Logo

স্বাস্থ্য

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যু বাড়ছে, চিকিৎসা ব্যয়ে দিশেহারা মানুষ

সাহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া

সাহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া

প্রকাশ: ১২ অক্টোবর ২০২৫, ১৬:১১

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যু বাড়ছে, চিকিৎসা ব্যয়ে দিশেহারা মানুষ

প্রতীকী ছবি

    • ডেঙ্গু চিকিৎসা ব্যয় মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে 
    • এডিস মশা নিধনের গতানুগতিক উপায়ে মিলছে না সুফল
    • চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত ৫০ হাজার ছাড়িয়েছে, মৃত্যু ২ শতাধিক

দেশজুড়ে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আবারও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। প্রতিদিন বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। হাসপাতালে শয্যা সংকট, চিকিৎসক ও নার্সদের সীমাহীন ব্যস্ততা, ওষুধ ও স্যালাইনের ঘাটতি— সব মিলিয়ে মানুষ দিশেহারা। সরকারি হিসাবে এখন পর্যন্ত ৫৩ হাজার ৬০৬ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন, মৃত্যু হয়েছে ২২৪ জনের।

রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডে রোগীর চাপ সামলানোই এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। প্রতিদিনই নতুন নতুন রোগী ভর্তি হচ্ছে, ফলে শয্যা সংকটের পাশাপাশি বেড়েছে স্বজনদের দুর্ভোগও। ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন আফরোজা খানম। তার বড় বোন সায়েরা খানম তিন দিন ধরে তার পাশে আছেন। তিনি বলেন, ‘হাসপাতাল থেকে ওষুধ-স্যালাইন দিচ্ছে, কিন্তু খাবারদাবার সব বাহির থেকে কিনতে হচ্ছে। চিকিৎসক বলেছেন, রোগীকে ডাবের পানি খাওয়াতে। কিন্তু এখন একটা ডাব ২০০ টাকার নিচে পাওয়া যায় না।’

সায়েরা আরও জানান, শুধু খাবার ও ডাবের পেছনেই প্রতিদিন প্রায় দুই হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। ‘আমাদের বাবা একজন মুদি দোকানি, এই ব্যয় মেটানো এখন খুব কষ্টকর হয়ে পড়েছে,’ বলেন তিনি।

একই বাস্তবতার মুখোমুখি রায়হান আহমেদ নামের এক বেসরকারি চাকরিজীবী। তার স্ত্রী তন্নি ইসলাম রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি। রায়হান আহমেদ জানান, ‘প্রতিদিন শুধু চিকিৎসা, বেড ফি, ওষুধ, খাবার— সব মিলিয়ে ১২ হাজার টাকার মতো খরচ হচ্ছে। ডাক্তার বলেছেন, অবস্থা খারাপ হলে আইসিইউতে নিতে হবে। সেই ব্যয় বহন করা আরও কঠিন হবে।’

সম্প্রতি ডেঙ্গু থেকে সুস্থ হওয়া মাহমুদ হাসান নামের একজন জানান, তিনি বাসায় থেকেই চিকিৎসা নিয়েছিলেন। এখন সুস্থ হলেও সেই অভিজ্ঞতা ছিল ভয়াবহ। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন সিবিসি টেস্ট করাতে ৭০০ টাকা লাগত। ডাক্তার ভিজিট, ওষুধ, স্যালাইন, ফল— সব মিলিয়ে পাঁচ দিনে প্রায় ১৪ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।’

ডেঙ্গু চিকিৎসার ব্যয় নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, ‘ডেঙ্গু চিকিৎসা এখন শুধু একটি স্বাস্থ্য সংকট নয়, এটি অর্থনৈতিক সংকটেও রূপ নিচ্ছে। একজন রোগীর চিকিৎসায় গড়ে ১০ থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ হচ্ছে, যা নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য একটি বড় বোঝা। সরকারি হাসপাতালেও রোগীরা নানা খরচ বহন করতে বাধ্য হচ্ছেন— বিশেষ করে পরীক্ষা, ওষুধ ও খাবারের ক্ষেত্রে। অনেক ক্ষেত্রে হাসপাতালে জায়গা না পেয়ে রোগীরা বাড়িতেই চিকিৎসা নিচ্ছেন, যা ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার পাশাপাশি ব্যয়ও বাড়াচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে যতটা গুরুত্ব ভেক্টর কন্ট্রোলে (মশা নিধন) দেওয়া দরকার, ততটাই দরকার জনসচেতনতা ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রস্তুতি। সময়মতো প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ না নিলে এই ব্যয়ের বোঝা আরও বাড়বে এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর চাপ ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।’

দেশে ডেঙ্গুর এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেও এডিস মশা নিধনে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সরকারি ও স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে কিছু প্রতীকী অভিযান চালানো হলেও তা মূলত দেখানো আয়োজনেই সীমাবদ্ধ। নিয়মিত ফগার মেশিনে ধোঁয়া ছড়ানো, লার্ভা নিধন অভিযান কিংবা নালা-নর্দমা পরিষ্কারের কাজও অনেক জায়গায় অনিয়মিত ও অকার্যকর। ফলে রাজধানীসহ সারাদেশে এডিস মশার বিস্তার বেড়েই চলেছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমন্বিত উদ্যোগ, ধারাবাহিক নজরদারি ও জনসচেতনতা ছাড়া ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, প্রতিরোধের চেয়ে ডেঙ্গু মোকাবিলায় চিকিৎসার দিকেই বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে, যা কোনোভাবেই দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নয়।

ডেঙ্গুর এই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। অনেকেই বাড়িতে মশা প্রতিরোধে নানা ব্যবস্থা নিচ্ছেন— মশার কয়েল, স্প্রে ও ইলেকট্রিক ব্যাট ব্যবহার করছেন নিয়মিত। চিকিৎসকরা বলছেন, আতঙ্ক নয়, সচেতনতা জরুরি। জ্বর, মাথাব্যথা, চোখে ব্যথা, শরীরে ব্যথা বা চামড়ায় লাল দাগ দেখা দিলে দ্রুত পরীক্ষা করে চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন তারা। বিশেষ করে শিশু, বয়স্ক ও গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘ডেঙ্গু এখন আর মৌসুমি রোগ নয়, এটি সারাবছরের সমস্যায় পরিণত হয়েছে। মশা নিয়ন্ত্রণে ধারাবাহিক উদ্যোগ না থাকায় এবং নগর ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা থাকায় পরিস্থিতি ভয়াবহ হচ্ছে। প্রতি বছর একই ভুলের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে—যখন সংক্রমণ বাড়ে তখন তড়িঘড়ি করে অভিযান শুরু হয়, কিন্তু টেকসই পরিকল্পনা বা জনসচেতনতা কর্মসূচি থাকে না। ফলে সমস্যা আরও জটিল হয়ে উঠছে। এখন শুধু হাসপাতাল প্রস্তুত করলেই চলবে না, মশার প্রজননস্থল ধ্বংসে স্থানীয় সরকার, নাগরিক সমাজ ও জনগণকে একযোগে কাজ করতে হবে।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশারের বিশ্লেষণ ডেঙ্গু পরিস্থিতির গভীরতর মাত্রাকে স্পষ্ট করে তোলে। তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো— জলবায়ু পরিবর্তন এখন এডিস মশার বিস্তারকে আরও ত্বরান্বিত করছে। অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রার ওঠানামা এবং আর্দ্রতার তারতম্য এডিস মশার জীবচক্রকে অনুকূল পরিবেশ দিচ্ছে। এতে ভাইরাস সংক্রমণও দ্রুততর হচ্ছে। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে অল্প সময়ের বৃষ্টিতে রাস্তাঘাট, ছাদের টব, পুরোনো টায়ার কিংবা প্লাস্টিকের পাত্রে পানি জমে গেলে, তা মুহূর্তেই মশার প্রজননক্ষেত্রে পরিণত হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘ডেঙ্গুর বর্তমান পরিস্থিতি কেবল একটি রোগের প্রাদুর্ভাব নয়; বরং এটি জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতা এবং জনস্বাস্থ্যের সম্মিলিত সংকট। এই সংকট মোকাবিলা করতে হলে বিচ্ছিন্ন নয়, বরং ব্যাপক ও সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। স্থানীয় সরকার, নগর কর্তৃপক্ষ, স্বাস্থ্য বিভাগ এবং নাগরিক সমাজকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। অন্যথায় এডিস নিয়ন্ত্রণ ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠবে।’

এসআইবি/এমএইচএম 

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

ডেঙ্গু ভাইরাস

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর