Logo

স্বাস্থ্য

প্রশাসনিক দুর্বলতায় বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ

Icon

তরিকুল ইসলাম সুমন

প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:৫৪

প্রশাসনিক দুর্বলতায় বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ

জলবায়ু পরিবর্তন, প্রশাসনিক দুর্বলতা, প্রয়োজনীয় জনবলের স্বল্পতা, জনসচেতনতা ও সঠিক পরিকল্পনার অভাব, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে ধীরগতির কারণে দেশব্যাপী বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। ফলে ২৫ বছর আগে মামুলি মশাবাহিত রোগ মনে করা হলেও আজ তা মানুষ ভীত সন্ত্রস্ত করে তুলেছে। 

আগে যেখানে সেপ্টেম্বরের পর বৃষ্টির ধারা প্রায় বন্ধ হয়ে যেত, এখন দেখা যায় নভেম্বরেও হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টি হচ্ছে, যা এডিস মশার প্রজননের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তাপমাত্রা। ২০-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এডিস মশার বেঁচে থাকার জন্য উপযুক্ত, যা নভেম্বর মাসেও লার্ভা ও পিউপা হয়ে নতুন প্রজন্মের মশার জন্ম নিচ্ছে। বৃষ্টি যত দেরিতে হয়, ডেঙ্গুর প্রজনন চক্র তত দীর্ঘায়িত হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে জানানো হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে ১ হাজার ৬৯ জন ডেঙ্গুরোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ সময়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় পাঁচজন, উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় তিনজন এবং খুলনা ও বরিশাল বিভাগে একজন করে মারা গেছেন।

এ সময় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১০৬৯ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে বরিশাল বিভাগে ১২৮ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৯৯ জন, ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ২১৯ জন, ঢাকা উত্তর সিটিতে ২৫১ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ১৫২ জন, খুলনা বিভাগে ৬৮ জন (সিটি করপোরেশনের বাইরে), ময়মনসিংহ বিভাগে ৭০ জন (সিটি করপোরেশনের বাইরে), রাজশাহী বিভাগে ৩৪ জন (সিটি করপোরেশনের বাইরে), রংপুর বিভাগে ৪৩ জন (সিটি করপোরেশনের বাইরে) এবং সিলেট বিভাগে ৫ জন (সিটি করপোরেশনের বাইরে) নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন। 

এদিকে গত একদিনে সারা দেশে ৯৫৮ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন। এ নিয়ে চলতি বছর ছাড়পত্র পেয়েছেন ৭১ হাজার ৪৮৭ জন। এ বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত সবমিলিয়ে ৭৫ হাজার ৯৯২ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ৩০২ জনের।

কীটতত্ত্ববিদ ও জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, আগামী নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসেও দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমবে না, এ বছর ডেঙ্গুর সিজন বলেও কিছু থাকছে না। শীতকালেও থাকবে এডিস মশার দাপট এবং বাড়বে ডেঙ্গুর ব্যাপকতা। শুধু তাই নয়, চলতি বছরের সংক্রমণ ধারাবাহিকভাবে চলতে পারে আগামী বছরও।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা) ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, ‘ডেঙ্গু এবার সারা বছর থাকবে, যেটা আগে হতো না। ইদানীংকালে সেই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এবার সেটা প্রতিষ্ঠিত হলো-অক্টোবরে সর্বোচ্চ আক্রান্ত ও মৃত্যু, নভেম্বরেও চলছে এ ধারা।

হয়তো পুরো শীতজুড়েই থাকতে পারে। এবার ডেঙ্গুর আরেকটা প্রবণতা গ্রামাঞ্চলগুলোতে, ছোট ছোট শহরগুলোতে ডেঙ্গুর প্রবণতা বেড়েছে, এটা নতুন একটা ডায়মেনশন। এ থেকে আমাদের একটা শঙ্কার দিক তৈরি হলো, আগামী ৩০/৪০ বছর হয়তো গ্রামগুলো ডেঙ্গুর প্রকোপে জর্জরিত হবে।

দ্বিতীয় হচ্ছে- স্বাস্থ্যসেবা, ডেঙ্গু শনাক্তকরণ এবং চিকিৎসা দুটোই রাজধানীকেন্দ্রিক। বড় বড় শহরগুলোতেও ডেঙ্গুর চিকিৎসা অত্যন্ত দুর্বল। যার ফলে ডেঙ্গু চিকিৎসাটা ঠিকমতো হবে না এবং মৃত্যুর শঙ্কা বাড়বে। আমাদের গ্রামের মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থা যেহেতু একটু দুর্বল সুতরাং একেক জন ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা করাতে গিয়ে একেকটা পরিবার সর্বস্বান্ত হবে- এটা নিয়ে আমরা শঙ্কিত। গ্রামাঞ্চলে ডেঙ্গু একটা বিশেষ জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা দেবে।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও মশাবাহিত রোগবিষয়ক গবেষক কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বলেন, এ বছর ডেঙ্গুর সিজন দীর্ঘ। সাধারণত নভেম্বরে ডেঙ্গু থাকে না। নভেম্বর-ডিসেম্বরেও ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকবে। এ বছর সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটেছে ৫ বছর, ১১-১৫ বছর বয়সি শিশু ও কিশোরদের। সর্বাধিক মৃত্যু ঘটেছে ঢাকা বিভাগে, যা রাজধানীকেন্দ্রিক উচ্চ ঝুঁকির ইঙ্গিত দেয়। এই বাস্তবতাকে সামনে রেখে বলা যায়, নভেম্বর মাসেও ডেঙ্গু কমছে না বরং পরিস্থিতি এখনো উদ্বেগজনক পর্যায়ে। এর মূল কারণগুলো একাধিক এবং সেগুলো পরস্পর-সম্পর্কিত।’

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, প্রশাসনিক অদক্ষতা, অভিজ্ঞ ও দক্ষ কীটতত্ত্ববিদ নিয়োগ না করা ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ধীরগতি। স্থানীয় সরকার বিশেষ করে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোর মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, ওয়ার্ড পর্যায়ে মশা নিধন কর্মসূচি কেবল ‘দেখানোর জন্য’ চলে। ফগার মেশিনের কার্যকারিতা সীমিত এবং অনেক সময় এটি ভুল জায়গায় বা ভুল সময়ে ব্যবহার করা হয়। ডেঙ্গু মোকাবিলায় নাগরিকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এডিস মশার ৮০ শতাংশ প্রজনন স্থানই মানুষের আবাসিক বা কর্মস্থল পরিবেশে অবস্থিত। 

অনেকে মনে করেন শীত এলে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। ঢাকা শহরের বহুতল ভবনের বেজমেন্ট, পার্কিং স্থান, গাড়ি ধোয়ার জায়গা, নির্মাণাধীন ভবনের পানি জমা স্থান এবং অনেক এলাকায় পানির স্বল্পতার কারণে ড্রাম বা বালতিতে জমিয়ে রাখা পানি, এসব স্থানে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা সারা বছর প্রজনন করতে পারে। তাই শীতকালেও এডিস মশার প্রজনন চলতে থাকে।

গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকা শহরের অনেক ভবনের নিচতলা ও বেজমেন্টে দিনের বেলায় প্রচুর এডিস মশা থাকে, যা শীতেও সক্রিয় থাকে। ফলে ডিসেম্বর ও জানুয়ারি পর্যন্ত ডেঙ্গুর সংক্রমণ অব্যাহত থাকতে পারে। দুই সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, গত ৯ বছরে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ডেঙ্গু ও অন্যান্য মশাবাহিত রোগের বিস্তার রোধে খরচ করেছে প্রায় ৭০৭ কোটি টাকা।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) কীটনাশক, আগাছা ও জলাশয় পরিষ্কার এবং যন্ত্রপাতি কিনতে প্রায় ৪৬৪ কোটি টাকা খরচ করেছে। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এ বাবদ খরচ করেছে ২৪৩ কোটি টাকা। এ বছর ডিএনসিসি মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের জন্য ১৩৫ কোটি টাকা এবং ডিএসসিসি ৪৬ কোটি ৫০ টাকার বাজেট রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুরনো কৌশল, দুর্বল পরিকল্পনা ও সার্বিক নীতির অভাবে সিটি করপোরেশনগুলোর মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। জাতীয় পর্যায়ে মনিটরিংয়ের সহায়তায় সমন্বিত, বিজ্ঞানভিত্তিক উদ্যোগ ছাড়া ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার বিরুদ্ধে লড়াই ব্যর্থই থাকবে। তাই বছরের পর বছর একই পুরনো পদ্ধতি ব্যবহারের অবসান করতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ সালে প্রথম শনাক্ত হওয়ার পর ডেঙ্গুকে এক সময় মৌসুমি সমস্যা বলে মনে করা হতো। এখন ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাব ক্রমেই বাড়ছে। ২০১৬ সালে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল মাত্র ১৪ জন, আর আক্রান্ত হয়েছিল ৬ হাজার ৬০ জন। পরিস্থিতি ভয়াবহ হয় ২০১৯ সালে। সে বছর আক্রান্তের সংখ্যা ছিল এক লাখের বেশি এবং মৃত্যুর সংখ্যা ১৭৯ ছাড়ায়।

তবে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাব ঘটে ২০২৩ সালে। সে বছর ১ হাজার ৭০৫ জন মারা যায়, ওই বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন তিন লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এক লাখ এক হাজার ২১৪ জন এবং ডেঙ্গুতে মোট মারা গেছে ৫৭৫ জন। 

ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. নিশাত পারভীন বলেন, আমরা আমাদের লোক দিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ ছিটানোর ব্যবস্থা করে থাকি। তার পরেও প্রয়োজনীয় জনবলের অভাব রয়েছে। এখন পর্যন্ত কীটনাশকে মশার প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরির কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ফগিং প্রসঙ্গে নিশাত বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া রোগীর তালিকার ভিত্তিতে বিভিন্ন এলাকায় ফগিং করেন। নিয়মিত মশক নিধন কার্যক্রম, মনিটরিং এবং অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ‘এ বছর বর্ষা মৌসুমের শুরুতে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সভা করেছি। সভায় বিশেষজ্ঞরা যে পরামর্শ দিয়েছেন, সেগুলো বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছি। সাম্প্রতিক তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত বছরের তুলনায় ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা কমেছে। 

তবে ডেঙ্গুতে একটি মৃত্যুও কাম্য নয়। স্বল্প জনবল নিয়েও সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি।’ 

ডিএনসিসি প্রশাসক আরও জানান, আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী জনস্বাস্থ্য রক্ষায় প্রতি হাজারে ২.৩ জন কর্মীর প্রয়োজন, কিন্তু আমাদের রয়েছে প্রতি ১১ হাজারে একজন কর্মী- যা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত অপ্রতুল।

বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী মাঠপর্যায়ে সেবা কার্যক্রম জোরদার করতে ডিএনসিসি এলাকায় ৭ জন পরিদর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালাচ্ছি এবং ডিএনসিসি এলাকার বাড়িগুলোতে মশার প্রজননস্থল ধ্বংস নিশ্চিত করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছি।


প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

ডেঙ্গু ভাইরাস

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর