ঢামেকে চিকিৎসকদের নাভিশ্বাস, রোগীদের হাহাকার
প্রকাশ: ১৩ মে ২০২৫, ১৫:১৯
-68230ea43c934.jpg)
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল দেশের বৃহত্তম চিকিৎসা কেন্দ্র। জনশ্রুতি আছে দেশের কোনো হাসপাতালে চিকিৎসা না পেলেও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা পাওয়া যাবে। এমন জনশ্রুতিতে সারাদেশ থেকে রোগীরা ছুটে আসেন এ হাসপাতালে। দুই হাজার ৬০০ শয্যার হাসপাতালটিতে গড়ে রোগী ভর্তি থাকেন প্রায় পাঁচ হাজার। চিকিৎসক ও নার্স সংকট, প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাব আর ধারণ ক্ষমতার চেয়ে দ্বিগুণ রোগী নিয়ে হাসপাতালটি ধুঁকছে।
হাসপাতালটিতে প্রতিদিন জরুরি ও বর্হিবিভাগে সেবা নিতে আসেন প্রায় তিন হাজারের বেশি রোগী। মাত্র ১০ টাকার টিকেট মূল্যে বিভিন্ন রোগের সেবা নিয়ে থাকেন রোগীরা। বর্হিবিভাগ ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি কক্ষের সামনে রোগীদের দীর্ঘ সারি। কর্তব্যরত মেডিসিন বিভাগের একজন চিকিৎসক জানালেন, দৈনিক দেড় থেকে দুই শতাধিক রোগীকে তিনি চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। কখনো কখনো এ সংখ্যা দ্বিগুণ হয়। প্রয়োজনের তুলনায় অর্ধেক চিকিৎসক নিয়ে চলছে বর্হিবিভাগ। রোগীর বাড়তি চাপ নিতে হচ্ছে চিকিৎসকদের।
হাসপাতালটির ভবন-১, ভবন-২ ও জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট ঘুরে দেখা যায়, বারান্দা থেকে ওয়ার্ড সব যায়গা রোগী দিয়ে পরিপূর্ণ। হাসপাতালটির নিউরোলজি বিভাগের বারান্দায় তোষক পেতে শুয়ে আছেন মাদারীপুর থেকে আসা আনসারুল ইসলাম। জেলা হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা না পেয়ে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসেছেন। তার বড় ছেলে আনিস জানালেন, দুই দিন ধরে তারা বারান্দায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন।ওয়ার্ডে শয্যা খালি না থাকায় তাদের বাধ্য হয়ে বারান্দায় থেকে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। সময় মতো চিকিৎসক ও নার্সদের না আসার অভিযোগ রয়েছে তাদের। এমন অবস্থা শুধুমাত্র আনসারুল ইসলামের নয়, প্রতিটি ওয়ার্ডের বারান্দায় শুয়ে আছেন কয়েকশত রোগী। বাড়তি রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা। গাইনি বিভাগের একজন অধ্যাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সময় যত যাচ্ছে হাসপাতালে রোগীর চাপ তত বেড়ে চলছে। আমাদের সক্ষমতার চেয়ে অধিক রোগী হাসপাতালে ভর্তি। চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অনেকে অভিযোগ দিয়ে থাকেন। চিকিৎসকরা আসলে অসহায়, তিনজনের কাজ এখানে একজনকে করতে হয়।
বাংলাদেশের খবরের হাতে পাওয়া তথ্য মতে, বর্তমানে হাসপাতালটিতে পরিপূর্ণ ওয়ার্ড রয়েছে ৯৫টি, অপারেশন থিয়েটার রয়েছে ৪৭টি, নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র রয়েছে ১৫০টি। হাসপাতালটিতে বর্তমানে চিকিৎসক রয়েছেন দুই হাজার ৫০০ জন। যাদের মধ্যে ইন্টার্ন চিকিৎসক দেড় হাজার। রোগীর প্রয়োজনের তুলনায় চিকিৎসক অর্ধেক যাতে বিলম্বিত হচ্ছে চিকিৎসা সেবা।
হাসপাতালটিতে শুধুমাত্র চিকিৎসকসহ অন্যান্য জনবলের সংকটই নয়; বরং এখানে রয়েছে রোগীদের পরীক্ষা নিরীক্ষা করার যন্ত্রের অচলাবস্থাও। তথ্য বলছে, হাসপাতালের তিনটি এমআরআই মেশিনের মধ্যে চালু আছে একটি। শুধু এমআরআই মেশিন নয়; ১৩টি আলট্রাসনোগ্রামের মধ্যে ছয়টি, ডায়াথার্মির ৫২টির মধ্যে অচল ২০টি, অ্যানেসথেসিয়ার ৩৭টির যন্ত্রের মধ্যে তিনটি, এনজিওগ্রামের তিনটি মেশিনের মধ্যে একটি, ৯টি এক্স-রে মেশিনের মধ্যে তিনটি, ইসিজির ১২টির মধ্যে চারটি অচল রয়েছে।
৩৪টি ওটি টেবিলের মধ্যে অচল পাঁচটি; ৩৬টি ওটি লাইটের মধ্যে দুইটি অচল; চারটি পোর্টেবল ওটি লাইটের একটি অচল। সাকার মেশিন ৬০টির মধ্যে অচল ১৫টি। অটোক্লেভ মেশিন ৩৫টির মধ্যে অচল ১৪টি। দুটি ডেন্টাল মেশিনের মধ্যে একটি ও ১২টি অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যে দুটি অচল। পরীক্ষা নিরীক্ষার এসব যন্ত্র নষ্ট থাকায় রোগীরা বাধ্য হয়ে বাইরের থেকে বাড়তি পরীক্ষা নিরীক্ষা করাচ্ছেন। এতে রোগীদের উপর পড়ছে বাড়তি চিকিৎসা ব্যয়।
হাসপাতালটির বর্তমান অবস্থা ও চিকিৎসক সংকট নিয়ে হাসপাতালটির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আসাদুজ্জামান বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ চিকিৎসার জন্য মানুষের কাছে ভরসার যায়গা। অনেক মানুষ এখানে চিকিৎসা নিতে আসেন শেষ চেষ্টা হিসাবে। আমরা কোনো রোগীকে ফিরিয়ে দিতে পারি না। আমাদের চিকিৎসকরা দিনরাত পরিশ্রম করছেন। আমাদের চিকিৎসক ও সরঞ্জামের সংকট রয়েছে। আমরা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে বিষয়টি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে জানিয়েছি।
এদিকে হাসপাতালটি ঘিরে বিগত সরকার ১০ বছর আগে একটি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। যেখানে হাসপাতালটি আধুনিকায়ন করে পাঁচ হাজার শয্যায় উন্নতি করার কথা ছিল। মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী হাসপাতালটিতে নতুন করে সাজাতে পাঁচটি ১৮ তলা ভবন, যার প্রতিটিতে এক হাজার শয্যা করার পরিকল্পনা ছিল। দুটি আউটডোর কমপ্লেক্স, আলাদা জরুরি বিভাগ, মেডিকেল কলেজ ভবনের আধুনিকায়ন, নার্সিং কলেজকে নার্সিং ইনস্টিটিউটে উন্নীত করার পরিকল্পনা ছিল সেই উদ্যোগে। ২৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটির কাজ ২০২৪ সালে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও গণআন্দোলনে বিগত সরকারের পতন হলে এ প্রকল্প এখন আর আলোর মুখ দেখেনি।
প্রকল্পটি নিয়ে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব সাইদুর রহমান বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ আধুনিকায়নকরণ প্রকল্পটি নিয়ে বর্তমানে কোনো আলোচনা হচ্ছে না। এটি একটি বৃহৎ পরিকল্পনা। সরকারের অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যেসব প্রকল্পের কাজ করছে সেখানে এ প্রকল্পটি নেই।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের চিকিৎসা সেবা ও রোগীদের ভোগান্তি নিয়ে জনস্বাস্থ্য সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ডা. ফয়জুল হাকিম বলেন, স্বাস্থ্য সেবা মানুষের মৌলিক অধিকার। আমাদের দেশে স্বাস্থ্য খাত বরাবরই উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজে গেলে বোঝা যায় মানুষ চিকিৎসার জন্য কীভাবে কাতরাচ্ছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যদি এমন অবস্থা হয় তাহলে আমাদের জেলা উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোর কী করুণ দশা। কোনো সরকারই এ দেশের মানুষের চিকিৎসা সেবা নিয়ে কোনো পরিকল্পনা করেনি। আমারা দীর্ঘদিন থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ দেশের সবস্তরে চিকিৎসা সংকট নিরসনের দাবি জানিয়ে আসছি।
এসআইবি/বিএইচ