Logo

শিক্ষা

কওমি মাদরাসার একাল সেকাল

Icon

শফিকুল মুহাম্মদ ইসলাম

প্রকাশ: ০৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:২৪

কওমি মাদরাসার একাল সেকাল

বাংলাদেশের ধর্মীয়, নৈতিক ও সাংস্কৃতিক শিক্ষার অন্যতম প্রধান ভিত্তি হলো মাদরাসা শিক্ষা। বাংলার গ্রাম, শহর, জনপদ এবং মানুষের ভাবধারায় ইসলামি শিক্ষার প্রবাহ যে কতটা গভীর, তার বড় প্রমাণ হলো দেশের হাজার হাজার মাদরাসা, হিফজখানা ও মক্তব। দীর্ঘ ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় এই শিক্ষাব্যবস্থা শুধু ধর্মীয় জ্ঞানই দেয় না; বরং একজন মানুষের চরিত্র গঠন, নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টি, দায়িত্ববোধ তৈরি এবং সমাজ সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার কাজও করে থাকে। মাদরাসা শিক্ষা আগে কেমন ছিল, এখন কেমন হয়েছে- এর মধ্যকার পার্থক্য শুধু সময়গত পরিবর্তন নয়; বরং সমাজ, প্রযুক্তি, অর্থনীতি ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো; সবকিছুর প্রভাব এতে প্রতিফলিত হয়েছে।

অতীতে মাদরাসা ছিল অত্যন্ত সরল-নিরহংকার পরিবেশে পরিচালিত। কাঠের বেঞ্চ, পাটের চট, টিনের ঘর, বেতখাতার মতো জিনিসপত্রই ছিল পড়াশোনার প্রধান উপকরণ। কিন্তু সেই সীমিত পরিবেশেও জ্ঞান শেখানোর আন্তরিকতা ছিল অসীম। আজকের দিনে অবকাঠামোর উন্নয়ন, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ এবং আধুনিক উপকরণের ব্যবহারে মাদরাসা শিক্ষা আরও সুসংগঠিত হয়ে উঠেছে। তবে এই পরিবর্তনের মধ্যেও যে বিষয়টি স্থায়ী। তা হলো মাদরাসার মূল লক্ষ্য: আল্লাহভীরু, নৈতিক, সৎ ও মানবিক মানুষ তৈরি করা।

এই প্রবন্ধে মাদরাসা শিক্ষার অতীত ও বর্তমান- উভয় দিক তুলে ধরা হলো সহজ ভাষায়, বোধগম্য আকারে এবং অভিজ্ঞতার আলোয়।

১. কওমি মাদরাসা

কওমি মাদরাসা বাংলাদেশের ইসলামি শিক্ষায় সবচেয়ে বিস্তৃত ও ঐতিহ্যবাহী ধারা। এর জন্ম ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতীয় উপমহাদেশে, বিশেষ করে দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে। সেই চিন্তা ধারাই পরবর্তীতে বাংলার কওমি মাদরাসাগুলোয় ছড়িয়ে পড়ে। কওমি মাদরাসার বৈশিষ্ট্য হলো- এটি রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ ছাড়া স্বতন্ত্রভাবে পরিচালিত হয় এবং মূলত কোরআন, হাদিস, ফিকহ, আরবি ব্যাকরণ, উচ্চতর ইসলামি গবেষণা- এই বিষয়গুলো শেখানো হয়।

গ্রাম থেকে শহর- বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলে কওমি মাদরাসার উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। দরিদ্র, মধ্যবিত্ত, এমনকি সচ্ছল পরিবারেও শিশুদের নৈতিক শিক্ষা, ইসলামি শিষ্টাচার ও ধর্মীয় জ্ঞান শেখাতে অভিভাবকরা কওমি মাদরাসা বেছে নেন। এখানকার পাঠ্যক্রমের সবচেয়ে কঠিন ধাপ হলো দাওরায়ে হাদিস, যা বর্তমানে মাস্টার্স সমমান স্বীকৃতি অর্জন করেছে। এই দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করা একজন শিক্ষার্থী সমাজে ধর্মীয় নেতৃত্ব, ইমামতি, গবেষণা, দাওয়াতি কাজ বা শিক্ষকতার উচ্চতর ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হন।

কওমি মাদরাসার একটি বিশেষ শক্তি হলো- এটি দান, ওয়াকফ ও আন্ত রিক মানুষের সহযোগিতায় পরিচালিত হয়। ফলে আর্থিকভাবে সুবিধাবঞ্চিত শিশুরাও এই ব্যবস্থার মাধ্যমে উচ্চতর শিক্ষার সুযোগ পায়। এই কাঠামোই কওমি মাদরাসাকে সমাজের কাছে একটি সম্মানজনক ও আস্থাভাজন প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

২. শিক্ষকদের প্রাথমিক শিক্ষাদান

বাংলার গ্রামীণ সমাজে হুজুরদের প্রাথমিক শিক্ষাদান একটি দীর্ঘ ঐতিহ্য। আগে যখন আধুনিক স্কুল ছিল না বা খুব সীমিত ছিল, তখন গ্রামবাসী তাদের সন্তানদের হাতে প্রথম বই তুলে দিতে নিয়ে যেতেন মসজিদের হুজুরের কাছে। তিনি শিশুদের নামাজ শিক্ষা, কালেমা, দোয়া, নৈতিকতা এবং অক্ষরজ্ঞান শেখাতেন বিনা স্বার্থে ও নিবেদিত মনোভাব নিয়ে।

শিশুদের চরিত্র গঠনের সবচেয়ে উপযুক্ত সময় হলো শৈশব। হুজুররা সেই বয়সেই আদব-কায়দা, বড়দের সম্মান করা, শিষ্টাচার, সত্য বলা, সৎ থাকা- এসব শিক্ষার ভিত গড়ে দিতেন। যেহেতু তাঁরা সমাজে আলোকিত মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তাই তাঁদের কথার গুরুত্ব গ্রামে-গঞ্জে ছিল অনেক বেশি।

বর্তমান সময়েও হুজুরদের প্রাথমিক শিক্ষাদান বন্ধ হয়নি। বরং নতুনভাবে মক্তব ও শিশুশিক্ষা কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। তবে আগে যেখানে পরিবেশ ছিল সম্পূর্ণ ধর্মীয়, এখন সেখানে শিক্ষায় যোগ হয়েছে মৌলিক ইংরেজি, গণিত ও বাংলা পাঠ। ফলে শিশুরা ধর্মীয় ভিত্তি ও পার্থিব জ্ঞান- দুটিই প্রাথমিক পর্যায়ে পেয়ে থাকে। এই শিক্ষাদান শুধু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নয়; সামাজিক ও নৈতিক উন্নয়নের দিক থেকেও অত্যন্ত  গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সমাজে সৎ, দায়িত্বশীল ও আদর্শবান নাগরিক তৈরি করতে শৈশবের শিক্ষাই সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকা রাখে।

৩. কায়দা পড়া

প্রাথমিক ইসলামি শিক্ষার প্রথম ধাপ হলো কায়দা পড়া। এতে মূলত আরবি বর্ণমালা, হরফের উচ্চারণ, মাখরাজ, হরকের ব্যবহার- এসব মৌলিক বিষয় শেখানো হয়। আগে এই কায়দা ছিল হাতে লেখা কাঠের বোর্ডে বা পাতলা কাগজে ছাপানো, যা বাচ্চারা বগলে রেখে পড়তে যেত। হুজুররা ধৈর্য ধরে প্রতিটি বর্ণের উচ্চারণ বারবার শোনাতেন, কারণ সঠিক উচ্চারণই পরবর্তীতে কোরআন পড়ার ভিত্তি।

শিশুরা প্রায় ছয় মাস থেকে এক বছর কায়দা পড়ায় ব্যস্ত থাকে। শুরুতে “আলিফ, বা, তা...” এর মতো অক্ষর শেখার মধ্য দিয়ে তারা আরবি ভাষার জগতে প্রবেশ করে। যতই অগ্রগতি হয়, কায়দায় জটিলতা বাড়ে- মদ্দ, গুণাহ, ইখফা, ইযহার এসব তাজবীদ নিয়ম শেখানো হয় খুব সাবধানে। আগে কায়দা পড়াসহ শিক্ষার পরিবেশ ছিল কঠোর ও নিয়মমাফিক, কিন্তু এখন শিশুদের মনোযোগ ধরে রাখতে বিভিন্ন রঙিন কায়দা বই, ছবি, ফনেটিক উচ্চারণ- এসব ব্যবহার করা হয়। এতে শেখা দ্রুত ও আকর্ষণীয় হয়। কায়দা পড়া সাধারণ মানুষ হয়তো খুব সাধারণ বিষয় মনে করতে পারে, কিন্তু আসলে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। যাদের কায়দা দুর্বল থাকে, তারা পরবর্তীতে কোরআন পড়ায় সমস্যায় পড়ে। তাই মাদরাসায় কায়দা পড়া অত্যন্ত  গুরুত্ব দিয়ে শেখানো হয়।

৪. আমপাড়া শিক্ষা

কায়দা পড়া শেষ হওয়ার পর শিশুদের পরবর্তী ধাপ হলো আমপাড়া। এতে কোরআনের শেষ ৩০ পারার ছোট ছোট সূরাগুলো শেখানো হয়। প্রথমে মুখস্থ, পরে শুদ্ধভাবে তিলাওয়াত- এই দুই ধাপেই শিশুদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ছোট বয়সে মুখস্থ করার ক্ষমতা বেশি থাকে বলেই এই পর্যায়ে বাচ্চাদের দ্রুত অগ্রগতি দেখা যায়।

আগে গ্রামের মসজিদে বা ঘরের বারান্দায় চাটাই পেতে বসিয়ে আমপাড়া শেখানো হতো। শিক্ষকরা বারবার উচ্চারণ করে শুনাতেন, বাচ্চারা পুনরাবৃত্তি করত। শিক্ষার এই পদ্ধতি ছিল খুবই মানবিক ও ধৈর্যনির্ভর।

আজকের আমপাড়া শিক্ষা আরও বিস্তৃত হয়েছে। রঙিন আমপাড়া বই, সহজ ব্যাখ্যা, তাজবীদের চিহ্ন- এসবের সংযোজন শেখার প্রক্রিয়াকে সহজ করেছে। অনেক মাদরাসায় ছোট ছোট পুরস্কার, উৎসাহ প্রদান এবং দলগত মুখস্থ প্রতিযোগিতা- এসবও শিশুদের আগ্রহ বাড়ায়। আমপাড়ার শিক্ষা শুধু নামাজের সূরা মুখস্থ করার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি ধর্মীয় অনুভূতি, আল্লাহর প্রতি ভক্তি এবং দৈনন্দিন আমলের ভিত্তি তৈরি করে। ছোটবেলা যে শিশু “ইন্না আতয়না কাল কাওসার” বা “ইখলাস” সূরা শিখে, তার অন্ত রে আল্লাহর প্রতি একটি কোমল অনুভূতি তৈরি হয়- যা নৈতিক চরিত্র গঠনের পাথেয় হয়ে থাকে।

৫. কোরআন শিক্ষা

কোরআন শিক্ষা হলো ইসলামি শিক্ষার মূল স্তম্ভ। কায়দা ও আমপাড়া শেষ করার পর শিশু আনুষ্ঠানিকভাবে পুরো কোরআন তিলাওয়াত শেখার ধাপে প্রবেশ করে। আগে গ্রামের মসজিদে বা টিনশেড মাদরাসায় শিক্ষকরা হাতে লাঠি ধরে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ ধরে রাখতেন, তবে উদ্দেশ্য ছিল শুদ্ধ তিলাওয়াত নিশ্চিত করা। কোরআন শেখার প্রধান বিষয় হলো- তাজবীদ, শুদ্ধ মাখরাজ, দীর্ঘ-হরেক পড়ার নিয়ম এবং সুরেলা তিলাওয়াতের শিল্প। অতীতে শেখানোর পদ্ধতি ছিল মুখে মুখে শিক্ষা- শিক্ষক পড়তেন, ছাত্র অনুসরণ করত।

বর্তমান সময়ে কোরআন শিক্ষার পরিবেশ অনেক বদলেছে। আধুনিক মাদরাসায় রেকর্ডিং ডিভাইস, মাইক্রোফোন, ভিডিও টিউটোরিয়াল- এসবের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা আন্ত র্জাতিক তিলাওয়াতকারীদের কণ্ঠ শুনে অনুশীলন করতে পারে। অনেক শিক্ষার্থী হিফজ না করেও সুন্দর তিলাওয়াত শেখে। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে কোরআন শিক্ষার জন্য আলাদা কোরআন ইনস্টিটিউট ছড়িয়ে পড়েছে।

তবে যেটি অপরিবর্তিত রয়েছে- তা হলো কোরআন শিক্ষার আধ্যাত্মিক রূপ। একজন শিক্ষার্থী আল্লাহর কালাম পড়তে শিখলে তার অন্তরে শান্তি, বিশ্বাস, আনুগত্য ও নৈতিকতার আলো জন্মায়। কোরআন শিক্ষা শুধু নামাজ পড়ার জন্য নয়; বরং চরিত্র গঠনের অন্যতম মূল ভিত্তি। তাই যুগ বদলেছে, পরিবেশ বদলেছে, প্রযুক্তি এসেছে- কিন্তু কোরআন শিক্ষার গুরুত্ব কখনোই কমেনি, বরং সময়ের সাথে আরও বর্ধিত হয়েছে।

৬. হিফজখানা

হিফজখানা বাংলাদেশে ইসলামি শিক্ষার সবচেয়ে কঠিন ও মর্যাদাপূর্ণ ধাপ। এখানে শিক্ষার্থীরা পুরো কোরআন মুখস্থ করে। আগে হিফজখানার পরিবেশ ছিল খুবই সাদামাটা- একটি লম্বা ঘর, কাঠের বেঞ্চ বা চাটাই, আর একদল হাসি-মুখী কিন্তু শৃঙ্খলাবদ্ধ শিশুরা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত  তিলাওয়াত, সাবক, শুদ্ধ করা, নূতন দৌড়- এসব নিয়েই কাটত তাদের দিন। শিক্ষকরা অত্যন্ত  ধৈর্যশীল, আন্ত রিক ও পরিশ্রমী হতেন; কারণ হিফজ করানো একটি কষ্টসাধ্য কাজ।

আজকের হিফজখানার পরিবেশ অনেক মানসম্মত হয়েছে। অনেকে আবাসিক সুবিধা, পুষ্টিকর খাবার, প্রশিক্ষিত শিক্ষক ও তাজবীদ বিশেষজ্ঞ সরবরাহ করে। প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ দৌড়, পুরোনো স্মরণ, নতুন দৌড়- সব কিছুরই একটি বিজ্ঞানভিত্তিক সূচি নির্ধারিত থাকে। বিভিন্ন মসজিদে তিলাওয়াত প্রতিযোগিতা, দাওয়াতি মাহফিল, রমজানে তারাবী; এসব শিক্ষার্থীদের অনুশীলনে সাহায্য করে।

হিফজ করা একজন শিশুর মানসিক শক্তি, স্মরণশক্তি, মনোযোগ ও আÍবিশ্বাস বৃদ্ধি করে। যে শিশু ৩০ পারা কোরআন মুখস্থ করতে পারে সে জীবনের কঠিন কাজও সফলভাবে সম্পন্ন করতে পারে- এমন বিশ্বাস সমাজে প্রতিষ্ঠিত। হিফজখানা মাদরাসা শিক্ষার গৌরবময় অংশ, যা একাল সেকাল সব যুগেই সর্বোচ্চ সম্মানের আসনে রয়েছে।

৭. আবাসিক বিভাগ

আবাসিক মাদরাসা বাংলাদেশে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর শিক্ষার প্রধান ভিত্তি। যারা দূরগ্রাম থেকে আসে, বা যাদের পরিবার নিয়মিত ইসলামি পরিবেশ দিতে পারে না- তারা আবাসিক বিভাগে ভর্তি হয়। আগে আবাসিক মাদরাসার চিত্র ছিল খুবই সাধারণ- ছোট ছোট ঘর, পাটের খাট, ঝাড়লণ্ঠন বা কেরোসিন বাতি, আর সাধারণ ভাত-ডাল-সবজি। কিন্তু সেই পরিবেশে শিক্ষার্থীরা ছিল অসাধারণ শৃঙ্খলাবদ্ধ। শিক্ষার্থীদের দিনের শুরু হতো ফজরের আজানের আগেই। ওযু, তাহাজ্জুদ, কোরআন তিলাওয়াত- এসবের মধ্য দিয়ে তাদের জীবন গড়ে উঠত। খাদ্য ছিল সহজ, থাকা ছিল সাদাসিধা, কিন্তু পরিবেশ ছিল আধ্যাত্মিক ও শান্তি ময়।

বর্তমান আবাসিক মাদরাসাগুলো অনেক উন্নত। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বাসস্থান, দোতলা-তিনতলা নতুন ভবন, বিশুদ্ধ খাবার পানি, নির্দিষ্ট রুটিনে খাবার, দুপুরে বিশ্রাম, স্বাস্থ্যসেবা- এসব নিশ্চিত করা হয়। অভিভাবকদের স্বচ্ছ ধারণা দিতে নিয়মিত মিটিং, বার্ষিক পরীক্ষার রিপোর্ট, অভ্যন্ত রীণ ডিসিপ্লিন- এসব আজকের আবাসিক মাদরাসার নতুন চিত্র। আবাসিক জীবন শিক্ষার্থীদের দায়িত্বশীল, স্বনির্ভর, শৃঙ্খলাবদ্ধ ও আত্মনিবেদিত হতে শেখায়। একসময় ছিল মানুষ কষ্ট করে পড়ত; এখন সুযোগ-সুবিধা ভালো হয়েছে। তবে উদ্দেশ্য একই- আদর্শ মানুষ তৈরি।

৮. অনাবাসিক বিভাগ

অনাবাসিক মাদরাসা মূলত গ্রামীণ ও শহুরে উভয় অঞ্চলে ধর্মীয় শিক্ষার সহজলভ্য মাধ্যম। যারা বাড়িতে থাকে, সকালে বা বিকালে কয়েক ঘণ্টা এসে পড়াশোনা করে- তারা অনাবাসিক শিক্ষার্থী। আগে এই ব্যবস্থা ছিল খুবই প্রচলিত, কারণ পরিবারগুলো চাইত সন্তানেরা ধর্মীয় জ্ঞান লাভ করুক পাশাপাশি সংসারের কাজও করুক।

পুরনো দিনের অনাবাসিক মক্তবগুলো ছিল মসজিদের বারান্দা, গাছতলায় বসা বা গ্রামের স্কুলঘরের খালি রুমে। বাচ্চারা পায়ে-হাঁটা দূরত্বে এসে পড়ত। শিক্ষকরা পড়াতেন বিনা প্রাপ্তিতে বা খুব সামান্য সম্মানীতে।

আজকের অনাবাসিক শিক্ষা আরও উন্নত ও সিস্টেমেটিক। অনেক মাদরাসায় সকাল ও বিকালের দুটি শিফট থাকে। বই, তাজবীদ, দোয়া, ফিকহ, আমপাড়া- এসব বিষয় নিয়মিত পাঠক্রমে থাকে। শিক্ষার্থীরা স্কুলে পড়ার পাশাপাশি ইসলামি বিদ্যাও সহজে পায়। অভিভাবকদের নজরদারি, সাপ্তাহিক পরীক্ষা, উপস্থিতি রেজিস্টার- এসব ব্যবস্থাপনা আধুনিক ও সময়োপযোগী করে তুলেছে অনাবাসিক মাদরাসাগুলোকে।

এই শিক্ষা সমাজের প্রতিটি বাড়িকে আলোকিত করে। স্কুল-কলেজের জ্ঞান আর মাদরাসার নৈতিক শিক্ষা- দুটির সমন্বয়েই একজন শিশু পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠে।

৯. কোরআনে হাফেজদের অবদান

কোরআনে হাফেজরা বাংলাদেশের সমাজে একটি বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন অবস্থান ধরে রেখেছেন। কোরআন মুখস্থ করা একটি অলৌকিক ক্ষমতা- এটি মানসিক শক্তি, নিয়মানুবর্তিতা এবং আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহের নিদর্শন। আগে গ্রামে-গঞ্জে একজন হাফেজ থাকলে পুরো এলাকা তাকে সম্মান করত। নামাজে তারাবাহ পড়ানোর জন্য তাকে খুঁজে আনা হতো, বিয়ের দোয়া, মিলাদ, ওয়াজ- সব জায়গাতেই হাফেজদের একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা ছিল। আজও সেই সম্মান অটুট। বরং হাফেজদের সুযোগ আরও বেড়েছে। বিভিন্ন মসজিদে ইমামতি, দেশের ও বিদেশের প্রতিযোগিতা, জাতীয় ও আন্ত র্জাতিক পর্যায়ে তিলাওয়াত অনুষ্ঠান- সব জায়গায় তারা অবদান রাখছেন। রমজানে তারাবীর নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্তে  হাফেজদের ডাক আসে। অনেকেই আরব দেশগুলোতে ইমাম ও খতিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

হাফেজরা শুধু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অবদান রাখেন না; সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকেও তারা মানুষকে নৈতিকতার আলো ছড়িয়ে দেন। তাদের কণ্ঠে কোরআন তিলাওয়াত শ্রোতাদের হৃদয়ে আল্লাহর প্রতি গভীর ভালোবাসা সৃষ্টি করে। এ কারণে বলা যায়- যুগ বদলায়, সমাজ বদলায়, প্রযুক্তি উন্নত হয়; কিন্তু হাফেজদের অবদান একাল-সেকাল উভয় যুগেই অপরিবর্তনীয়।

১০. বিশ্ব ও বাংলাদেশ

ইসলামি শিক্ষার প্রভাব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভিন্ন হলেও বাংলাদেশের কওমি শিক্ষা একটি স্বতন্ত্র মর্যাদা বহন করে। বিশ্বের বহু দেশে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল থাকলেও বাংলাদেশের কওমি মাদরাসাগুলো ঐতিহ্য, আধ্যাÍিকতা ও ধর্মীয় কঠোরতায় তুলনামূলকভাবে শীর্ষে আছে।

মিসর, সৌদি আরব, পাকিস্তান, তুরস্ক- এসব দেশে ইসলামি উচ্চশিক্ষা সরকারি ব্যবস্থার অংশ। কিন্তু বাংলাদেশে কওমি মাদরাসা বহু বছর ধরে স্বাধীনভাবে পরিচালিত হয়ে আসছে। এই স্বাধীনতার ফলে পাঠ্যক্রম, আরবি-ফিকহ শিক্ষায় গভীরতা এবং শিক্ষকদের আন্ত রিকতা- এসব বজায় আছে। বাংলাদেশে কওমি মাদরাসার সংখ্যা এখন লক্ষাধিক। দেশের গ্রাম-মফস্বল-শহর প্রতিটি অঞ্চলে এর ব্যাপক বিস্তার। এখানে নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত- সব শ্রেণির মানুষ তাদের সন্তানদের ইসলামের মূল শিক্ষা দিতে আগ্রহী।বিশ্বের ইসলামি শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে তুলনা করলে দেখা যায়- বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা মুখস্থবিদ্যা, তাজবীদ, হাদিস গবেষণা এবং দাওয়াতি কাজে বিশ্বমান বজায় রেখেছে। আন্ত র্জাতিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের হাফেজরা বারবার প্রথম স্থান অর্জন করছেন- এও একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত । বাংলাদেশের কওমি মাদরাসা তাই শুধু দেশেই নয়; বিশ্বেও একটি স্বতন্ত্র সম্মানের স্থান করে নিয়েছে।

১১. নৈতিক ও আদর্শিক শিক্ষা

মাদরাসা শিক্ষার মূল শক্তি হলো নৈতিক ও আদর্শিক শিক্ষা। সমাজে যখন ভোগবাদ বাড়ছে, প্রযুক্তি মানুষের হাতে এসেছে, সম্পর্কগুলো যান্ত্রিক হয়ে উঠছে- তখন মাদরাসা শিশুদের হৃদয়ে সত্য, ন্যায়, সততা, নরম মন, নম্রতা ও নমনীয়তার শিক্ষা দেয়।

আগে মাদরাসার শিক্ষার্থীরা হুজুরদের কাছ থেকে খুব ঘনিষ্ঠভাবে নৈতিকতা শিখত। শিষ্টাচার, বড়দের সম্মান, ছোটদেও ¯েœহ, প্রতিবেশীর হক- এসব বিষয়ে আলাদা করে পাঠ না দিলেও আচরণের মাধ্যমে শেখানো হতো। শিক্ষকদের জীবন ছিলই তাদের সবচেয়ে বড় পাঠ্যবই।বর্তমানে নৈতিক শিক্ষার প্রয়োজন আরও বেড়েছে। সামাজিক অবক্ষয়, অনলাইন আসক্তি, স্মার্টফোনের অপব্যবহার- এসব থেকে শিশুদের বাঁচাতে নিয়মিত নাসিহত, বিশেষ ক্লাস, মানবিক মূল্যবোধের পাঠ এখন সাধারণ বিষয়। অনেক মাদরাসায় সাপ্তাহিক “আখলাক ক্লাস” চালু হয়েছে, যেখানে শিশুদের বাস্তব জীবনের গল্প দিয়ে ভালো চরিত্র গঠনের শিক্ষা দেওয়া হয়। নৈতিক শিক্ষা মানবিক মানুষ তৈরির সবচেয়ে জরুরি বিষয়। মাদরাসা শিক্ষা এই দিকেই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে। কারণ একজন নৈতিক মানুষই সমাজের প্রকৃত সম্পদ।

১২. আকলাকে হামিদা

“আকলাকে হামিদা” অর্থাৎ প্রশংসনীয় চরিত্র- ইসলামি শিক্ষার উচ্চতর লক্ষ্য। মাদরাসা শুধু জ্ঞান দেয় না; বরং আচরণে পরিবর্তন আনে। আকলাকে হামিদা বলতে বোঝায়- সততা, ধৈর্য, ক্ষমাশীলতা, বিনয়, সত্যবাদিতা, আমানতদারিতা, পরোপকারিতা- এই সব গুণ মানুষের অন্ত রে স্থাপন করা।

আগে গ্রামীণ সমাজে মাদরাসার ছাত্রদের দেখলেই বুঝা যেত- তারা শিষ্ট, শান্ত , বিনয়ী। তাদের পোশাক, হাঁটা-চলা, কথাবার্তা- সবকিছুতেই অন্যরকম সৌন্দর্য ছিল। সমাজও তাদের সম্মান করত এই চরিত্রের জন্য।

বর্তমানে পরিবার ও সমাজে নৈতিকতার সংকট বেড়ে যাওয়ায় আকলাক শিক্ষার গুরুত্ব দ্বিগুণ হয়েছে। তাই অনেক মাদরাসায় শিক্ষার্থীদের চরিত্র গঠনে বিশেষ পাঠ, গল্পের মাধ্যমে শিক্ষা, নসিহত ও পরামর্শ দেওয়া হয়। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের শুধু পাঠ্য জ্ঞান না দিয়ে বাস্তব জীবনে কীভাবে ইসলাম পালন করতে হবে- সেসবও শিখিয়ে দেন।

প্রশংসনীয় চরিত্র ছাড়া শিক্ষা অপূর্ণ। তাই আকলাকে হামিদা মাদরাসা শিক্ষার একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য, যা একাল-সেকাল সব সময়ে অপরিবর্তিত।

১৩. ওয়াজ মাহফিল ও দাওয়াতি কাজ

ওয়াজ মাহফিল বাংলাদেশে দাওয়াতি কাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আগে গ্রামের খোলা মাঠ, মসজিদচত্বর বা স্কুল প্রাঙ্গণে ছোট ছোট মাহফিল বসত। বক্তারা ছিলেন অত্যন্ত  জ্ঞানী, মাটির মানুষ। তারা ইসলামের সত্য কথা বলতেন সাধারণ মানুষের ভাষায়- কোনো প্রদর্শন ছিল না।

আজকের ওয়াজ মাহফিল অনেক বড় আকার ধারণ করেছে। মাইকে সাউন্ড সিস্টেম, আলোকসজ্জা, বিশাল মঞ্চ- এসব এখন সাধারণ দৃশ্য। জনপ্রিয় বক্তাদের ওয়াজ শোনার জন্য হাজার হাজার লোক সমবেত হয়। অনেকে ইউটিউব, ফেসবুকের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ শ্রোতাকে দাওয়াতি বার্তা পৌঁছে দিচ্ছেন। এই মাহফিলে মানুষ নৈতিকতা, পরকাল, পরিবার, সমাজ, ফিতনা ও তাওহীদের গুরুত্ব- এসব বিষয়ে শিক্ষা লাভ করে। মাদরাসা শিক্ষার্থীরা শেখে কীভাবে মানুষকে ভালো কথা বলতে হয়, কীভাবে দাওয়াতি দায়িত্ব পালন করতে হয়।

ওয়াজ মাহফিলের ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে- মানুষকে ধর্মের দিকে ফিরিয়ে আনে, কোরআন-হাদিসের জ্ঞান বাড়ায়, সমাজে অনৈতিক কর্মকাণ্ড কমায়। তবে মাদরাসা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য থাকে- শান্ত, ভারসাম্যপূর্ণ, জ্ঞানভিত্তিক দাওয়াতি কাজ করা।

১৪. স্বীকৃতি স্বরূপ কওমি মাদরাসা

বাংলাদেশে কওমি মাদরাসার জন্য সবচেয়ে বড় মাইলফলক হলো দাওরায়ে হাদিসের স্বীকৃতি। বহু বছর ধরে কওমি মাদরাসা স্বাধীনভাবে পরিচালিত হলেও রাষ্ট্রীয় মানদণ্ডে এর স্বীকৃতি ছিল না। শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা বা চাকরিতে অসুবিধায় পড়ত।

২০১৮ সালে কওমি শিক্ষার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্স (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) সমমান স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এর ফলে কওমি শিক্ষার্থীরা সরকারি-বেসরকারি চাকরি, উচ্চশিক্ষা এবং গবেষণা ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করতে পারছে। এটি শুধু একটি কাগুজে স্বীকৃতি নয়; বরং শত বছরের ঐতিহ্য, ত্যাগ, সাধনা ও জ্ঞানচর্চার স্বীকৃতি। দেশের লাখ লাখ শিক্ষক-শিক্ষার্থী এর মাধ্যমে নতুন সম্মান ও সুযোগ অর্জন করেছে। তবে স্বীকৃতি পেলেও কওমি মাদরাসা তাদের মূল আখলাকি ও আধ্যাত্মিক ধারাকে অক্ষুণ্ন রেখেছে। তারা রাষ্ট্রীয় সাহায্য না নিয়ে স্বাধীনতা বজায় রেখে নিজেদের মতো পাঠক্রম পরিচালনা করছে। এই স্বাতন্ত্রই কওমি মাদরাসার বৈশিষ্ট্য।

১৫. উপসংহার

মাদরাসা শিক্ষার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও বর্তমান বাস্তবতা বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয়- এটি বাংলার মুসলিম সমাজের আত্ম ও পরিচয়ের একটি অপরিহার্য অংশ। যুগ বদলাচ্ছে, মানুষ আধুনিক হচ্ছে, প্রযুক্তি আমাদের ঘিরে ফেলছে- তবু নৈতিকতা, আধ্যাত্মিকতা ও মানবিকতার উৎস হিসেবে মাদরাসা শিক্ষা অটুট রয়েছে।

কায়দা থেকে শুরু করে হিফজ, দাওরায়ে হাদিস থেকে শুরু করে দাওয়াতি কাজ- প্রতিটি ক্ষেত্রেই মাদরাসা শিক্ষার গভীরতা, শৃঙ্খলা ও ত্যাগ স্পষ্ট। একালে সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে, শিক্ষায় আধুনিকতার ছোঁয়া এসেছে, কিন্তু সেকালের সেই নিষ্ঠা, আন্ত রিকতা এবং ধর্মীয় শুদ্ধতার ধারা এখনো বজায় আছে। বাংলাদেশে মাদরাসা শিক্ষা শুধু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নয়; এটি সমাজের নৈতিক মেরুদণ্ড, মানবিকতার আলো এবং জাতির চরিত্র গঠনের বিদ্যালয়।

পরিশেষে বলা যায়- মাদরাসা শিক্ষা একাল-সেকাল যাই হোক, এটি সবসময়ই মানুষের হৃদয়ে আলোকিত পথ দেখিয়ে যাবে। এবং এর মূল লক্ষ্য থাকবে একই- ‘আদর্শ, নৈতিক ও আল্লাহভীরু মানুষ তৈরি করা’।

লেখক : কবি, শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

মাদরাসা শিক্ষা

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর