উৎপাদন ও সেবা খাতের অধিকাংশ কোম্পানির ব্যবসায় হোঁচট
এম এম হাসান
প্রকাশ: ২৭ নভেম্বর ২০২৫, ১১:২৭
ব্যবসায়িকভাবে ভালো করতে পারছে না দেশের উৎপাদন ও সেবা খাতের কোম্পানিগুলো। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ২৪৩ কোম্পানির চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। ওই কোম্পানিগুলোর মধ্যে মাত্র ১২১টি কম-বেশি মুনাফা করেছে, বাকি ১৬৬টি কোম্পানির হয়তো মুনাফা কমেছে, নয়তো লোকসানা কিংবা উৎপাদন বন্ধ বা নেতিবাচক প্রভাবের কারণে আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে পারেনি।
আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আলোচিত সময়ে মুনাফায় থাকা ১২১ কোম্পানির সমন্বিতভাবে নিট মুনাফা হয়েছে ৪ হাজার ৮৪৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১০০ কোটি টাকার বেশি মুনাফা করা ১১ কোম্পানির মোট মুনাফা সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা বা ৭২ শতাংশ। তবে মুনাফায় থাকা কোম্পানিগুলোর মধ্যে ৫২টির মুনাফা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় কমেছে। এছাড়া লোকসান করেছে ৪৬ কোম্পানি। নির্ধারিত সময় পরও ৭৬ কোম্পানি লাভ-লোকসানের তথ্য প্রকাশ করেনি। এসব কোম্পানির পরিস্থিতিও ভালো নয়।
বিশ্লেষকদের মতে, ব্যবসায় প্রবৃদ্ধির গতি কমে যাওয়া, পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধি এবং ঋণ ও করখাতে চাপ বৃদ্ধির কারণে অধিকাংশ কোম্পানি ভালো মুনাফা তুলতে পারছে না। বড় কোম্পানিগুলো এখনো তুলনামূলক ভালো করছে, ছোটরাই বেশি হোঁচট খাচ্ছে।
এ বিষয়ে পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্সের সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল-আমিন বলেন, বেশিরভাগ কোম্পানির ব্যবসায় প্রবৃদ্ধি ভালো নয়। পরিচালন খরচ অনেক বেড়ে গেছে। কর এবং আর্থিক ব্যয়ের চাপ বেড়েছে। ফলে কোম্পানিগুলোর নিট মুনাফা মার্জিন সংকুচিত হয়েছে।
উৎপাদন ও সেবা খাতের বিবেচনায় যে খাতগুলো রয়েছে
তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে যেসব খাতের ব্যবসার চিত্র বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে সিমেন্ট, সিরামিক, প্রকৌশল, খাদ্য, বিদ্যুৎ-জ্বালানি, তথ্যপ্রযুক্তি, পাট, পেপার ও প্রিন্টিং, ওষুধ-রসায়ন, সেবা ও আবাসন, চামড়া, টেলিযোগাযোগ, বস্ত্র এবং ভ্রমণ ও অবকাশ খাতের কোম্পানি। শিল্প না হওয়ায় ব্যাংক, বিমা ও ব্যাংক-বহিভর্‚ত আর্থিক খাত, মিউচুয়াল ফান্ড ও বন্ডকে এ পর্যালোচনায় বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, দেশের বড় বড় করপোরেট শিল্পগোষ্ঠীভুক্ত কোম্পানিগুলোর ব্যবসাও খারাপ হয়ে গেছে। এসব করপোরেট শিল্পগোষ্ঠীর কোম্পানিগুলো আগের বছরের তুলনায় বেশি আয় করলেও মুনাফা কমেছে।
শত কোটি টাকার বেশি মুনাফা যেসব কোম্পানির
চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে শত কোটি টাকার বেশি মুনাফা করেছে ১১টি কোম্পানি। এগুলো হলো- গ্রামীণফোন (৭৫১ কোটি টাকা), স্কয়ার ফার্মা (৭৪০ কোটি), পাওয়ার গ্রিড (৩৬৪ কোটি), বিএটি বাংলাদেশ (৩০৫ কোটি), ওয়ালটন (২৪৩ কোটি), রবি (২৪১ কোটি), পদ্মা অয়েল (১৫৮ কোটি), মেঘনা পেট্রোলিয়াম (১৫৫ কোটি), ম্যারিকো বাংলাদেশ (১৫৪ কোটি), যমুনা অয়েল (১৪৮ কোটি), বিএসআরএম লিমিটেড (১২৪ কোটি) এবং লাফার্জ-হোলসিম ১২০ কোটি টাকা।
লোকসানে থাকা ১০ কোম্পানি মুনাফা
বড় অঙ্কের মুনাফা করা পাওয়ার গ্রিড গত বছর একই সময়ে ২৫৭ কোটি টাকা লোকসান করেছিল। ডেসকো ৩২ কোটি টাকা লোকসান থেকে ৫৮ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। এছাড়া রানার অটোমোবাইলস ৮ কোটি টাকা লোকসান থেকে ৪ কোটি টাকা, এসিআই লিমিটেড ৪২ কোটি টাকা লোকসান থেকে সাড়ে ৩ কোটি টাকা এবং আরএকে সিরামিক ১৫ কোটি টাকা লোকসানের বিপরীতে এবার আড়াই কোটি টাকা মুনাফা করেছে। একই ধারায় ছিল ইফাদ অটোস, আনোয়ার গ্যালভানাইজিং, বারাকা পাওয়ার।
যেসব কোম্পানির ইপিএস বেশি
জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে সর্বাধিক ৫২ টাকা ২২ পয়সা ইপিএস অর্জন করেছে রেকিট বেনকিজার। ৪৮ টাকা ৭৫ পয়সা ইপিএস নিয়ে পরের অবস্থানে ম্যারিকো। এছাড়া পদ্মা অয়েল ১৬ টাকা ০৪ পয়সা, মেঘনা পেট্রোলিয়াম ১৪ টাকা ২৯ পয়সা, যমুনা অয়েল ১৩ টাকা ৩৭ পয়সা, স্কয়ার ফার্মা ৮ টাকা ৩৫ পয়সা, ওয়ালটন ৭ টাকা ২৯ পয়সা, ইবনে সিনা ৭ টাকা ০৮ পয়সা, ফার্মা এইড ৬ টাকা ৮১ পয়সা, লিনডে বিডি ৬ টাকা ৪৮ পয়সা এবং রেনাটার ইপিএস ৬ টাকা ৪৭ পয়সা।
যেসব কোম্পানির লোকসান বেশি
শেয়ারপ্রতি আয়ে ২১ টাকা ১৯ পয়সা লোকসান নিয়ে শীর্ষে জিল বাংলা সুগার। এর পরে লোকসানে থাকা কোম্পানির অন্যতম মেঘনা সিমেন্ট ২১ টাকা ১৯ পয়সা, বাটা সুর ১০ টাকা ৫৬ পয়সা, বসুন্ধরা পেপারে ৬ টাকা ৬০ পয়সা, সিঙ্গার ৪ টাকা ৮১ পয়সা এবং তিতাস গ্যাস ২ টাকা ৫২ পয়সা লোকসান করেছে। ব্রোকারেজ হাউসগুলোর অন্যতম ব্র্যাক ইপিএলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আহসানুর রহমান বলেন, করপোরেট কাঠামো এবং টেকসই ব্যবসা কৌশলই বরাবরের মতো বড় কোম্পানিগুলোকে মুনাফায় এগিয়ে রাখে। বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ব্যবসা ঝুঁকি বিশ্লেষণ এবং তা মোকাবিলায় যথেষ্ট দক্ষ জনবল রাখে এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়। এজন্য তারা ভালো করে। আর ছোটরা পিছিয়ে পড়ে।

