Logo

স্বাস্থ্য

সুস্থ পেট মানেই সুস্থ মন, আর সুস্থ মন মানেই জীবনের পরিপূর্ণতা

Icon

অধ্যাপক ড. মজিবুল হক

প্রকাশ: ১৬ নভেম্বর ২০২৫, ১৬:০৮

সুস্থ পেট মানেই সুস্থ মন, আর সুস্থ মন মানেই জীবনের পরিপূর্ণতা

আমরা সাধারণত ভাবি, মস্তিষ্ক বা ব্রেইনই সবকিছুর নিয়ন্ত্রক— চিন্তা, অনুভূতি, সিদ্ধান্ত, আবেগ, সবই সেখানে তৈরি হয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, আমাদের শরীরের আরেকটি অঙ্গ— পেট বা গাট— এর সঙ্গে ব্রেইনের একটি গভীর যোগাযোগ রয়েছে। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে এই সম্পর্ককে বলা হয় ‘গাট–ব্রেইন অ্যাক্সিস’ (Gut–Brain Axis)। এটি এমন এক স্নায়বিক ও রাসায়নিক যোগাযোগ ব্যবস্থা, যা মস্তিষ্ক ও পেটকে একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত রাখে। 

গবেষকরা পেটকে অনেক সময় ‘দ্বিতীয় মস্তিষ্ক’ (Second Brain) বলে আখ্যা দেন। কারণ, আমাদের হজমতন্ত্রে একটি স্বতন্ত্র স্নায়ুতন্ত্র রয়েছে, যার নাম এন্টারিক নার্ভাস সিস্টেম (Enteric Nervous System)। এতে প্রায় ১০০ মিলিয়নের বেশি স্নায়ুকোষ রয়েছে— যা আমাদের মেরুদণ্ডের চেয়েও বেশি! এই স্নায়ুতন্ত্র মস্তিষ্কের সঙ্গে ক্রমাগত যোগাযোগ রাখে ভেগাস নার্ভ (Vagus Nerve) নামক একটি প্রধান স্নায়ুর মাধ্যমে। এর মাধ্যমে পেটের অবস্থা, হজম প্রক্রিয়া, এমনকি ব্যাকটেরিয়ার কর্মকাণ্ড সম্পর্কেও তথ্য মস্তিষ্কে পৌঁছে যায়।

এ সম্পর্কের অন্যতম প্রধান উপাদান হলো গাট মাইক্রোবায়োম— অর্থাৎ পেটে বসবাসরত কোটি কোটি জীবাণু বা ব্যাকটেরিয়া। এই জীবাণুগুলো কেবল খাবার হজমে সাহায্য করে না, বরং হরমোন ও নিউরোট্রান্সমিটার উৎপাদনের মাধ্যমে আমাদের মুড, ঘুম ও মানসিক ভারসাম্যেও প্রভাব ফেলে। উদাহরণস্বরূপ, শরীরের প্রায় ৯০% সেরোটোনিন, যা ‘হ্যাপিনেস হরমোন’ নামে পরিচিত, উৎপন্ন হয় পেটেই। তাই পেটের ভারসাম্য নষ্ট হলে মানসিক অবসাদ, উদ্বেগ বা একাগ্রতার ঘাটতি দেখা দিতে পারে।

আমরা প্রতিদিনই এই সম্পর্কের প্রমাণ পাই— যেমন পরীক্ষার আগে বা গুরুত্বপূর্ণ কোনো অনুষ্ঠানের আগে অনেকের পেটে অস্বস্তি হয়, ক্ষুধা নষ্ট হয় বা বারবার বাথরুমে যেতে হয়। আবার মানসিক চাপ বা স্ট্রেসে ভুগলে হজমের সমস্যা, গ্যাস, কিংবা পেট ব্যথা দেখা দেয়। এগুলোই আসলে গাট–ব্রেইন যোগাযোগের বাস্তব প্রতিফলন।

অন্যদিকে, খাদ্যাভ্যাসের প্রভাবও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। ফাস্টফুড, অতিরিক্ত চিনি, তেল-মসলা ও প্রক্রিয়াজাত খাবার পেটের ভালো ব্যাকটেরিয়াগুলোকে ধ্বংস করে দেয়। এর ফলে গাট ইনফ্ল্যামেশন বা প্রদাহ সৃষ্টি হয়, যা মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয় এবং মনোযোগের ঘাটতি, মানসিক ক্লান্তি বা বিষণ্নতার মতো সমস্যা ডেকে আনে। বিপরীতে, প্রোবায়োটিক ও প্রিবায়োটিক সমৃদ্ধ খাবার— যেমন টকদই, ফারমেন্টেড খাবার, আঁশযুক্ত শাকসবজি ও ফল— গাট ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্য বজায় রাখে, যা মন ভালো রাখতে সহায়ক।

স্ট্রেস বা মানসিক চাপের দিক থেকেও এই সম্পর্ক অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। যখন কেউ দীর্ঘদিন মানসিক চাপে ভোগে, শরীরে কর্টিসল হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়। এই হরমোন হজম প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে, ফলে অ্যাসিডিটি, কোষ্ঠকাঠিন্য বা ইরিটেবল বাওয়েল সিন্ড্রোম (IBS)-এর মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। একইভাবে, দীর্ঘমেয়াদি হজম সমস্যা মস্তিষ্কে ইনফ্ল্যামেটরি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, যা উদ্বেগ বা হতাশা বাড়িয়ে দিতে পারে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিজ্ঞানীরা গাট-ব্রেইন সম্পর্ক নিয়ে গভীরভাবে গবেষণা করছেন। নিউরোলজিস্ট ও গ্যাস্ট্রোএনটেরোলজিস্টরা বলছেন, মানসিক রোগের চিকিৎসায় গাটের যত্ন নেওয়া এখন এক অত্যাবশ্যক অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, রোগী যখন সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও প্রোবায়োটিক গ্রহণ শুরু করেন, তার মুড ও ঘুমের উন্নতি ঘটে।

ব্রেইন ও পেটের সম্পর্ক কেবল শারীরবৃত্তীয় নয়, মানসিক ও আবেগীয় স্তরেও গভীরভাবে যুক্ত। আমাদের মন ও দেহ আসলে একই ব্যবস্থার দুই প্রান্ত, এবং একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। তাই মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে চাইলে শুধু ধ্যান বা ওষুধ নয়, বরং পেটের যত্ন নেওয়াও সমান জরুরি। পরিমিত খাবার, প্রচুর পানি, নিয়মিত ব্যায়াম, পর্যাপ্ত ঘুম ও মানসিক প্রশান্তি— এই পাঁচটি অভ্যাসই গড়ে তুলতে পারে একটি সুস্থ গাট এবং একটি তীক্ষ্ণ, প্রশান্ত মস্তিষ্ক।

লেখক : অধ্যাপক ড. মজিবুল হক (পিএইচডি, এনডি, এফডিএম), আমেরিকান ওয়েলনেস সেন্টার, ঢাকা।

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর