
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছে, যা আগামী ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে। এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের রপ্তানি খাত, বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত তিন মাস ধরে চলা আলোচনা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক কমানোর কোনো সমঝোতায় পৌঁছতে পারেনি বাংলাদেশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারস্পরিক শুল্ক চুক্তিতে চুক্তিতে সফলতা পেতে ব্যর্থ হওয়ার পেছনে ধীরগতির কৌশল, যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রহণযোগ্য শর্ত এবং লবিংয়ের অভাব মূল ভূমিকা পালন করেছে। এই শুল্ক বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি খাতের জন্য গুরুতর ঝুঁকি তৈরি করছে, যা দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি।
তবে, ৯-১০ জুলাইয়ের বৈঠক এবং পরবর্তী আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশ এখনো শুল্কহ্রাসের আশা করছে। সঠিক কৌশল এবং কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে বাংলাদেশ এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারে বলে আশা করা যায়। আর এই শুল্ক বহাল থাকলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পণ্যের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তিন মাসের টানা আলোচনা ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
সোমবার (৭ জুলাই) রাতে নিজের মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম 'ট্রুথ সোশ্যালে' একটি চিঠি পোস্ট করে তিনি এ ঘোষণা দেন। এতে বলা হয়, আগামী ১ আগস্ট থেকে নতুন এই শুল্ক কার্যকর হবে। এপ্রিলে প্রস্তাবিত ৩৭ শতাংশ থেকে সামান্য কমলেও, বিদ্যমান ১৫ শতাংশের তুলনায় এই হার দ্বিগুণেরও বেশি। এই সিদ্ধান্ত এমন এক সময়ে এলো, যখন বাংলাদেশ একটি সফল আলোচনার মাধ্যমে সংকট উত্তরণের আশায় ছিল।
দর-কষাকষির ব্যবচ্ছেদ
গত ২ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন প্রথম পারস্পরিক শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন, তখন বাংলাদেশ বেশ দ্রুততার সঙ্গে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল। তবে আলোচনার জন্য ৯০ দিনের শুদ্ধবিরতি পাওয়ার পরেই বাংলাদেশের কার্যক্রমে এক ধরনের ঢিলেঢালা ভাব চলে আসে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এই ব্যর্থতার পেছনে একাধিক কারণ চিহ্নিত করা যায়, সেগুলো হলো-
১. ওয়াশিংটনে থাকা বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা সরকারকে এমন বার্তা দিয়েছিলেন যে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান ২৬ জুনের বৈঠকের আগে সরকারকে আভাস দেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দর-কষাকষিতে বাংলাদেশ সবচেয়ে এগিয়ে আছে এবং ভিয়েতনামসহ কোনো দেশের পক্ষেই ৯ জুলাইয়ের আগে চুক্তি করা সম্ভব নয়। এমনকি ৩-৪ জুলাইয়ের দিকে ট্রাম্প প্রশাসন এই শুল্ক কার্যকরের সময়সীমা এক বছর পিছিয়ে দিতে পারে—এমন বার্তাও পায় ঢাকা। এই ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে আলোচনা চূড়ান্ত করতে তাড়াহুড়ো না করে ধীরগতিতে এগোনোর কৌশল নেয় বাংলাদেশ, যা চুড়ান্তভাবে বুমেরাং হয়েছে।
২. বাংলাদেশের প্রধান প্রতিযোগী ভিয়েতনাম, শুরুতেই সমস্ত মার্কিন পণ্যে শুভমুক্ত সুবিধা দেওয়ার মতো আকর্ষণীয় প্রস্তাব দিয়ে দর-কষাকবি শুরু করে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ ১০০টি মার্কিন পণ্যে শুদ্ধমুক্ত সুবিধা দেওয়ার ঘোষণা দিলেও, বাজেটের আগে সেই পণ্যের অলিকা যুক্তরাষ্ট্রকে সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়। উপরন্তু, নিজেরা কোনো আকর্ষণীয় প্রস্তাব না দিয়ে উল্টো যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তালিকা চায় ঢাকা, যা দর-কথাকষিতে বাংলাদেশকে দুর্বল অবস্থানে নিয়ে যায়।
৩. বাংলাদেশ আলোচনায় স্বল্পন্নত দেশ (এলডিসি) হিসেবে শুল্ক ছাড়ের সুবিধা দাবি করে। মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি (ইউএনটিআর) কর্মকর্তারা বিষয়টি বিবেচনার আশ্বাস দিলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ধরে নেন যে, ভিয়েতনামের মতো উন্নয়নশীল দেশের চেয়ে বাংলাদেশ কম শুল্কের সুবিধা পাবে। কিন্তু বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সাবেক সদস্য ড. মোস্তফা আবিদ খান বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র কখনোই এলডিসিগুলোকে বাড়তি কোনো সুবিধা দেয়নি। এবারও ব্যংলাদেশ ও মিয়ানমারের মতো এলডিসির ওপর ভিয়েতনাম, চীন, ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার মতো উন্নয়নশীল দেশের চেয়ে বেশি শুল্ক প্রস্তাব করা হয়েছে। তাই এলডিসি হিসেবে বাড়তি সুবিধা পাওয়ার আশা করা যৌক্তিক ছিল না।’
৪. যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে লবিস্ট ফার্মের প্রভাব অনস্বীকার্য। তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ'র পক্ষ থেকে ট্রাম্প প্রশাসন ঘনিষ্ঠ লবিস্ট ফার্ম নিয়োগের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। বিজিএমইএ-এর সাবেক সভাপতি এবং বাংলাদেশ চেম্বার ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, ‘আমরা বলেছিলাম, শুধু ইউএসটিআর কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে সফলতা আসবে না। কিন্তু সরকার সে ধরনের কোনো উদ্যোগ নেয়নি।’
