
দেশে করোনা উদ্বেগের পর্যায়ে না হলেও নতুন করে সংক্রমণ বাড়ছে। প্রতিবেশী তিনটি দেশে সংক্রমণ কিছুটা বেশি হওয়ায় স্বাস্থ্য বিভাগ সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে আবারও করোনা পরীক্ষা চালুর পাশাপাশি হাসপাতালগুলোতে কোভিড শয্যা প্রস্তুতের নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
প্রাথমিকভাবে যেসব মেডিকেল কলেজ ও জেলা হাসপাতালে আরটি-পিসিআর ল্যাব রয়েছে, সেখানে সীমিত পরিসরে করোনা পরীক্ষা শুরু হবে। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক মো. আবু জাফর বলেন, এ বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত দেশে করোনায় সংক্রমিত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছেন ১৫৮ জন। আর জুন মাসের প্রথম ১০ দিনে শনাক্ত হয়েছেন ৫৪ জন। এর অর্থ, সংক্রমণে উল্লেখযোগ্য কোনো পার্থক্য নেই। তবে প্রতিবেশী দেশগুলোতে সংক্রমণ বাড়তে দেখা যাচ্ছে। সম্ভাব্য পরিস্থিতি মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে ২৮ হাজার দ্রুত করোনা শনাক্তকরণ কিট পেয়েছি। আজ (গতকাল) আরও ১০ হাজার আরটি-পিসিআর কিট পাচ্ছি। এসব কিট কাল-পরশুর মধ্যে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে পৌঁছানো হবে।
অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ১৭ লাখ টিকা বিভিন্ন টিকাকেন্দ্রে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে আগেই। টিকা আগের নিয়মেই দেওয়া হবে। ৬০ বছরের বেশি বয়সী মানুষ, দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভোগা মানুষ, রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম, এমন মানুষ টিকা পাবেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো দেশেও করোনাভাইরাসের নতুন একটি উপধরনে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা বাড়ছে। এটি ছড়িয়ে পড়া প্রতিরোধে ১১ দফা নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
তিনি আরও বলেন, ভাইরাসজনিত সংক্রমণের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। করোনাভাইরাসের কয়েকটি নতুন সাব-ভ্যারিয়েন্ট এরই মধ্যে চিহ্নিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক ভ্রমণকারীদের মাধ্যমে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের বিস্তার প্রতিরোধে দেশের সব স্থল, নৌ ও বিমানবন্দরের আইএইচআর ডেস্কগুলোয় নজরদারি ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়গুলো জোরদার করার বিষয়ে এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এদিকে, সংক্রমণ প্রতিরোধে জনসাধারণের করণীয় প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, জনসমাগম যথাসম্ভব এড়িয়ে চলুন এবং উপস্থিত হতেই হলে সে ক্ষেত্রে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করুন। শ্বাসতন্ত্রের রোগগুলো থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য মাস্ক ব্যবহার করুন। হাঁচি বা কাশির সময় বাহু বা টিস্যু দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে রাখুন। ব্যবহৃত টিস্যুটি অবিলম্বে ঢাকনাযুক্ত ময়লা ফেলার ঝুড়িতে ফেলুন। ঘন ঘন সাবান ও পানি কিংবা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলুন (অন্তত ২০ সেকেন্ড)। অপরিষ্কার হাতে চোখ, নাক ও মুখ ধরবেন না। আক্রান্ত ব্যক্তিদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলুন এবং কমপক্ষে ৩ ফুট দূরত্ব বজায় রাখুন।
এ ছাড়া সন্দেহজনক রোগীদের ক্ষেত্রে করণীয় তুলে ধরে বলা হয়েছে, জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হলে সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত বাড়িতে থাকুন। রোগীর নাক-মুখ ঢাকার জন্য মাস্ক ব্যবহার করতে বলুন। রোগীর সেবাদানকারীরাও সতর্কতা হিসেবে মাস্ক ব্যবহার করুন। প্রয়োজন হলে কাছের হাসপাতালে অথবা আইইডিসিআর (০১৪০১-১৯৬২৯৩) অথবা স্বাস্থ্য বাতায়ন (১৬২৬৩)-এর নম্বরে যোগাযোগ করুন।
সংবাদ সম্মেলনে অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখার পরিচালক ডা. মো. মঈনুল আহসান জানান, দেশের সব হাসপাতালকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। রাজধানীর মহাখালীর উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ডেডিকেটেড কোভিড-১৯ হাসপাতালে সাধারণ ৫০ শয্যা ও আইসিইউর ১৫ শয্যা শুধু করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া রাজধানীর মুগদা ও কুর্মিটোলা হাসপাতালে পৃথক শয্যার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাশাপাশি করোনা রোগীর জন্য খুলনা, ময়মনসিংহ, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৃথক ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে প্রস্তুতি আরও জোরদার করা হবে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়। এমন পরিস্থিতিতে করোনার বিস্তার বন্ধে পরীক্ষার সরঞ্জাম বাড়ানো এবং আবার টিকা দেওয়া শুরু করার কথা বলছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা। আইইডিসিআরের প্রতিনিধি জানান, দেশে এখন করোনার যে ধরন দেখা যাচ্ছে, তা অমিক্রন বা অমিক্রনের উপধরন। এর উপসর্গ তীব্র হতে দেখা যায়নি। তবে সতর্ক থাকার কোনো বিকল্প নেই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সিডিসির লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক মো. হালিমুর রশীদ বলেন, থাইল্যান্ডে সংক্রমণ বেশি দেখা যাচ্ছে। ভারত ও মালয়েশিয়াতেও সংক্রমণ বাড়ছে।
তিনি বলেন, আগামী ১০ দিনের মধ্যে করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা আবার চালু করা যাবে। প্রাথমিকভাবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগীয় শহরের হাসপাতালগুলোয় পরীক্ষা চালু হবে। যেসব হাসপাতালে আরটি-পিসিআর
ল্যাব রয়েছে, শুধু সেখানেই শুরুতে এই সুবিধা মিলবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, দেশে গত একদিনে ১০৭জনের নমুনা পরীক্ষা করে ১০ জনের শরীরে করোনাভাইরাস পাওয়া গেছে। শনাক্তের হার ৯.৩৫ শতাংশ। তবে এ সময়ে কারও মৃত্যু হয়নি। এ নিয়ে মোট আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০ লাখ ৫১ হাজার ৭৭০ জনে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, নতুন করে করোনা থেকে সুস্থ হয়েছেন দুইজন। এ নিয়ে এ সংখ্যা ২০ লাখ ১৯ হাজার ৩৮০ জনে দাঁড়িয়েছে। মহামারির শুরু থেকে এখন পর্যন্ত মোট শনাক্তের হার ১৩.০৫ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সমন্বিত নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, গত এক সপ্তাহে একাধিক জেলায় করোনা শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে করোনায় একজনের মৃত্যু হয়েছে ঢাকা শহরে। কক্সবাজার জেলার সিভিল সার্জন মাহমুদুল হক জানিয়েছেন, কক্সবাজার জেলায় এ মাসে ৩ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে, একজন রোহিঙ্গা শিবিরের। কক্সবাজারে আরটিপিসিআর করার সুযোগ আছে। তবে দ্রুত করোনা পরীক্ষার কিট নেই। চট্টগ্রাম জেলার স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে, জেলায় গত ১০ দিনে ৩ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আরটিপিসিআর থাকলেও জেলায় কোনো দ্রুত পরীক্ষার কিট নেই।
বরিশাল বিভাগের কোনো জেলায় করোনা পরীক্ষার কোনো ধরনের কিট নেই বলে বিভাগীয় পরিচালকের কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে। সিলেট জেলাতেও কোনো পরীক্ষার কিট নেই বলে জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে। জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন বলেন, যতটুকু পরীক্ষার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তাতে দেখা যাচ্ছে সংক্রমণ বাড়ছে। সংক্রমণ দ্রুত ও বেশি ছড়িয়ে পড়লে তা ঝুঁকি বাড়াবে। সুতরাং সংক্রমণ প্রতিরোধে ব্যক্তিপর্যায়ে, সামাজিক পর্যায়ে ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ব্যবস্থা নিতে হবে।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) তথ্য অনুযায়ী, গত এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন একজন। কিন্তু গত মে মাসের শেষ সপ্তাহে এতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়ায় ২৫-এ। আইসিডিডিআর, বির গবেষকরা করোনার নতুন একটি ধরন শনাক্তের কথা বলছেন। এর নাম এক্সএফজি। এর পাশাপাশি এক্সএফসি ধরনটিও পাওয়া গেছে। দুটিই করোনার শক্তিশালী ধরন অমিক্রনের জেএন-১ ভ্যারিয়েন্টের উপধরন।
জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, নতুন এই উপধরনের তীব্রতা তুলনামূলকভাবে কম। তবে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার খবরটি এসেছে ঠিক ঈদের সময়। এ সময় বহু মানুষ পশুর হাটে একত্রিত হয়েছেন। ছুটিতে বড় বড় শহর থেকে গ্রামে যাওয়ার সময় মানুষকে দীর্ঘ সময় বাস-ট্রেন-লঞ্চে ভিড়ের মধ্যে থাকতে হয়েছে। পর্যটনকেন্দ্রগুলোতেও ভিড় ছিল প্রচণ্ড। এসবই সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়িয়েছে।
এ অবস্থায় জনস্বাস্থ্যবিদ মোশতাক হোসেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেন, মাস্ক ব্যবহার করতে হবে, জনসমাগম এড়িয়ে চলতে হবে, সাবান পানি বা স্যানিটাইজার দিয়ে ঘন ঘন হাত পরিষ্কার করতে হবে, জ্বর-কাশি-শ্বাসকষ্ট থাকলে সুস্থ মানুষ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে হবে। করোনার সংক্রমণ রোধে হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা কিটের মজুতের কথা বলছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা। কিন্তু বাস্তবচিত্র ভিন্ন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা পরীক্ষার কোনো কিট নেই। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার প্রস্তুতির কথাও তুলে ধরা হয়।
সেখানে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাস নির্ণয়ের পরীক্ষা, টিকা, চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা নির্দেশিকা, ওষুধ, অক্সিজেন, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, আইসিইউ, কোভিড চিকিৎসার বিশেষায়িত সুবিধা সংবলিত নির্দিষ্ট হাসপাতাল, সেবাদানকারীদের জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তাসামগ্রীসহ সব বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় ও সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রস্তুতি চলমান আছে। এদিকে করোনা শনাক্তের কিট সংগ্রহে জোর দিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও দেশি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কিট সংগ্রহের চেষ্টা চলছে। ইতোমধ্যে কিছু কিট স্বাস্থ্য বিভাগের হাতে এসেছে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে। গত মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জানিয়েছিলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের কাছে ১ লাখ আরটিপিসিআর কিট ও ৫ লাখ দ্রুত শনাক্তকরণ কিট চাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বেশ কিছু ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান সরকারের কাছে কিট বিক্রি করত, তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করছে স্বাস্থ্য বিভাগ। এর পাশাপাশি ঢাকায় চীনা দূতাবাসের সঙ্গেও কথা হয়েছে। সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) কার্যালয় জানিয়েছে, তাদের কাছে ৩১ লাখ টিকা মজুত আছে। এই টিকা ফাইজার কোম্পানির। এর মধ্যে ১৭ লাখের বেশি টিকার মেয়াদ শেষ হবে ৫ আগস্টের মধ্যে।
গত দুই মাসে এই টিকাগুলো বিভিন্ন জেলায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবু জাফর এ বিষয়ে সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ফাইজারের এই টিকা তৈরি করা হয়েছিল করোনার মূল ভাইরাসকে মাথায় রেখে। বাংলাদেশে এখন ছড়িয়ে পড়া ধরনের ক্ষেত্রে তা কতটা কার্যকর, তা নিয়ে কারও কারও সংশয় আছে। এ ব্যাপারে কারিগরি কমিটি সিদ্ধান্ত নেবে। সেই কমিটি গঠনের কাজ চলছে।
- বিকেপি/এটিআর