নতুন যুগের ব্যাংকিংয়ে রূপালী ব্যাংক, ডিজিটাল রূপান্তরের অগ্রনায়ক
প্রকাশ: ২২ অক্টোবর ২০২৫, ১৫:৫৯
---2025-10-22T160356-68f8ac38116e9.jpg)
ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী মো. ওয়াহিদুল ইসলাম। ছবি : সংগৃহীত
দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে আধুনিকীকরণ, ডিজিটাল সেবা এবং গ্রাহক-অভিজ্ঞতায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে রূপালী ব্যাংক। প্রযুক্তিনির্ভর ব্যাংকিং, ঋণ পুনরুদ্ধার এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তি-এই তিনটি খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে ব্যাংকটি এগোচ্ছে ‘পরিবর্তনের পথে’।
নেতৃত্বের নবদিগন্ত
২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে দায়িত্ব গ্রহণ করা ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী মো. ওয়াহিদুল ইসলাম ব্যাংকটির রূপান্তর প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘২০২৫ সালকে আমরা ঘোষণা করেছি ‘‘ঋণডুবি উদ্ধার বছর’’ হিসেবে। আমাদের লক্ষ্য-প্রত্যেক নাগরিকের কাছে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দেওয়া এবং রূপালী ব্যাংককে ডিজিটাল উৎকর্ষের শীর্ষে নিয়ে যাওয়া।”’
তার নেতৃত্বে ব্যাংকটি একদিকে যেমন আর্থিক পুনর্গঠনে মনোযোগ দিচ্ছে, অন্যদিকে ‘ডিজিটাল ব্যাংকিং’ ও ‘ফিনান্সিয়াল ইনক্লুশন’-এর মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের ব্যাংকিং সংস্কৃতি গড়ে তুলছে।
ডিজিটাল বিপ্লবের নাম : রূপালী ক্যাশ
রূপালী ব্যাংকের ডিজিটাল যাত্রায় সবচেয়ে আলোচিত উদ্যোগ হচ্ছে ‘রূপালী ক্যাশ’। এটি ব্যাংকটির নিজস্ব মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস), যা সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে প্রথম সারির ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
গ্রাহকরা এখন ঘরে বসেই ই-কেওয়াইসি ভিত্তিক অ্যাকাউন্ট খুলে টাকা পাঠানো, বিল পরিশোধ, মোবাইল রিচার্জ, মার্চেন্ট পেমেন্ট, সরকারি ভাতা ও বেতন গ্রহণ—সব কিছুই করতে পারছেন একটি অ্যাপের মাধ্যমে। ফলে শহর থেকে গ্রাম—সব জায়গায় ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে গেছে, বাস্তবায়ন হয়েছে ‘হাতের মুঠোয় ব্যাংকিং’ ধারণা।
ব্যাংকের তথ্যমতে, ‘রূপালী ক্যাশ’ চালুর প্রথম ছয় মাসেই গ্রাহকসংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ এবং দৈনিক লেনদেন ১৫০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
সাইবার সুরক্ষা ও বিশ্বাসের কাঠামো
রূপালী ক্যাশ-এর প্রতিটি লেনদেন ব্যাংক-গ্রেড এনক্রিপশন ও উন্নত সাইবার সিকিউরিটি প্রোটোকল দ্বারা সুরক্ষিত। গ্রাহকরা পাচ্ছেন তাৎক্ষণিক লেনদেন নোটিফিকেশন, ২৪/৭ হেল্পলাইন ও ওটিপি-ভিত্তিক নিরাপত্তা যাচাই। ব্যাংকের নিজস্ব সাইবার মনিটরিং সেল সার্বক্ষণিকভাবে প্রতারণা ও অননুমোদিত অ্যাক্সেস প্রতিরোধে কাজ করছে।
ঋণ পুনরুদ্ধার ও আর্থিক স্থিতি
২০২৪ সালে রূপালী ব্যাংক বড় একটি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। ওই বছর ব্যাংকের মুনাফা আগের বছরের তুলনায় ৮২ শতাংশ কমে যায় এবং ১৫,৩৭৫ কোটি টাকা প্রভিশন ঘাটতি দেখা দেয়।
এই অবস্থায় ব্যাংকটি গঠন করে একটি বিশেষ ‘ঋণ পুনরুদ্ধার টাস্কফোর্স’, যার লক্ষ্য প্রায় ২২,০০০ কোটি টাকা পুনরুদ্ধার করা। ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ইতিমধ্যে প্রায় ৪,০০০ কোটি টাকা আদায় করা সম্ভব হয়েছে এবং বাকি অংশের জন্য চলছে আইনি ও পুনঃতফসিল প্রক্রিয়া। এই উদ্যোগ শুধু ব্যাংকের আর্থিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনবে না, বরং রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর জন্য একটি কার্যকর রিস্ক ম্যানেজমেন্ট মডেল হিসেবেও দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ব্যাংকিং : অন্তর্ভুক্তির বাস্তব রূপ
রূপালী ব্যাংক বরাবরই কৃষক, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, শ্রমজীবী ও নিম্নআয়ের মানুষের পাশে থেকেছে। এখন রূপালী ক্যাশ-এর মাধ্যমে সেই সেবাই এসেছে ডিজিটাল রূপে। গ্রামীণ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, দিনমজুর, জেলে, কৃষক—সবাই এখন মোবাইলেই ছোট অঙ্কের লেনদেন করতে পারছেন, যা আগে করতে হতো শাখায় গিয়ে, সময় ও খরচ ব্যয় করে।
এ উদ্যোগ সরাসরি সরকারের ‘স্মার্ট বাংলাদেশ ভিশন ২০৪১’-এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, কারণ এটি ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তিকে ত্বরান্বিত করছে।
উদ্যোক্তা উন্নয়ন ও এসএমই সহায়তা
রূপালী ব্যাংক বর্তমানে তরুণ ও নারী উদ্যোক্তাদের জন্য চালু করেছে বিশেষ ঋণ কর্মসূচি। ই-কমার্স, স্টার্টআপ এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা খাতে সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার পাশাপাশি চালু করা হয়েছে প্রতিটি আঞ্চলিক শাখায় এসএমই সাপোর্ট ডেস্ক।
ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘আমরা শুধু ঋণ দিচ্ছি না, প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দিচ্ছি—যাতে উদ্যোক্তারা টেকসইভাবে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারেন।’
ডিজিটাল শাখা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
রূপালী ব্যাংকের লক্ষ্য, আগামী দুই বছরের মধ্যে সকল শাখাকে সম্পূর্ণ ডিজিটালাইজ করা। প্রতিটি গ্রাহক যেন অনলাইন, মোবাইল বা রূপালী ক্যাশ অ্যাপের মাধ্যমে ২৪ ঘণ্টা ব্যাংকিং সেবা নিতে পারেন-এটাই ব্যাংকের পরবর্তী পদক্ষেপ।
এছাড়া ব্যাংকটি এআই-ভিত্তিক ক্রেডিট স্কোরিং, ডেটা অ্যানালিটিক্স এবং স্মার্ট কাস্টমার সাপোর্ট সিস্টেম চালুর প্রস্তুতি নিচ্ছে, যা ভবিষ্যতের ব্যাংকিং অভিজ্ঞতাকে আরও উন্নত করবে।
সামাজিক দায়বদ্ধতা ও গ্রাহকপ্রভাব
রূপালী ব্যাংক শুধু একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান নয়, বরং দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের সক্রিয় অংশীদার। ব্যাংকটি নিয়মিত অংশগ্রহণ করছে শিক্ষা, কৃষি, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে।
বিশেষ করে রূপালী ক্যাশ-এর মাধ্যমে সরকারি ভাতা, বৃত্তি এবং প্রবাসী আয় পৌঁছে দিচ্ছে সরাসরি গ্রাহকের মোবাইলে-মধ্যস্বত্বভোগীহীন, স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায়।
ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রচারণামূলক স্লোগান ‘আপনার ব্যাংকিং এখন সহজ, দ্রুত ও সবখানেই।’ এ বার্তাটি ইতোমধ্যে তরুণ গ্রাহকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। ডিজিটাল ব্যাংকিং, অনলাইন ট্রান্সফার ও ওয়ালেট সেবার কারণে রূপালী ব্যাংক আজ হয়ে উঠেছে ‘ঐতিহ্য ও প্রযুক্তির সেতুবন্ধন’।
ঐতিহ্য ও প্রযুক্তির যুগলবন্দি
চ্যালেঞ্জ এখনো আছে-ঋণ পুনরুদ্ধার, মুনাফা পুনরুদ্ধার এবং সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তবে রূপালী ব্যাংকের অগ্রযাত্রা স্পষ্ট: ঐতিহ্যের সঙ্গে প্রযুক্তি, দায়িত্বের সঙ্গে উদ্ভাবন। ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের নতুন যুগে রূপালী ব্যাংক এখন শুধু একটি প্রতিষ্ঠান নয়, বরং দেশের ব্যাংকিং খাতের এক উদ্ভাবনী অগ্রদূত।
- এমআই