চুক্তির কঠিন শর্ত এবং ডাব্লিউটিও নীতি
দর-কষাকষি ব্যর্থ হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হলো যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দেওয়া কিছু কঠিন শর্ত, যা বাংলাদেশের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। ইউএসটিআরের পাঠানো খসড়া চুক্তিতে এমন কিছু শর্ত ছিল, যা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডাব্লিউটিও) নীতির সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক।
- শর্ত এক : যুক্তরাষ্ট্র কোনো দেশের ওপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে বাংলাদেশকেও সেই দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে।
- শর্ত দুই : যুক্তরাষ্ট্রের যেসব পণ্যে বাংলাদেশ শুষ্ক ছাড় দেবে, সেই একই পণ্যে অন্য কোনো দেশকে ছাড় দেওয়া যাবে না। এটি ডাব্লিউটিও-এর মোস্ট ফেভার্ড ন্যাশন (এমএফ) নীতির সরাসরি লঙ্ঘন।
৩ জুলাইয়ের বৈঠকে বাংলাদেশ স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় যে, এই শর্তগুলো পালন করা সম্ভব নয় এবং ডাব্লিউটিও-এর নীতির মধ্যে থেকেই চুক্তি করতে চায়। এরপরও যুক্তরাষ্ট্র আলোচনায় সম্মতি দেওয়ায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ধরে নেন যে, ওয়াশিংটন হয়তো বাংলাদেশের প্রস্তাবে রাজি হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি।
অর্থনৈতিক প্রভাব ও বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ
যুক্তরাষ্ট্রের এই ৩৫ শতাংশ শুল্ক বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য, বিশেষ করে রপ্তানি খাতের জন্য একটি বড় আঘাত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাষের অধ্যাপক ও সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, এই হঠাৎ ও ব্যাপক শুল্ক বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ভারসাম্যপূর্ণ চুক্তিতে পৌঁছাতে ব্যর্থ হওয়া বৈশ্বিক বাণিজ্য বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি রুবানা হক এই পরিস্থিতিকে ‘বিপর্যয়কর’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ভিয়েতনাম যখন ২০ শতাংশ শুল্কে পোশাক রপ্তানি করবে, তখন আমাদের দিতে হবে ৩৫ শতাংশ। যদি এর সঙ্গে আগের ১৫-১৬ শতাংশ শুল্কও যুক্ত হয়, তাহলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে। সরকার কী আলোচনা করছে, আমরা তার কিছুই জানি না।
ড. মোস্তয়া আবিদ খানের মতে, এই শুল্ক হার কার্যকর হলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি ক্ষতিগ্রন্ত হবে, এটি নিশ্চিত। তিনি বলেন, ক্ষতির মাত্রা নির্ভর করবে মার্কিন ব্র্যান্ডগুলো কীভাবে তাদের অর্ডার অন্য দেশে স্থানান্তর করাবে, তার ওপর।
উল্লেখ্য, একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের প্রধান গন্তব্য। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে ৭ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যার ৮৭ শতাংশই তৈরি পোশাক।
শেষ মুহূর্তের চেষ্টা
এত কিছুর পরেও হাল ছাড়তে নারাজ বাংলাদেশ। আজ ৯ জুলাই (যুক্তরাষ্ট্র সময়) ওয়াশিংটনে ইউএসটিআরের সঙ্গে একটি চূড়ান্ত বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। এই বৈঠকে যোগ দিতে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। ঢাকা থেকে অনলাইনে যোগ দেবেন বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান।
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এখনো আশাবাদী। তিনি বলেন, ভিয়েতনামের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি ১২৫ বিলিয়ন ডলার, আর বাংলাদেশের সঙ্গে মাত্র ৫ মিলিয়ন ডলার (প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী)। এত কম ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও আমাদের ওপর বেশি শুদ্ধ আরোপের যৌক্তিকতা নেই। আমরা আশা করছি, ৯ তারিখের বৈঠকে তাদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা নিয়ে আলোচনা হবে এবং শুল্কহার কমে আসবে।
বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান জানিয়েছেন, ৩৫ শতাংশ শুষ্ক আরোপের চিঠির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র চুক্তির জন্য নতুন একটি ডকুমেন্ট পাঠিয়েছে। সেটি এখন পর্যালোচনা করে বৈঠকে আলোচনা করা হবে। যদিও তিনি স্বীকার করেছেন, একটা বড় চাপ দিয়ে এরপর আলোচনা আশা করিনি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বৈঠকটিই হয়তো বাংলাদেশের জন্য শেষ সুযোগ। তিন মাসের সুযোগ পেয়েও কৌশলগত ভুল ও ভুল তথ্যের ওপর নির্ভরতার কারণে বাংলাদেশ আজ এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। একদিকে ডাব্লিউটিও বিরোধী শর্ত মেনে নেওয়ার চাপ, অন্যদিকে ৩৫ শতাংশ শুল্কের খড়গ। এই উভয় সংকট থেকে দেশকে রক্ষা করার দায়িত্ব এখন ওয়াশিংটেনে থাকা বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের।
এই আলোচনা ব্যর্থ হলে তা দেশের রপ্তানি বাণিজ্যে এক দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, যা থেকে উত্তরণ সহজ হবে না। সমগ্র জাতি এখন ওয়াশিংটনের দিকেই তাকিয়ে আছে, একটি সম্মানজনক সমাধানের আশায়।
বিকেপি/এমএইচএস