Logo

শিক্ষা

কওমি মাদরাসায় কারিগরি শিক্ষা

শিক্ষা সংস্কার প্রস্তাবনা-১

Icon

লাবীব আব্দুল্লাহ

প্রকাশ: ২১ অক্টোবর ২০২৫, ১৩:১৯

কওমি মাদরাসায় কারিগরি শিক্ষা

এক.

আমি তখন একটি কওমি মাদরাসার নাযেমে দারুল ইকামা। এই দায়িত্বে ছিলাম এক যুগ। সঙ্গে ছিল নাযেমে তালিমাতের দায়িত্বও, যা দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে পালন করেছি। এই দায়িত্বের সূত্রে অভিভাবকগণ আমার কাছে তাদের ছেলেদের সমস্যাগুলো বলতেন এবং প্রয়োজনে পরামর্শ নিতেন। আমি আমার মতো করে সুপরামর্শ দেবার চেষ্টা করতাম। ইচ্ছে করে কখনো কুপরামর্শ দেইনি।

এই সূত্রে একবার এক শাইখুল হাদিস সাহেব এলেন। তাঁর ছেলেটি সব বিষয়েই চরমপন্থী। তিনি তাকে আমার কামরায় রাখার অনুরোধ করলেন। আমি আমার কামরায় কোনো তালেবে ইলম রাখা পছন্দ করি না। আমার উস্তায বলেছিলেন, তালেবে ইলমের থেকে কোনো খিদমত নেওয়া উচিত নয়। তখন আমি মাদরাসার একটি বড় কামরায় একা থাকতাম এবং আমার কাছে নানা বিষয়ের অনেক বই ছিল। তবুও সেই তালেবে ইলমের প্রতি বিশেষ নিগরানির দায়িত্ব নিলাম।

ছেলেটি দরসে ঠিকমতো থাকত না। থাকলেও পড়ত না। একদিন তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘তোমার কী ভালো লাগে?’’

সে বলল, ‘‘পড়া ভালো লাগে না, মোবাইল ভাঙা ভালো লাগে। কম্পিউটারের ভেতরে কী আছে, সেটা ভেঙে দেখতে ভালো লাগে।’’

আমি তাকে পড়ালেখার যত ওয়াজ-নসিহত করলাম, সব ব্যর্থ হলো। একদিন সে সামান্য পত্র লিখে পালিয়ে গেল। ছেলেটির নাম ছিল শাকির।

দুই.

দরসে ছিল একটি হাফেজ ছেলে। খুব মেধাবী। কম কথা বলত। তবে ক্লাসে ভালো পড়ালেখা করতে পারলেও পরীক্ষা ছাড়া সে পড়ত না। তখন সে ‘‘হেদায়েতুন্নাহু' পড়ছিল। আমি আরবি সাহিত্য পড়াতাম। ছেলেটি দরসে অমনোযোগী হয়েও পরীক্ষায় মেধা তালিকায় শীর্ষে থাকত। তার মুখে সর্বদা হাসি হাসি ভাব। চেহারা খুব মিষ্টি। তাকে বাড়তি কোনো বই পড়তে বললে সে বলল, ‘আমার পড়তে ভালো লাগে না’।’’ ‘‘তোমার কী করতে ভালো লাগে?’’ ‘‘যন্ত্রের ভেতরে কী আছে, সেটা দেখতে ভালো লাগে। মন চায়, আমি ইঞ্জিনিয়ার হতাম।’’

ছেলেটি বার্ষিক পরীক্ষা না দিয়েই চলে গেল এবং আর মাদরাসায় ফিরে এল না। ধরে নিলাম, ছেলেটির নাম সাজিদ।

তিন.

ঈদের আগে আমি জামা-কাপড় বানাতে আগ্রহী নই। দর্জিরা শেষ মুহূর্তে কাজ নিতে চায় না। আমি আমার স্ত্রীকে বলেছিলাম, আমার জামা সে-ই যেন বানিয়ে দেয়। বিবি সাহেবা আমার ছেলের মাধ্যমে দর্জির কাছে জামা-পায়জামা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আমাকে শুধু সেগুলো নিয়ে আসতে হবে।

বারবার তাগাদা দেওয়ার পর একদিন দর্জির দোকানে গেলাম।

দর্জি সাহেব বললেন, ‘‘উস্তায, কফি আনব?’’

 ‘‘কিছু আনতে হবে না।’’

 ‘‘দর্জিগিরি করে কী আয় করেছ?’’

 ‘‘জাংয়গা কিনে ফাউন্ডেশন দিয়ে বাসা করছি, উস্তায।’’

‘‘ঈদের আগে কত টাকা উপার্জন করলেন?’’

‘‘উস্তায, চার লাখ তো হবে। সারা বছরের আয় আসে দুই ঈদে।’’

দোকানটি খুব ছোট। কয়েকজন কারিগর কাজ করে। দর্জি সাহেব নিজে শুধু কাপড় কাটেন।

জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘আমার পাঞ্জাবির মজুরি কত?’’

 ‘‘যা মন চায় দেন। আমি সাড়ে তিনশ টাকা নিই। আপনি উস্তায, তিনশ টাকা দিলেই হবে। না দিলেও আমি খুশি।’’

আমি সাড়ে তিনশ টাকাই দিলাম। যেহেতু সে আমার কাছে কিতাব পড়েছে, তাই কম দিলে সে মনে মনে বলতে পারে, ‘‘হুজুররা কাজ করিয়ে আরাম নেয়, পয়সা কম দেয়।’’

সে মাদরাসায় ‘‘কাফিয়া’’ পড়ার পর পড়ালেখা বাদ দিয়ে দর্জিগিরি শুরু করে। তার নাম আল আমীন।

চার.

শাকির বর্তমানে কম্পিউটারের একটি দোকান দিয়েছে। এই রমজানে চিল্লা (ইতিকাফ) করেছে। পরিবারে আর্থিক সহযোগিতা করে। সে বিবাহিত। তার মেয়েরা মহিলা মাদরাসায় পড়ে। সংসারে ভালো আয় হয়। সাজিদ টুপি-পাঞ্জাবি গায়ে জড়িয়েই একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার পথে। নিয়মিত তারাবিহ পড়ে। কিতাবখানা থেকে ‘‘শরহে বেকায়া’’ পড়ার পর আর পড়েনি। আল আমীন এখন লাখপতি। তার ছেলেদের মাদরাসায় দিয়েছে।

এই তিনজন একই মাদরাসার তালেবে ইলম ছিল। এদের কেউ আলেম হয়নি, বা হতে পারেনি। তাদের অভিভাবকের ইচ্ছা থাকলেও তারা সে পথে যায়নি, বা যেতে পারেনি। তবে এই তিনজন হালাল উপার্জন করে পরিবারে সহযোগিতা করছে। নিজের ছেলেদের মাদরাসায় পড়াচ্ছে। হয়তো তারাই আলেম হবে। এটি আল্লাহর তাওফিক। তবে সবাইকে আলেম হতেই হবে, এমন কোনো জরুরি নিয়ম নেই। দীনদার হতে হবে। ফরজ পরিমাণ ইলম শিখতে হবে।

আমার ২৫ বছরের শিক্ষকতার জীবনে শত শত ছেলে পেয়েছি সাজিদ, শাকির ও আল আমীনের মতো- যারা কারিগরি জ্ঞানে আগ্রহী, কিন্তু কিতাবে অনাগ্রহী। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে ভেতরের টান।

আমি ব্যক্তিগতভাবে একটি বৈদ্যুতিক বাল্ব লাগাতেও অক্ষম এবং এজন্য কথাও শুনতে হয়। কম্পিউটার, ইঞ্জিনিয়ারিং বা দর্জিগিরির প্রতি আমার কোনো আগ্রহ নেই। আমি বই পড়ি এবং মনে হয়, অন্য সব কাজ আমার জন্য দুরূহ, দুর্বিষহ ও কঠিন। নিয়মিত বাজার করতেও আমার অনীহা। বাজারে গেলে মনে হয়, আমার পড়ার সময় নষ্ট হচ্ছে। আর আমি পণ্য কিনে প্রতারিত হই বারবার। তবে বই কিনতে আমি ওস্তাদ।

পাঁচ.

হাজার হাজার ছেলে কওমি মাদরাসায় ভর্তি হচ্ছে। সবাই আলেম হবে- এ চিন্তা ঠিক নয়। নানা কারণে অনেকেই আলেম হতে পারবে না। যারা মেধাবী এবং যাদের আগ্রহ আছে, তারাই আলেম হবে।

তবে যাদের আগ্রহ কারিগরি কাজের প্রতি, তাদের ফরজ পরিমাণ ইলম শিক্ষা দিয়ে দীনি পরিবেশে কারিগরি শিক্ষার আয়োজন করলে এটি একটি ভালো পদক্ষেপ হতে পারে। তবে কোনো এনজিও বা বিশেষ এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার হওয়ার জন্য কারিগরি শিক্ষার প্রয়োজন নেই কওমি মাদরাসায়।

মাদরাসার নিজস্ব উদ্যোগ ও আয়োজনে, দীনি মেজাজ ঠিক রেখে, কিতাবে অনাগ্রহী তালেবে ইলমদের জন্য বহুমুখী কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। প্রয়োজনে দীনদার দক্ষ কারিগর ও প্রযুক্তিবিদদের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে।

তথ্য-প্রযুক্তির যুগে কারিগরি বলতে আমি শুধু পুরনো দর্জিগিরির কথা বলছি না। এই কারিগরি জ্ঞান ব্যাপক। আউটসোর্সিংও এই প্রস্তাবনার অন্তর্ভুক্ত। মুদ্রণ শিল্পও একটি ক্ষেত্র। তালেবে ইলমদের এই বিষয়ে আগ্রহী করলে কিতাব-পত্র, দীনি বইপত্র ছাপানোর কাজে দীনদারদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। কৃষি, গরুর খামার, মৎস্য চাষ- এ জাতীয় কাজেরও প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে। তবে তা হবে দীনি মেজাজ রেখে।

মাদরাসা সব করতে পারবে না, তবে মাদরাসা উদ্যোগী হলে দীনদার মানুষের সহায়তা পাওয়া যাবে। এই সহায়তা আর্থিক ও কারিগরি উভয়ই হতে পারে। তবে মাদরাসার প্রধান দায়িত্ব এটি নয়। এর জন্য পৃথক ব্যবস্থাপনা থাকতে পারে।

এটি সব মাদরাসায় নয়। যেসব মাদরাসায় পর্যাপ্ত জায়গা-জমি আছে এবং অর্থ ও লোকবল আছে, তারাই উদ্যোগী হতে পারে। কোনো কোনো জামিয়া এই ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। কেউ ব্যর্থ, কেউ সফল। তবে সফলতা ও ব্যর্থতার ভেতর দিয়েই এগিয়ে যেতে হবে কওমি মাদরাসাকে। অন্যের সন্দেহজনক আর্থিক সহযোগিতা থেকে দূরে থেকে, নিজেরা হালাল উপার্জন করে তার একটি অংশ মাদরাসায় দান করলে সেই টাকায় বরকত হবে। সেই টাকায় মেধাবীরা পড়ালেখার সুযোগ পাবে। হারামখোরদের টাকা নিলে মাদরাসা রুহশূন্য হয়ে যেতে পারে, এবং তখন তা হবে বরকতহীন প্রসাধনের লাশ। আলেম হতে ইচ্ছুকদের হালাল খেতে হয়, হালালখোরদের সঙ্গে থাকতে হয়। কারিগরি শিক্ষা হতে পারে হালাল আয়ের একটি মাধ্যম।

লেখক : শিক্ষাবিদ, লেখক, গবেষক ও প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, ইবনে খালদুন ইনস্টিটিউট, ময়মনসিংহ

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

মাদরাসা শিক্ষা

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর