কুষ্ঠরোগে ভোগান্তি, শ্যামনগরে নেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক
আব্দুস সামাদ, সাতক্ষীরা
প্রকাশ: ১২ অক্টোবর ২০২৫, ১৮:৫৩
ছবি : সংগৃহীত
২০০৬ সালে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় শ্যামনগরের দরিদ্র রিকশাচালক ফিরোজ হোসেন ডান পায়ে ফ্যাকাশে দাগের অস্তিত্ব অনুভব করেন। গুরুত্ব না দেওয়ায় তিন মাস পর দাগটি আরও বড় হয়। স্থানীয় গ্রাম ডাক্তারের কাছে গেলে চর্মরোগের চিকিৎসা দেওয়া হয়। তাতেও ভালো না হয়ে সেখান থেকে গুটি বের হয় এবং ধীরে ধীরে পা অবশ হয়ে পড়ে। পরে খুলনা ২৫০ শয্যা হাসপাতালে ভর্তি হলে পরীক্ষাবিহীন চিকিৎসা দেওয়া হয়, একপর্যায়ে তার ডান পা কেটে ফেলতে হয়।
শুধু ফিরোজ হোসেনই নন, একইভাবে শ্যামনগরের অশ্বিনী মুন্ডাও হয়েছেন প্রতিবন্ধী। ১৯৭০ সালে দুই হাতে ফ্যাকাশে দাগ দেখা দিলে তিনিও স্থানীয় ডাক্তারের পরামর্শে তা কেটে ফেলেন। কিছুদিনের মধ্যেই হাত অবশ হয়ে যায় এবং তিনি কর্মক্ষমতা হারান। এই রোগটির নাম কুষ্ঠ। মানবজাতির ইতিহাসে অন্যতম প্রাচীন এই রোগ নিয়ে দেশে এখনও সচেতনতা খুবই সীমিত।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার লক্ষ্য অনুযায়ী, প্রতি ১০ হাজার জনে কুষ্ঠ রোগীর সংখ্যা একজনের নিচে নামিয়ে আনা। বাংলাদেশ ১৯৯৮ সালেই এ লক্ষ্য পূরণ করলেও, বেসরকারি সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর এখনও প্রায় চার হাজার মানুষ নতুন করে কুষ্ঠে আক্রান্ত হচ্ছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, আশির দশকে দেশে ১০ থেকে ১১ হাজার কুষ্ঠরোগী শনাক্ত হয়। ২০২০ সালে শনাক্ত হয় ২ হাজার ৭২৪ জন। সরকারের লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে এ সংখ্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা।
সাতক্ষীরা জেলায় ২০২৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত কুষ্ঠরোগীর সংখ্যা ৬৮ জন। এর মধ্যে অনেকেই সুস্থ হয়েছেন। বর্তমানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৫১ জন। এর মধ্যে কালীগঞ্জে ৩৯ জন, আশাশুনিতে ১১ জন এবং সদরে ১ জন। জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্যমতে, রোগী শনাক্ত ও ওষুধ বিতরণে সহযোগিতা করছে বেসরকারি সংস্থা সিএসএস।
চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের মতে, কুষ্ঠ একটি দীর্ঘস্থায়ী সংক্রামক রোগ, যা মাইক্রোব্যাকটেরিয়াম লেপ্রে ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট। এটি ত্বক, স্নায়ু, শ্বাসতন্ত্র ও চোখকে প্রভাবিত করে। ত্বকের সংবেদনশীলতা নষ্ট করে এবং পেশীর দুর্বলতা সৃষ্টি করে। তবে সময়মতো চিকিৎসা নিলে কুষ্ঠ সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য।
কুষ্ঠ সাধারণত ছড়ায় হাঁচি-কাশির মাধ্যমে। আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। দুর্বল রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, জিনগত কারণ ও দীর্ঘসময় কাছাকাছি থাকার ফলে কুষ্ঠ সংক্রমিত হয়।
কুষ্ঠের প্রাথমিক লক্ষণ হলো ত্বকের একটি অংশ সাদা বা ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া এবং সেই অংশ অবশ হয়ে পড়া। প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা নিলে এটি সম্পূর্ণ সেরে যায়। চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয় মাল্টি-ড্রাগ থেরাপি (এমডিটি), যাতে থাকে অ্যান্টিবায়োটিকের সংমিশ্রণ—ড্যাপসোন, রিফাম্পিসিন ও ক্লোফাজিমিন।
বেসরকারি সংস্থা সিএসএস-এর তথ্যমতে, ২০১৯ সালে সাতক্ষীরা জেলায় ২ জন ও বাগেরহাটে ৫ জন, ২০২০ সালে সাতক্ষীরায় ১২ জন ও বাগেরহাটে কেউ নেই, ২০২১ সালে সাতক্ষীরায় ২৯ জন ও বাগেরহাটে ৩১ জন, ২০২২ সালে সাতক্ষীরায় ৫০ জন ও বাগেরহাটে ৭৬ জন, ২০২৩ সালে সাতক্ষীরায় ৪৯ জন ও বাগেরহাটে ৯২ জন, ২০২৪ সালে সাতক্ষীরায় ৬৮ জন ও বাগেরহাটে ১০১ জন, এবং ২০২৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত সাতক্ষীরায় ৩৫ জন ও বাগেরহাটে ৭৪ জন নতুন কুষ্ঠরোগী শনাক্ত হয়েছেন।
সিএসএস-এর প্রজেক্ট অফিসার মো. খালেকুজ্জামান বলেন, ‘কুষ্ঠ নিয়ন্ত্রণে আমরা সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের সব উপজেলায় সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কর্মশালা আয়োজন করেছি। রোগীদের শনাক্ত করে বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহ করা হয়। তবে শ্যামনগরে কুষ্ঠ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় রোগীরা ভোগান্তিতে রয়েছেন।’
জেলা সিভিল সার্জন মো. আব্দুস সালাম বলেন, ‘সিএসএস এনজিওর মাধ্যমে রোগী শনাক্ত ও ওষুধ বিতরণ করা হয়। প্রতিটি উপজেলায় সরকারি কর্মীও নিয়োজিত আছেন। চলতি মাসে জেলায় ৫১ জন রোগী চিকিৎসাধীন। পাশাপাশি কুষ্ঠরোগ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে সেমিনার, উঠান বৈঠকসহ নানা কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে।’
আশাশুনি উপজেলার যক্ষা ও কুষ্ঠ নিয়ন্ত্রণ সহকারী মো. আজহারুল ইসলাম জানান, ‘চলতি মাসে নতুন কোনো রোগী শনাক্ত হয়নি। এখানে জনবল সংকট থাকায় মাঠপর্যায়ের কাজে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে।’
কুষ্ঠ একটি নিরাময়যোগ্য রোগ—এই বার্তা সমাজে ছড়িয়ে দিতে বিশেষজ্ঞরা জোর দিয়েছেন। কারণ এখনও অনেকে মনে করেন, এই রোগ সারানো যায় না বা ছোঁয়ায় ছড়ায়। তাই কুষ্ঠরোগীদের প্রতি সামাজিক বৈষম্য ও কুসংস্কার দূর করা সময়ের দাবি।
এআরএস


