পূবালী ব্যাংক : ঐতিহ্যের ধারায় আধুনিক ব্যাংকিংয়ের নবযাত্রা
প্রকাশ: ২২ অক্টোবর ২০২৫, ১৬:১৩
---2025-10-22T160919-68f8ae42c63af.jpg)
ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী। ছবি : সংগৃহীত
বাংলাদেশের বেসরকারি ব্যাংকিং খাতের ইতিহাসে ‘পূবালী ব্যাংক’ একটি অবিচ্ছেদ্য নাম-এটি ঐতিহ্য, আস্থা ও সেবার দীর্ঘ পথচলার প্রতীক। ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে এই ব্যাংক দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, শিল্পায়ন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (এসএমই) উন্নয়ন এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে।
ঐতিহ্যের সূচনা
পূবালী ব্যাংকের যাত্রা শুরু হয় ১৯৫৯ সালে, তৎকালীন ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেড নামে। স্বাধীনতার পর ১৯৭১ সালে এটি সরকার কর্তৃক জাতীয়করণ হয়ে ‘পূবালী ব্যাংক’ নামে পরিচিত হয়। পরে ১৯৮৩ সালে সরকারের বেসরকারিকরণ নীতির আওতায় এটি নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করে-একটি পূর্ণাঙ্গ বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক হিসেবে।
তখন হাতে গোনা কয়েকটি শাখা নিয়ে যাত্রা শুরু করা পূবালী ব্যাংক আজ ৫০০-এরও বেশি শাখা এবং শতাধিক উপশাখা নিয়ে দেশের অন্যতম বৃহৎ ব্যাংকিং নেটওয়ার্কে পরিণত হয়েছে। দীর্ঘ সময়ের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উত্থান-পতনের মাঝেও ব্যাংকটি তার সুনাম, স্থিতিশীলতা এবং গ্রাহক-আস্থার জায়গা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে।
ডিজিটাল যুগে নতুন অভিযাত্রা
একবিংশ শতকের ব্যাংকিং এখন আর শুধু শাখাভিত্তিক নয়, বরং প্রযুক্তিনির্ভর ও দ্রুতগতিসম্পন্ন। এই বাস্তবতা উপলব্ধি করেই পূবালী ব্যাংক সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রযুক্তিনির্ভর সেবায় বড় পদক্ষেপ নিয়েছে।
ব্যাংকটি চালু করেছে ‘পূবালী ডিজিটাল ব্যাংকিং’ নামের একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, যার মাধ্যমে গ্রাহকেরা ঘরে বসেই অ্যাকাউন্ট খোলা, অর্থ স্থানান্তর, বিল পরিশোধ, ক্রেডিট কার্ড ব্যবস্থাপনা, মোবাইল রিচার্জ ও অনলাইন লেনদেন করতে পারছেন।
একই সঙ্গে ‘পিবিএল ডিজি-ব্যাংক’ নামের মোবাইল অ্যাপও ব্যবহারকারীদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। বর্তমানে ব্যাংকটি স্মার্টফোন-ভিত্তিক লেনদেন, কিউআর কোড পেমেন্ট এবং ই-কে ওয়াইসি (ইলেকট্রনিক কেওয়াইসি) সেবা সম্প্রসারণে কাজ করছে।
নেতৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গি : মানবিক ব্যাংকিংয়ের প্রতিশ্রুতি
ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী মনে করেন, আধুনিক ব্যাংকিং শুধু হিসাব-নিকাশ নয়—এটি মানুষের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
তিনি বলেন, ‘ব্যাংকিং মানে কেবল অর্থ লেনদেন নয়, এটি আস্থা ও সম্পর্কের ব্যবসা। তাই আমরা প্রযুক্তিনির্ভর সেবা দেওয়ার পাশাপাশি মানবিক ব্যাংকিং নিশ্চিত করতেও কাজ করছি।’
তার মতে, আজকের গ্রাহক কেবল লেনদেন চান না, তারা চান দ্রুত, নিরাপদ এবং নিরবচ্ছিন্ন অভিজ্ঞতা। এই লক্ষ্যে পূবালী ব্যাংক একদিকে প্রযুক্তি উন্নয়নে, অন্যদিকে জনবলকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে নিয়মিত বিনিয়োগ করছে।
ব্যাংকের প্রতিটি শাখা এখন একটি ‘গ্রাহককেন্দ্রিক হাব’ হিসেবে কাজ করছে—যেখানে একসঙ্গে মিলছে ডিজিটাল সেবা, পরামর্শ এবং ঋণ সহায়তা।
আর্থিক স্থিতি ও প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা
২০২৪ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, পূবালী ব্যাংকের নিট মুনাফা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ১২ শতাংশ বেড়েছে। একই সঙ্গে ঋণ পুনরুদ্ধারের হারও উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হয়েছে।
বর্তমানে ব্যাংকটি করপোরেট ব্যাংকিংয়ের পাশাপাশি এসএমই, কৃষি ও খুচরা খাতে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে—যা দেশের গ্রামীণ ও প্রান্তিক অর্থনীতিতে নতুন প্রাণ সঞ্চার করছে।
সামাজিক দায়বদ্ধতায় ভূমিকা
পূবালী ব্যাংক শুধু একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান নয়, বরং সামাজিক দায়িত্ব পালনেও একটি অগ্রগামী সংস্থা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দুর্যোগ সহায়তা এবং নারী উদ্যোক্তা উন্নয়নে ব্যাংকটি নিয়মিতভাবে কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) কর্মসূচি পরিচালনা করছে।
বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তা ঋণ কর্মসূচি এবং কৃষিঋণ সহায়তা প্রকল্প ইতিমধ্যেই হাজারো ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও কৃষকের জীবনমান উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে।
ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘আমরা চাই না ব্যাংকিং সেবা শুধু শহরেই সীমাবদ্ধ থাকুক। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও পূবালী ব্যাংক পৌঁছে যাচ্ছে-এটাই আমাদের সামাজিক দায়িত্ব।’
চ্যালেঞ্জ ও আগামীর পরিকল্পনা
তবে ব্যাংকটির সামনে কিছু কাঠামোগত চ্যালেঞ্জও রয়েছে-বিশেষ করে ঋণ আদায় প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা, অনাদায়ী ঋণ হ্রাস এবং সাইবার নিরাপত্তা আরও জোরদার করা।
ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ আশাবাদী যে, উন্নত ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কাঠামো ও আধুনিক প্রযুক্তি বিনিয়োগের মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জগুলো সফলভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।
আগামী দিনে ব্যাংকটি এগিয়ে যাচ্ছে: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক গ্রাহক সেবা, শাখাহীন ব্যাংকিং (ভার্চুয়াল শাখা), এবং সম্পূর্ণ ডিজিটাল পরিবেশ (ইকোসিস্টেম) গঠনের লক্ষ্যে।
টেকসই ও মানবিক ব্যাংকিংয়ের পথে
পূবালী ব্যাংক আজ শুধু একটি ঐতিহ্যবাহী ব্যাংক নয়-এটি বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে স্থিতিশীলতা, উদ্ভাবন ও মানবিক সেবার প্রতীক। গ্রাহককেন্দ্রিক সেবা, প্রযুক্তিনির্ভর রূপান্তর এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা-এই তিন ভিত্তিকে সামনে রেখেই পূবালী ব্যাংক এগিয়ে যাচ্ছে ভবিষ্যতের টেকসই ও মানবিক ব্যাংকিংয়ের পথে।
- এমআই