্ষমতায় এলে অসমাপ্ত কাজ শেষ করে বাংলাদেশকে আরো উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার আশার কথাও এ সময় জানান প্রধানমন্ত্রী।
নির্বাচনকে সামনে রেখে কূটনীতিক তৎপরতা বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে সরকারপ্রধান বলেন, ‘যাদের মাটিতে শেকড় নেই, তারাই বিদেশিদের কাছে গিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে শুধু শুধু নালিশ করে বেড়ায়। যেখানে সেখানে ছুটে বেড়ায়। দেশে এত উন্নয়ন হচ্ছে, সেগুলো তাদের চোখে পড়ে না। তারা বাংলাদেশ সম্পর্কে বিদেশিদের কাছে একটা বিরূপ চিত্র তুলে ধরছে। আমি জানি না, এভাবে তারা নালিশ কী পাচ্ছেন।’
ড. কামাল হোসেনকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘এত নীতিকথা বলেন, তিনি তো আমাদের সংবিধানের প্রণেতা। ৭২-এর সংবিধানটা তিনি প্রণয়ন করেছিলেন। সংবিধান প্রণেতা হয়ে ড. কামাল হোসেন ৭২-এর সংবিধানের কোনো কোনো অনুচ্ছেদে এখন আপত্তি জানান কেন? তার হাতে সৃষ্টি, তিনি এখন আবার আপত্তি করেন কী কারণে? এটা কি তার গণতান্ত্রিক চিন্তাভাবনার ঐতিহ্য?’
‘জামায়াতের প্রতিনিধি’ কী না জানতে চাওয়ায় সাংবাদিক মাসুদা ভাট্টিকে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের আইনি নোটিশ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ছাত্রশিবিরের অনুষ্ঠানে ব্যারিস্টার মইনুল গিয়েছিলেন, এর ভিডিও তো আছেই। জামায়াত তিনি সমর্থন করেন না, সেটা কীভাবে বলবেন? আমি তো বললাম, শিবিরের অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেছেন, তাদের আপনজন বলেছেন। এতেই প্রমাণ হয় তিনি জামায়াত, এর চেয়ে প্রমাণ আর কী লাগবে?’
সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে জনসাধারণের সচেতনতার ওপর জোর দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যারা অ্যাক্সিডেন্টের শিকার হলো তারা রাস্তার কোথায় ছিল তখন? এত দুর্ঘটনার পর পথচারীরা সচেতন হয়েছে? আমাদের তো স্বভাব পরিবর্তন হচ্ছে না, যারা রাস্তা পারাপার হচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘সাংবাদিকদের কাছে অনুরোধ করব সড়ক দুর্ঘটনার কারণগুলো খুঁজে বের করুন। ঢাকায় দুই স্কুলছাত্র নিহতের ঘটনায় বাসচালকের দোষ ছিল, সেটা স্বীকার করি। বাস তাদের ওপর উঠে যায়। কিন্তু অন্যান্য যেসব দুর্ঘটনা হচ্ছে তারা ফুটপাথে ছিল কি না? রাস্তায় ছিল কি না এগুলো দেখতে হবে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘সড়ক আইন পাস করেছি। সবকিছু করেছি। চাইলেই তো হঠাৎ করে যানবাহন বন্ধ করে দেওয়া যাবে না। যান্ত্রিক ব্যাপার, থামাতে গেলেও তো সময় লাগে। রাস্তা পার হওয়ার সময় তাড়াহুড়ো না করে উচিত সময় নিয়ে পার হওয়া। আপনারা এ বিষয়টি তুলে ধরেন।’
সৌদি সফরকালে বিনিয়োগ সংক্রান্ত দুই দেশের মধ্যে ৫টি সমঝোতা স্মারক সই হয়। সমঝোতা স্মারকগুলোর মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশে সৌদি বিনিয়োগে সিমেন্ট কারখানা, ডাই-অ্যামোনিয়াম ফসফেট করখানা, ‘সৌদি-বাংলাদেশ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’ প্রতিষ্ঠা, সৌরবিদ্যুৎ ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম উৎপাদন কারখানা স্থাপন। প্রধানমন্ত্রী তার সাম্প্রতিক সৌদি আরব সফরকে অত্যন্ত সফল আখ্যায়িত করে বলেন, ‘এ সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে সৌদি বিনিয়োগের নবধারা সূচিত হবে। আমার এ সফর দুই দেশের সম্পর্ক বৃদ্ধি বিশেষত বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষায় সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।’