Logo

শিক্ষা

দ্বীনি মাদরাসা : অবদান, চ্যালেঞ্জ ও কর্মপন্থা

Icon

মুফতি আহমাদুল্লাহ মাসউদ

প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৭:৫৪

দ্বীনি মাদরাসা : অবদান, চ্যালেঞ্জ ও কর্মপন্থা

দ্বীনি মাদ্রাসাগুলোর বর্তমান ব্যবস্থা মূলত পারস্পরিক সহযোগিতা এবং সাধারণ জনগণের অবিরাম সমর্থনের ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এ ধারার সূচনা হয়েছিল ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমানদের পরাজয়ের পর। তখন মুসলিম নেতৃবৃন্দের মনে এ উপলব্ধি জাগে যে- ঔপনিবেশিক ইংরেজ সরকার স্বাধীনতার এই আন্দোলন নির্মমভাবে দমন করার পর রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, চিন্তাগত এবং শিক্ষাক্ষেত্রসহ বিভিন্ন অঙ্গনে যে ভয়াবহ আক্রমণ চালাবে, তার হাত থেকে মুসলমানদের ঈমান-আকীদা এবং শিক্ষা-সংস্কৃতিকে রক্ষা করার জন্য অবশ্যই কোনো সমষ্টিগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। এই লক্ষ্যেই প্রথমে দারুলউলূম দেওবন্দ, মাযাহিরুল উলূম সাহারানপুর ইত্যাদি মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। অল্প সময়ের মধ্যেই এই ধারা ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানজুড়ে ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে এবং এই ধারায় অসংখ্য দ্বীনি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়।

এই মাদ্রাসাগুলোর জন্য একটি মৌলিক নীতি নির্ধারণ করা হয়। তা হলো- কোনো সরকারি বা আধা-সরকারি সহায়তা গ্রহণ না করে, সম্পূর্ণ বেসরকারিভাবে মুসলিমদের থেকে ফান্ড রাইজিং করে এই মাদরাসাগুলো পরিচালনা হবে। আর ইতিহাস সাক্ষী যে, এই মাদরাসার সাথে সংশ্লিষ্ট আলেমগণ তাদের তুলনাহীন সাদামাটা জীবনধারা, অন্তহীন ত্যাগ, অদম্য ধৈর্য এবং গভীর কনাআতের মাধ্যমে উপমহাদেশের মুসলমান জনগোষ্ঠীর জন্য শুধু অসাধারণ দ্বীনী শিক্ষার ক্ষেত্রই প্রস্তুত করেনি। বরং বুদ্ধিবৃত্তিক, আধ্যাত্মিক ও সামাজিক সকল ক্ষেত্রে তারা অতুলনীয় অবদান রেখেছেন। এরা তাদের ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্য, আর্থিক সম্পদ এবং সামাজিক সুবিধা বিসর্জন দিয়ে ধর্মীয় সেবার মহত্ত্বকে সর্বাগ্রে স্থাপন করেছেন, যার ফলে আজও মুসলিম সমাজে দ্বীনি শিক্ষা-দীক্ষা, চিন্তা-চেতনা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান।

এই মাদ্রাসাগুলোর পরিচালনা পর্ষদ ও শিক্ষকদের বড় একটি অংশ ছিলেন এমন চরিত্রবান, ত্যাগী ও নি:স্বার্থ মানুষ। যারা চাইলে সময়ের স্রোতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দুনিয়াবি আরাম-আয়েশ ও সুবিধা ভোগ করতে পারতেন। বরং দুনিয়ার সকল সুযোগ-সুবিধা তো তাদের দরজায় জৌলুসের সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের মন কাড়ার চেষ্টা করত। তবু এই আত্মমর্যাদাবান, সাহসী এবং নি:স্বার্থ ব্যক্তিগণ, মুসলিমদের ঈমান-আকিদা, তাহযিব-তামাদ্দুন অক্ষুণ্ন রাখার মহান লক্ষ্যকে সামনে রেখে সেই সমস্ত আরাম-আয়েশকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেন।

তারা নিজেদের ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্য, আত্মসম্মান ও মর্যাদার দিকে না তাকিয়ে মাদ্রাসার কল্যাণার্থে সব ধরণের কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন। এমনকি মানুষের পক্ষ থেকে নানান ব্যঙ্গ-তাচ্ছিল্য, কটুক্তি ও উপহাসের সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও, অবিশ্বাস্য ধৈর্য, দৃঢ়তা ও সহনশীলতার সঙ্গে তারা এমন এক শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছেন, যা উপমহাদেশে আন্দালুসের ইতিহাস পুনরাবৃত্তি করার ব্রিটিশ স্বপ্ন ও ষড়যন্ত্রকে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ করে দেয়। অবশেষে, ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীও ১৯৪৭ সালে এই মাটিতে সেই স্বপ্ন পূরণে ব্যর্থ হয়ে, আফসোসের সাথে এখান থেকে গুটিয়ে যেতে বাধ্য হয়।

দ্বীনি মাদ্রাসাগুলোর সংগ্রামের ফলাফল ও অর্জনসমূহ বিবেচনায় নিয়ে যদি সমাজে এসব প্রতিষ্ঠানের সামষ্টিক ভূমিকা বিশ্লেষণ করা হয়, তাহলে সমস্ত ত্রæটি, সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতা সত্ত্বেও সামগ্রিক চিত্রটি প্রায় এ রকমভাবে দেখা যায়।

১। লর্ড ম্যাকেলে মুসলমানদের সন্তানদেরকে চিন্তাগতভাবে ইংরেজদের দাসে পরিণত করা এবং ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য তাদের পদলেহী শ্রেণী তৈরি করার লক্ষ্যে যে শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করেছিল, তা পর্যবসিত হয়। আর দ্বীনি মাদ্রাসাগুলো কালের পরিক্রমায় তার মোকাবিলায় এক শক্তিশালী ও অদম্য সমান্তরাল শিক্ষাব্যবস্থার রূপ ধারণ করে। ফলে যেসব সৎ ও সচেতন মুসলমান ইংরেজদের শিক্ষাব্যবস্থা ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির বিধ্বংসী প্রভাব থেকে নিজেদের দূরে রাখতে চেয়েছিলেন, মাদরাসাগুলো তাদের সামনে ঈমান-ইসলাম রক্ষার এক সুরক্ষিত দূর্গ হিসাবে গড়ে ওঠে।

২। আধুনিক বুদ্ধিবৃত্তি ও নব্য চিন্তাধারার ভিত্তিতে যখন ইসলামি আকীদা-বিশ্বাস পরিত্যাগের ধারা শুরু হলো এবং খতমে নবুওয়াত অস্বীকার, ইনকারে হাদিস, বিভিন্ন ধরণের বিদআত ও ফিতনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল, তখন এই দীনি মাদ্রাসাগুলো সম্পূর্ণ শক্তি নিয়ে তাদের সামনে অটল প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে গেল; এবং মুসলিম উম্মাহর সুপ্রতিষ্ঠিত আকীদা ও বিশ্বাসকে সুদৃঢ়ভাবে সংরক্ষণের ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে।

৩। ফিরিঙ্গি সভ্যতা ও ইউরোপীয় সংস্কৃতির ঝড়ে যখন মুসলিম পরিচয় ও সংস্কৃতি বিলীন হওয়ার উপক্রম, তখন এই মাদ্রাসাগুলো অন্তত একটি অংশকে রক্ষা করতে, সংরক্ষণ করতে এবং কার্যকর নমুনা হিসেবে টিকিয়ে রাখতে সফল হয়।

৪। মাদরাসাগুলো কুরআন-সুন্নাহর উলুম, আরবি ভাষা এবং দ্বীনি বিষয়াবলি পূর্ণ আমানতদারিতার সাথে সংরক্ষণ করার সাথে সাথে তা পরবর্তী প্রজন্ম পর্যন্ত হুবহু পৌঁছে দেওয়ার মহান দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়েছে।

৫। এই মাদরাসা ব্যবস্থাই উপমহদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে গতিশীল করার জন্য এমন সব সাহসী, নির্ভীক, মুখলিস ও দুরদর্শী নেতৃত্ব উপহার দিয়েছে, যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। যাদের মধ্যে ছিলেন: শাইখুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদ হাসান (রহ.), মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধি (রহ.), মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী (রহ.), মাওলানা আবুল কালাম আজাদ (রহ.), মাওলানা হাবীবুর রহমান লুধিয়ানভী (রহ.), আমীর-এ-শরিয়ত সায়্যিদ আতাউল্লাহ শাহ বুখারী (রহ.), মাওলানা সাইয়্যিদ মুহাম্মদ দাউদ গজনভী (রহ.) প্রমূখের মত বরেণ্য ব্যক্তিত্ত।

আর পাকিস্তান আন্দোলনকে উপহার দিয়েছে, আল্লামা শব্বীর আহমদ উসমানি (রহ.), মাওলানা জাফর আহমদ উসমানি (রহ.), মাওলানা আতহার আলী (রহ.), মাওলানা আবদুল হামিদ বদায়ূনী (রহ.) এবং মাওলানা মুহাম্মদ ইব্রাহিম সিয়ালকোটি (রহ.) এর মতো নির্ভীক, নিষ্ঠাবান ও সংগ্রামী নেতৃত্ব। তাঁদের ত্যাগ, কুরবানি ও নিরলস প্রচেষ্টা উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং পাকিস্তান আন্দোলন, উভয়টিকে সফলতার দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছিল।

৬। আফগানিস্তানের ইতিহাসে স্বাধীনতা ও স্বাধিকার রক্ষার যে ঝলমলে অধ্যায়গুলো লেখা হয়েছে, তার প্রতিটি পাতায় এই দ্বীনি মাদরাসার শিক্ষাপ্রাপ্ত আলেমদের সাহস, ত্যাগ ও অসীম আত্মমর্যাদার অমর স্বাক্ষর খোদাই রয়েছে। পাহাড়-পর্বতঘেরা সেই দুর্গম ভূখণ্ডে যখন রুশ সাম্রাজ্য লৌহমুষ্টি নিয়ে চেপে বসেছিল- যে শক্তি তখন বিশ্বের অর্ধেক মানচিত্র শাসনের স্বপ্ন দেখতো; ঠিক সেই সময় মাদরাসার দরবেশপোষাকে ঢাকা আলেমদের একটি অবিচল কাফেলা ইসলামের পতাকা হাতে নিয়ে ইতিহাসের ময়দানে অবতীর্ণ হয়। এই আলেমরাই ছিলেন আফগান জিহাদের মূল চালিকাশক্তি। তাদের কুরআন-সুন্নাহভিত্তিক চেতনা, ঈমানি দৃঢ়তা ও অনাড়ম্বর জীবনদর্শনই সাধারণ গ্রামবাসী, উপজাতি এবং যুবসমাজকে একটি অদম্য শক্তিতে রূপান্তরিত করেছিল। তাদের হাত ধরে সংগঠিত হয় মুজাহিদদের সে বীর সেনাদল, যারা পরাশক্তির অহংকার ভেঙে রুশ বাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করেছিল- এবং পৃথিবীকে দেখিয়ে দিয়েছিল, ‘আল্লাহর উপর ভরসাকারীরা সর্বদা অপরাজেয় হয়।’

রুশ বাহিনী অপমানজনক পরাজয় বরণ করে আফগানিস্তান থেকে সরে দাঁড়ানোর পর ইতিহাস থেমে থাকেনি। দ্বিতীয় দফায় যখন আমেরিকা তার প্রযুক্তি, ড্রোন, ডলার আর বিশ্বমঞ্চের প্রভাব নিয়ে আফগান ভূমিতে আগ্রাসন চালায়- তখনও সামনে এগিয়ে আসেন সেই পরিচিত চেহারাগুলো। মাদরাসাগুলোর চার দেয়ালে বেড়ে ওঠা, কুরআন-হাদিসে গড়া, তাকওয়া ও তাহারাতে দীপ্ত আলেমসমাজ। সামরিক প্রশিক্ষণ না থাকা সত্ত্বেও তাদের ঈমানি শক্তি, নেতৃত্বগুণ, আকাবিরদের থেকে প্রাপ্ত ফিরাসাত এবং জাতিকে সংগঠিত করার অসাধারণ ক্ষমতা এমন এক শক্তিতে রূপ নেয়, যা বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামরিক শক্তিকেও অবশেষে নতজানু হতে বাধ্য করে।

এটি নিছক কোনো রাজনৈতিক বিজয় ছিল না, বরং এটা ছিল একটি ঈমানি অঙ্গীকারের পূর্ণতা। আলেমদের নেতৃত্বেই দীর্ঘ দুই দশকের সংগ্রাম শেষে আফগান ভূমি আবারো মুক্ত হয়। দ্বীনি মাদরাসার সেই সন্তানরাই দেশের আইন-ব্যবস্থা, আদালত, শিক্ষা ও সামগ্রিক রাষ্ট্রদর্শনকে শরিয়তের ভিত্তিতে পুনর্গঠনে হাত লাগায়। তাদের দু:সাহসিকতা ও নেতৃত্বের কারণেই আজ আফগানিস্তান বহু শতাব্দী পর আবারো শরিয়তভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রসর হতে পেরেছে।

সর্বোপরি, দ্বীনি মাদ্রাসাগুলোর এই মহৎ সংগ্রাম এবং এর ফলাফল ইতিহাসের পাতায় এতই স্পষ্ট ও উজ্জ্বল যে কোনো বিবেকবান ও ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি তা অস্বীকার করতে পারে না। সত্য কথা হলো, ঔপনিবেশিক শাসনের দাপট, পাশ্চাত্য সংস্কৃতি-সভ্যতার আগ্রাসন এবং খ্রিস্টীয় বিশ্বাস ও শিক্ষার প্রচারের সময়ে এই মাদ্রাসাগুলোই মুসলিম চেতনা ও দ্বীনি আলোকধারার প্রতীক হয়ে সামনে উঠে আসে। ভয়াবহ অভাব-অনটনের মাঝেও তারা রাজনীতি, শিক্ষা, সমাজ, আকীদা এবং সংস্কৃতির প্রতিটি ক্ষেত্রে ইংরেজদের পাহাড়সম ষড়যন্ত্রের মোকাবিলায় অসাধারণ সাহসিকতা দেখিয়ে উপমহাদেশকে স্পেনের মতো পরিণতির হাত থেকে রক্ষা করেছে। নি:সন্দেহে, আজ এই ভূখণ্ডে ধর্মের প্রতি যে গভীর অনুরাগ এবং ইসলামের প্রতি যে দৃঢ় আনুগত্য যা বিশ্বকুফরি শক্তিগুলোকে শঙ্কিত করে রেখেছে, তার প্রধান ভিত্তিই হচ্ছে এই দ্বীনি মাদ্রাসার সৎ প্রচেষ্টা ও অক্লান্ত শ্রম।

তবে এখানেই শেষ কথা নয়। এখন আমাদের প্রয়োজন হলো এই চিত্রের অন্য দিকটিও একবার দেখা। সেসব প্রত্যাশা, আশা ও আস্থার কথাও স্মরণ করা দরকার, যেগুলোর অপূর্ণতার দায় উম্মাহর কল্যাণের দৃষ্টিকোণ থেকে এই মাদ্রাসাগুলোর সামষ্টিক নেতৃত্বের কাঁধে বর্তেছে এবং যেগুলো নিয়ে আজও মানসিক বেদনা ও আক্ষেপের কারণ।

এক্ষেত্রে আমরা মাত্র দুটি মৌলিক প্রশ্নের প্রেক্ষাপটে উক্ত বিষয়গুলো তুলে আনতে পারি।

এক. আধুনিক পাশ্চাত্য জীবনদর্শন ও দর্শনচিন্তার আগ্রাসী প্রভাব থেকে মুসলমানদের ঈমান, আকিদা ও মনস্তাত্ত্বিক কাঠামোকে সুরক্ষিত রাখতে দ্বীনি মাদরাসাগুলো কতটুকু ভূমিকা পালন করছে?

দুই. মুসলিম সমাজে ইসলামী জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য যে গভীর জ্ঞানভিত্তিক প্রস্তুতি, চিন্তাগত যোগ্যতা ও বৈজ্ঞানিক বোধ প্রয়োজন- সেগুলো গড়ে তোলার কাজে মাদরাসাগুলোর বর্তমান কার্যপদ্ধতি, দৃষ্টিভঙ্গি ও কৌশল কী এবং তা কতটা যুগোপযোগী?

প্রথম বিষয়: এক সময় গ্রিক দর্শন ইসলামি বিশ্বের ওপর ভয়াবহভাবে আক্রমণ চালিয়েছিল। বিশ্বাস ও মতাদর্শের জগতে এক অন্তহীন বিতর্ক এবং মানসিক দ্ব›েদ্বর ঝড় উঠেছিল। যদি সে সময় মুসলিম বিশ্বের শিক্ষাকেন্দ্র ও আলিমগণ এই গ্রিক ফালসাফার আক্রমণকে সাময়িক ঝড় ভেবে উপেক্ষা করতেন এবং কান-মুখ বন্ধ করে তার চলে যাওয়ার অপেক্ষায় বসে থাকতেন, তাহলে ইসলামি জ্ঞান-চিন্তা ও আকীদার সম্পূর্ণ কাঠামো গ্রিক ফালসাফার ভয়ংকর আঘাতে ধ্বংস হয়ে যেত। কিন্তু আলিমগণ সে সময় এমনটি করেননি। বরং তারা গ্রিক দর্শনের সেই চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করেছিলেন এবং নিজেদের ভাষা ও পদ্ধতিতে ইসলামি আকীদা ও মতাদর্শকে এমন দৃঢ় ও শক্তিশালীভাবে তুলে ধরেছিলেন যে, গ্রিক ফালসাফা আর তাদের সামনে দাঁড়াতে পারেনি।

সে সময় যে তাত্ত্বিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই চলেছিল, তার স্মৃতি আজও ইমাম আবুল হাসান আশ‘আরী (রহ.), ইমাম আবু মনসুর মাতুরিদী (রহ.), ইমাম রাযি (রহ.), ইমাম গাজ্জালী (রহ.), ইবনু রুশদ (রহ.) এবং ইবনু তায়মিয়্যা (রহ.)- এর রচনাবলীতে এক ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে সংরক্ষিত আছে।

আধুনিক ইউরোপের জীবনদর্শনের এই আক্রমণ আদতে গ্রিক দর্শনের আগ্রাসন থেকে খুব ভিন্ন কিছু নয়। এই নব্য দর্শন যা, ফরাসি বিপ্লবের মাধ্যমে স্বীকৃতি লাভ করে এবং পরবর্তীতে ইউরোপের বৈজ্ঞানিক ও শিল্প বিপ্লবের ছায়ায় ক্রমে বিস্তৃত হয়ে আজ বিশ্বের অধিকাংশ অঞ্চলকে গ্রাস করে নিয়েছে, নিজেকে সে মানবজীবনের সর্বব্যাপী একটি পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে উপস্থাপন করে। মানুষের সৃষ্টির উদ্দেশ্য থেকে শুরু করে সামাজিক জীবনের প্রয়োজনীয়তা এবং অতিপ্রাকৃত জগতের গভীর ও বিস্তৃত প্রশ্নসমূহ, সবকিছুকেই তার আলোচনার অন্তর্ভুক্ত করে।

ডারউইন, ফ্রয়েড, নীটশে এবং অন্যান্য পাশ্চাত্য দার্শনিক ও বিজ্ঞানীদের গত দুই শতাব্দী ধরে বিস্তৃত চিন্তাশ্রম ও নানা তাত্ত্বিক বিতর্কের সারমর্ম একথাই বলে যে, গির্জার অনাচার ও নির্যাতনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে যে জীবনদর্শনের জন্ম হয়েছিল, ইউরোপ সেটিকেই একটি পূর্ণাঙ্গ ‘জীবন দর্শন’ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছে। এই দর্শনের মাধ্যমে তারা বিশ্বের বিদ্যমান অন্যান্য সকল জীবনব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ পরাভূত করে নির্মূল করে দেওয়ার সংকল্পে অটল হয়ে উঠেছে। তা চাই ইসলাম হোক বা অন্য কোন আদর্শ।

দুর্ভাগ্যবশত আমরা ইউরোপের এই চিন্তাধারাগত আক্রমণের প্রকৃতি ও উদ্দেশ্যকে বোঝার চেষ্টা পর্যন্ত করি নি। আমরা এটিকে নিছক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ধারা হিসেবে বুঝে ঠিক সেইভাবে এর মোকাবিলা করেছি, এবং এর বুদ্ধিবৃত্তিক ও ঈমানি দিকগুলো সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করেছি।

মুসলিম বিশ্বে যখন গ্রিক দর্শন অনুপ্রবেশ করেছিল, তখন ‘আলমে ইসলামিতে’ নতুন নতুন আকিদা বিষয়ক বিতর্কের সূত্রপাত হয়, যেগুলোকে উম্মাহর বিদগ্ধ আলেমগণ তাদের ইলমি আলোচনায় সংযুক্ত করেছেন। ফলে আমাদের অনেক আকীদাহ-সংক্রান্ত গ্রন্থে আজও সেই পুরোনো বিতর্কগুলোই জায়গা করে আছে। এমনকি বর্তমান মাদরাসার পাঠ্যক্রমেও শিক্ষার্থীদের এমন সব তাত্ত্বিক আলোচনার সঙ্গে পরিচয় করানো হয়- যেগুলো মূলত গ্রিক দর্শনের সৃষ্টি এবং যেগুলোর বেশির ভাগই আজকের যুগের নতুন বুদ্ধিবৃত্তিক চাহিদা বা ঈমানি চ্যালেঞ্জগুলোর সঙ্গে বাস্তবে তেমন কোনো সম্পর্ক রাখে না।

কিন্তু ইউরোপের জীবনের দর্শন যে ঈমানি, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক বিতর্ক উত্থাপন করেছে, তার কোনো উল্লেখ আমাদের আকিদার গ্রন্থে নেই, এবং আমরা শিক্ষার্থীদেরও সেই বিতর্কের সঙ্গে পরিচয় করাই না।

ডারউইনের বিবর্তনবাদ, ফ্রয়েডের ধারণা অনুযায়ী মানুষের অস্তিত্বের উদ্দেশ্যে যৌন আকর্ষণের কেন্দ্রীয় গুরুত্ব, সামাজিক জীবনে ধর্মের সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকতা এবং সীমাহীন বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতার ডাক- এগুলো কি আকিদাগত বিতর্ক নয়?

ভাবুন তো, এইসব নতুন চিন্তা ও দর্শন লালনকারী আজ বহু মানুষ রয়েছে, যারা নিজেদের মুসলমান বলে পরিচয় দেন, তারা কি ইসলামের সামগ্রিক সামাজিক ভূমিকা সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়েনি? কিংবা অন্তত দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছে না?

এখান থেকেই আসে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়: এই ঈমানি বিভ্রান্তি রোধে আমাদের মাদ্রাসাগুলোর ভূমিকা কী? আমাদের মাদ্রাসার পাঠ্যক্রমে যে তাফসির, হাদিস, ফিকহ ও আকিদার কিতাব পড়ানো হয়, সেখানে কি এই আধুনিক বিভ্রান্তিগুলোর আলোচনা-পর্যালোচনা আছে? আমরা কি আমাদের শিক্ষার্থীদের এই নতুন চিন্তাগুলোর সঙ্গে পরিচিত করছি এবং তাদের যুক্তিসঙ্গত, প্রমাণভিত্তিক জবাব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত করছি?

এই প্রশ্নগুলো আজ সময়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।

এগুলো কেবল আলোচনার বিষয় নয়, বরং পুরো মুসলিম সমাজ এবং নতুন প্রজন্মের কল্যাণে মাদ্রাসার সমষ্টিগত নেতৃত্বের এক গুরুদায়িত্ব ও অপরিহার্য কর্তব্য। এই প্রশ্নগুলো মোকাবিলা করা তাদের জন্য কোনো ঐচ্ছিক কাজ নয়; বরং সময়ের দাবি, উম্মাহর প্রত্যাশা এবং দীনকে সুরক্ষিত রাখার একটি গুরুতর আমানত, যেটি এড়িয়ে গেলে দায়িত্ব পালনের দাবি কখনো পূরণ হবে না। এই প্রশ্নগুলোর সরাসরি মোকাবিলা ছাড়া মাদ্রাসাগুলো তাদের দায়িত্ব পূর্ণাঙ্গভাবে পালন করছে- এ কথা বলা কঠিন। বেদনাদায়ক বিষয় হলো, আমাদের দেশে তুচ্ছ ও আংশিক বিষয়গুলো এমনভাবে প্রাধান্য পেয়েছে যে, চিন্তা ও ঈমানের জগতে মূল ভিত্তি হিসেবে গণ্য হওয়া বিষয়গুলোর কোনো গুরুত্বই আমাদের কাছে বাকি নেই। আমাদের পছন্দ-অপছন্দ এবং আনুগত্য-অবজ্ঞার মানদণ্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে আংশিক বিষয় ও দলীয় পক্ষপাত।

দ্বিতীয় বিষয়: ইসলামকে একটি কার্যকরী রাষ্ট্র ব্যবস্থা হিসেবে প্রয়োগ করার জন্য যে জ্ঞানগত ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, সেই চাহিদা পূরণে আমাদের মাদ্রাসাগুলোর ভূমিকা কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ? ইসলামের কার্যকর প্রয়োগের গুরুত্ব এমন এক সত্য, যা কোনো মুসলিম অস্বীকার করতে পারে না। আহলে সুন্নাহর আলেমগণ এটিকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্যের মধ্যে গণ্য করেছেন। ইবনে হাজার মক্কী এবং অন্যান্য প্রখ্যাত ইমামরা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, ইসলামি নেজাম কার্যকর করার জন্য খিলাফত প্রতিষ্ঠা ‘আহম্মুল ওয়াজিবাত’- সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত, যা সাহাবাগণ নবি করিম (সা.)-এর দাফনের আগে অগ্রাধিকার দিয়ে সম্পন্ন করেছিলেন। নবিজির জানাজা ও দাফনের পূর্বেই হজরত আবুবকর (রাযি.)- কে খলিফা হিসেবে নির্বাচিত করা হয়, যা ইসলামের ইজতেমায়ি কাঠামো রক্ষায় তাদের সচেতনতা ও দায়িত্ববোধের অনন্য নিদর্শন।

উপমহাদেশে আমাদের পূর্বপুরুষদের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল লক্ষ্যও কেবল রাজনৈতিক মুক্তি নয়, বরং সেই মুক্তির পর ইসলামি নেজাম প্রতিষ্ঠা ও প্রয়োগ করা। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাও ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মদুর রসূলুল্লাহ’ শ্লোগান ও ইসলামের প্রতিষ্ঠার জন্য বাস্তবায়িত হয়েছিল।

কিন্তু আমাদের মাদ্রাসাগুলোতে ব্যাপকভাবে ইসলামকে একটি সামাজিক ও সার্বজনীন বিষয় হিসেবে পড়ানো হয় না, এবং সাধারণত শিক্ষার্থীদেরও এমনভাবে প্রস্তুত করা হয় না, যাতে তারা ইসলামের অধ্যয়নকে একটি পূর্ণাঙ্গ নেজাম হিসেবে গ্রহণ করে। অথচ হাদিস ও ফিকহের অধিকাংশ গ্রন্থ এমনভাবে রচিত হয়েছে যে, তাতে সামাজিক জীবনের সকল শাখা আলাদা আলাদা অধ্যায় হিসেবে বিবৃত হয়েছে।

ঈমান-আকীদা, ইবাদতের পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্য, খিলাফত, জিহাদ, অন্যান্য জাতির সঙ্গে সম্পর্ক, শিল্প, জমিদারি, হুদুদ ও তাজিরাত, কার্যবিধি, বিচারব্যবস্থা, সমাজ এবং অন্যান্য সামাজিক শাখার ব্যাপারে হাদিস ও ফিকহের গ্রন্থে বিস্তৃত ও সমন্বিত অধ্যায় রয়েছে। এই অধ্যায়গুলোতে মুহাদ্দিস এবং ফকিহরা বহু বিধিমালা ও নির্দেশাবলী সংকলন করেছেন।

আর এই অধ্যায়গুলো শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের আগ্রহ প্রায় শূন্যের কোঠায়। 

বিপদজনক বিষয় হলো, হাদিসের কিতাবাদিতে মাদরাসার শিক্ষকদের তাকরির ও শরাহ মূলত কেবল নির্ধারিত কিছু অধ্যায়েই সীমাবদ্ধ থাকে। (ব্যতিক্রম কিছু মাদরসা আছে যাতে যথাযত ভাবে উক্ত বিষয়গুলোও পাঠদান করা হয়, কিন্তু এই ধরণের প্রতিষ্ঠান হাতেগোনা কয়েকটি মাত্র) অথচ খিলাফত ও আমিরাত, ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প, জিহাদ, হুদুদ ও তাজিরাত এবং সামাজিক জীবনের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে গুরুত্বের সাথে পাঠদান করা সময়ের দাবি। যদিও প্রয়োজন ছিল যে, সামাজিক ও রাষ্ট্রিয় জীবনের সাথে সম্পর্কিত অধ্যায়গুলো আরও গুরুত্বের সাথে পড়ানো হবে। আইন, রাজনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, যুদ্ধ এবং সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা ও তত্ত্বগুলোর সাথে ইসলামি শিক্ষার তুলনা করে শিক্ষার্থীদের মনে ইসলামি বিধানের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করা হবে এবং তাদেরকে ইসলামী চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির সুরক্ষা ও এর বাস্তব প্রচারের জন্য প্রস্তুত করা হবে। কিন্তু তা হয়ে উঠেনি। বরং এই গুরুত্বপূর্ণ দ্বীনি ও জাতীয় প্রয়োজনকে আমলে নেয়া হয়নি। ফলে, আমাদের মাদ্রাসা থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে বের হওয়া আলেমদের বিরাট একটা অংশ ইসলামি নেজাম সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াবিহাল নয়। আধুনিক ধারণা ও তত্ত্বগুলো বুঝে তা ইসলামি বিধানের সাথে তুলনা করার সামর্থ্য থেকেও বঞ্চিত। এটি একটি বাস্তবতা- যা স্বীকার না করার কোনো উপায় নেই। বরং এটি মেনে নিয়ে এর বিকল্প সমাধান বের করা জরুরি।

এমনিভাবে ইসলামি নেজাম পরিচালনার জন্য যোগ্য ব্যক্তিবর্গেরও অভাব রয়েছে মাদরাসাগুলোতে, যা অনুপাত প্রয়োজনীয়তার তুলনায় অত্যন্ত কম। এর কারণ কী? আর এই শূন্যস্থান শেষ পর্যন্ত কে পূরণ করবে? যে শিক্ষাব্যবস্থাকে আমরা লর্ড ম্যাকেলের শিক্ষাব্যবস্থা বলি, তা থেকে আশা করা অবান্তর যে, এটি ইসলামি নেজামের জন্য উপযুক্ত কর্মী সরবরাহ করবে। আর যদি দ্বীনি শিক্ষাব্যবস্থা এই প্রয়োজন মেটাতে না পারে, তাহলে ইসলামি নেজাম কার্যকর করার ব্যক্তিবর্গ কোত্থেকে আসবে?

শিক্ষক : জামিয়া নুরিয়া ইসলামিয়া, কামরাঙ্গিরচর, ঢাকা।

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

মাদরাসা শিক্ষা

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর