শীতের মৌসুম শুরু হলেও ডেঙ্গুতে মৃত্যু থামছে না। ডিসেম্বরেও চোখ রাঙাচ্ছে এডিস মশবাহিত এ রোগটি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মশক নিধনে কার্যকর উদ্যোগের অভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না ডেঙ্গু।
দেশের কীটতত্ত্ববিদরা আগেই সতর্ক করে বলেন, ডিসেম্বরেও ডেঙ্গুর চোখ রাঙানি থাকবে। দেশে বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকে। শীত আসতে শুরু করলে ডেঙ্গুর সংক্রমণ কমে যায়। তবে চলতি বছর শীতের মৌসুমও চোখ রাঙাচ্ছে ডেঙ্গু। এখনো প্রতিদিন শত শত ডেঙ্গুআক্রান্ত রোগী রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। প্রতিদিনই প্রাণহানি হচ্ছে।
গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গু বিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত একদিনে ডেঙ্গুতে আরও পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে গত দুই সপ্তাহে মারা গেছেন ২৭ জন। চলতি বছরের এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০৯ জনে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু (১৯২ জন) হয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে। পাশাপাশি এই সময়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ৬৮ জন ছাড়াও বরিশাল বিভাগে ৫০ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৩১ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ২৪, রাজশাহী বিভাগে ২০ জন, খুলনা বিভাগে ১৩ জন, ঢাকা বিভাগে ৯ জন এবং সিলেট বিভাগে ২ জন ডেঙ্গুতে মারা গেছেন।
আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, বিক্ষিপ্তভাবে কিছু কীটনাশক ছিটানো ছাড়া তো সংঘবদ্ধভাবে কোন কাজ নেই। কীটতত্ত্ববিদ দিয়ে দল গঠন করে এডিস মশার প্রজননস্থল খোঁজা হচ্ছে না, মশার লার্ভা ধ্বংস করা হচ্ছে না। ফলে ডেঙ্গুও নিয়ন্ত্রণে আসছে না।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. এম এইচ চৌধুরী বলেন, ডেঙ্গুর প্রকোপ কমার কোন উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। মশা মারা হচ্ছে না, ডেঙ্গুর ভাইরাস নিয়ে গবেষণা হচ্ছে না এবং মশা মারার জন্য পরিকল্পনাও নেই। অবশ্য এ পরিস্থিতির জন্য জলবায়ু পরিবর্তনও অনেকাংশে দায়ী। কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় ডিসেম্বরেও ভোগাতে পারে ডেঙ্গুর প্রকোপ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, গত একদিনে ডেঙ্গুতে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন নতুন ৩৮৭ জন ডেঙ্গু রোগী। তাদের মধ্যে বরিশাল বিভাগে ৪০ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৭১ জন, ঢাকা বিভাগের অন্যান্য জেলায় ৮৩ জন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ৫৩ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৫৫ জন, খুলনা বিভাগে ৩৩ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ২৬ জন, রাজশাহী ২২ জন, সিলেট বিভাগে ৪ জন ডেঙ্গু রোগী রয়েছেন। নতুন আক্রান্তদের মধ্যে পুরুষ রোগী ৬৬ দশমিক ৭ শতাংশ এবং নারী ৩৩ দশমিক ৩ শতাংশ।
চলতি বছরের গত ১ জানুয়ারি থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত ১ লাখ ৪৭৭ জন বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হন। এদের মধ্যে ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ পুরুষ এবং ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ নারী। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে বরিশাল বিভাগে, ২১ হাজার ২৮৩ জন। আর সবচেয়ে কম ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে সিলেট বিভাগে, ৪১৫ জন।
জলবায়ু পরিবর্তন ও দেশের মৌসুমের পরিবর্তনের জন্য এখন সারা বছরই ডেঙ্গু হচ্ছে বলে জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী। তিনি বলেন, ২০১৯ সালে মহামারির মধ্য দিয়ে ডেঙ্গু সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। একই সঙ্গে এটা মৌসুমি থেকে বাৎসরিক রোগেও পরিবর্তন হয়েছে। এ ছাড়া ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ বা নির্মূল করার জন্য কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে কোনো কার্যক্রম একেবারেই না থাকার ফলে মশা ও ডেঙ্গু বাড়ছে বলেও জানান তিনি।
এমন পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষকে পরামর্শ দিয়ে এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, সাধারণ মানুষ তার বাড়িঘর, আঙিনা বা এডিস মশা জন্মানোর যে পরিবেশ সেটি নিজেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করবে যেন মশার প্রজনন হতে না পারে। প্রতিবেশীকেও উৎসাহিত করবে। শিশুরা যখনই ঘুমাবে যাতে মশারির ভেতরে রাখা হয় এবং পুরো শরীর ঢাকা থাকে এমন পোশাক যাতে পরানো হয়। বেশি মশা রয়েছে এমন জায়গায় গেলে, মশা তাড়ানোর ক্রিম ব্যবহার করতে পারে। যদি কারও কোনো ধরনের জ্বর হয়, তাহলে সেটি যেন অবহেলা না করে। দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়। প্রয়োজনে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। তাহলে সে অনুযায়ী চিকিৎসা নেওয়া যাবে।
বিকেপি/এমবি

