Logo

শিক্ষা

কওমি মাদরসার বোর্ড পরীক্ষা আসন্ন, ভালো ফল করার উপায়

Icon

উবায়দুল হক খান

প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:২৬

কওমি মাদরসার বোর্ড পরীক্ষা আসন্ন, ভালো ফল করার উপায়

পরীক্ষা জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এটি শুধু বইয়ের জ্ঞান যাচাই নয়; বরং শৃঙ্খলা, ধৈর্য, পরিশ্রম ও আত্মনিয়ন্ত্রণেরও এক বাস্তব পরীক্ষা। ছাত্রজীবনের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়ই হলো- ‘পরীক্ষায় ভালো ফলাফল’। কিন্তু মুসলমান শিক্ষার্থী হিসেবে আমাদের লক্ষ্য শুধু ভালো ফল নয়; বরং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জ্ঞান অর্জন ও তা সঠিকভাবে কাজে লাগানো। ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করার কিছু মৌলিক ও সুন্দর উপায় রয়েছে, যা কেবল দুনিয়ার নয়, আখিরাতের সফলতার পথও উন্মুক্ত করে।

নিয়ত ও উদ্দেশ্য শুদ্ধ করা

ইসলাম শেখায়, প্রত্যেক কাজ নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। হাদিসে এসেছে, ‘কাজসমূহ নিয়তের উপর নির্ভরশীল।’ [বুখারি ও মুসলিম]

তাই পরীক্ষার প্রস্তুতি কিংবা পড়াশোনার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও সমাজে কল্যাণ বয়ে আনা। যদি নিয়ত থাকে সঠিক; অর্থাৎ, জ্ঞানের মাধ্যমে নিজেকে, পরিবারকে, সমাজকে এবং দীনের খেদমত করা। তবে সেই অধ্যয়ন ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত হয়। এ নিয়ত যত দৃঢ় হবে, ততই মনোযোগ ও পরিশ্রমের শক্তি বৃদ্ধি পায়।

নিয়মিত সালাত ও দোয়ার প্রতি যত্নশীল হওয়া

সালাত আল্লাহর কাছে সাহায্য পাওয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়। পরীক্ষার সময় অনেক ছাত্র-ছাত্রী নামাজকে অবহেলা করে, অথচ এটি সফলতার মূল চাবিকাঠি। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য চাও।’ [সুরা বাকারা : ২/৪৫]

প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত সালাত সময়মতো আদায় করলে মন শান্ত থাকে, মনোযোগ বাড়ে, দুশ্চিন্তা কমে। তাছাড়া নামাজ শেষে বিশেষ দোয়া করা যায় ‘রব্বি যিদনি ইলমা’। অর্থাৎ, হে আমার প্রভু, আমাকে জ্ঞানে বৃদ্ধি দান করো। [সুরা ত্ব-হা : ২০/১১৪] এই দোয়াটি নবীজির সা. নিজেও করতেন। পরীক্ষার আগে-পরে এবং প্রতিদিনের পড়ার সময় এই দোয়া পড়া অত্যন্ত ফলপ্রসূ।

হারাম থেকে বিরত থাকা

হারাম খাদ্য, হারাম উপার্জন ও হারাম কাজ মন ও মস্তিষ্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। হালাল আহার ও পবিত্র জীবন যাপন করলে চিন্তাশক্তি প্রসারিত হয়, মন পরিষ্কার থাকে। নবী করিম সা. বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি হালাল আহার করে, আল্লাহ তার দোয়া কবুল করেন।’

অতএব, পরীক্ষার সময় শুধু পরিশ্রম নয়; বরং পবিত্র জীবনযাপনও জরুরি। অন্যের নকল করা, প্রতারণা করা, বা প্রশ্ন ফাঁসের আশায় থাকা; এসব ইসলামি দৃষ্টিতে বড় গুনাহ। এমন কাজে সাময়িক ফল পাওয়া গেলেও তাতে বরকত থাকে না।

সময়ের সঠিক ব্যবহার

সময় একটি আমানত। আল্লাহ কোরআনে সময়ের কসম খেয়ে বলেছেন, ‘সময়ের শপথ, মানুষ অবশ্যই ক্ষতির মধ্যে।’ [সুরা আসর : ১০৩/১-২]

পরীক্ষার আগে পরিকল্পিতভাবে সময় ভাগ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সকাল বেলা তাড়াতাড়ি ওঠা, ফজরের নামাজের পর কিছু সময় অধ্যয়নে ব্যয় করা খুব উপকারী। কারণ এই সময় মন থাকে সতেজ, স্মৃতিশক্তি থাকে সক্রিয়। অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহার, অপ্রয়োজনীয় আড্ডা বা বিনোদনে সময় নষ্ট করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

মা-বাবার দোয়া ও সন্তুষ্টি লাভ করা

মা-বাবার দোয়া সফলতার সবচেয়ে বড় শক্তি। হাদিসে এসেছে, ‘তিনজনের দোয়া প্রত্যাখ্যাত হয় না- ন্যায়পরায়ণ শাসক, উপবাসী ব্যক্তি এবং পিতা-মাতার দোয়া।’ [তিরমিজি]

পরীক্ষার আগে ও পরে মা-বাবার দোয়া নেয়া এক বিশাল বরকত। অনেক সময় দেখা যায়, পড়াশোনা কম করেও কেউ ভালো ফল করে; তার পেছনে থাকে মা-বাবার দোয়ার প্রভাব।

শিক্ষক ও জ্ঞানীদের সম্মান করা

যে শিক্ষক আমাদের শিক্ষা দেন, তাদের সম্মান করা ঈমানের অংশ। নবী করিম সা. বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠকে সম্মান করে না এবং শিক্ষকদের মর্যাদা দেয় না, সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ শিক্ষকের প্রতি ভালো ব্যবহার, মনোযোগ দিয়ে ক্লাস করা, প্রশ্ন করলে বিনয়ের সঙ্গে করা; এসব জ্ঞান অর্জনের বারাকাহ বাড়ায়। পরীক্ষার ফলও তাতে উন্নত হয়।

নিয়মিত কুরআন তেলাওয়াত ও জিকির

কোরআন তেলাওয়াত হৃদয়কে প্রশান্ত করে, চিন্তা পরিষ্কার করে। প্রতিদিন কিছু সময় কোরআন পড়লে মনোযোগ বাড়ে। আর জিকির করলে মন থাকে আল্লাহর স্মরণে, যা দুশ্চিন্তা দূর করে। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর স্মরণেই হৃদয়ের প্রশান্তি।’ [সুরা রাদ : ১৩/২৮]

পরীক্ষার চাপ, ভয় ও উদ্বেগ দূর করার জন্য ‘লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুন্তু মিনাজ-জালিমীন’-এই দোয়া পড়া যেতে পারে। এটি ইউনুস আ.-এর দোয়া, যা বিপদের সময় পড়লে আল্লাহ সাহায্য করেন।

পরিশ্রম ও তাওয়াক্কুল

ইসলাম পরিশ্রমকে ভালোবাসে। আল্লাহ বলেন- ‘মানুষের জন্য আছে কেবল তারই চেষ্টা-পরিশ্রম।’ [সুরা নাজম : ৫৩/৩৯]

শুধু দোয়া করলেই হবে না; বরং পড়াশোনায় নিয়মিত পরিশ্রম জরুরি। তবে সব পরিশ্রমের পরও আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসা রাখতে হবে। কারণ ফলাফল তাঁর হাতে।

নবী করিম সা. বলেছেন, ‘উটকে বেঁধে আল্লাহর উপর ভরসা করো।’ [তিরমিজি] অর্থাৎ নিজের কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে হবে, এরপর আল্লাহর কাছে ফলাফলের ভালো পরিণতি কামনা করতে হবে।

নিয়মিত বিশ্রাম ও শরীরের যত্ন

একজন মুসলমান তার দেহেরও অধিকার মানে। নবী করিম সা. বলেছেন, ‘তোমার শরীরেরও তোমার উপর অধিকার আছে।’

অতএব, পর্যাপ্ত ঘুম, স্বাস্থ্যকর খাদ্য ও মানসিক প্রশান্তি বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ। অতিরিক্ত রাত জেগে না পড়ে পরিকল্পিতভাবে পড়লে স্মৃতি শক্তি ভালো থাকে এবং পরীক্ষায় মনোযোগ বাড়ে।

পরীক্ষার আগে ও সময়কার দোয়া

পরীক্ষার আগে কিছু দোয়া পড়া খুবই ফলপ্রসূ। বাংলা উচ্চারণ: ‘রাব্বিশ রাহলি সাদরি, ওয়াইসসিরলি আমরি’। অর্থ : হে আমার প্রতিপালক! আমার বক্ষ উন্মুক্ত করে দাও এবং আমার কাজ সহজ করে দাও।’ [সুরা ত্ব-হা : ২৫-২৬]

বাংলা উচ্চারণ:  ‘আল্লাহুম্মা লা সাহলা ইল্লা মা জাআলতাহু সাহলা’। অর্থ : হে আল্লাহ! তুমি যা সহজ করো, কেবল সেটিই সহজ। তুমি চাইলে কঠিনকেও সহজ করে দাও। [হাদিস] এই দোয়াগুলো হৃদয় প্রশান্ত করে, ভয় দূর করে, আত্মবিশ্বাস বাড়ায়।

আত্মবিশ্বাস ও ইতিবাচক চিন্তা

আল্লাহর সাহায্যে দৃঢ় বিশ্বাস রাখলে সাফল্য আসে। ভয় ও হতাশা থেকে দূরে থাকতে হবে। কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই কঠিনের পরেই সহজ আছে।’ [সুরা ইনশিরাহ : ৯৪/৬] অতএব, পরীক্ষাকে ভয় নয়; বরং সুযোগ হিসেবে নিতে হবে। নিজের পরিশ্রমের ফল দেখানোর সুযোগ।

ফলাফলের পর কৃতজ্ঞতা ও নম্রতা

ফলাফল ভালো হলে অহংকার নয়, আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হতে হবে। কারণ প্রতিটি সফলতা তাঁর দান। আর ফলাফল প্রত্যাশামতো না এলে হতাশ হওয়া নয়; বরং ভাবতে হবে-এতে নিশ্চয়ই কোনো কল্যাণ আছে। আল্লাহ বলেন- ‘সম্ভবত তোমরা কোনো কিছু অপছন্দ করছো, অথচ তাতে তোমাদের জন্য কল্যাণ নিহিত আছে।’ [সুরা বাকারা : ২/২১৬]

আখেরাতের পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হতে হবে 

ইসলাম শুধু ইবাদতের দীন নয়; এটি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে দিকনির্দেশনা দেয়। পরীক্ষায় ভালো ফল করার জন্য যে নিয়মগুলো আধুনিক শিক্ষা দেয়। পরিশ্রম, সময়নিষ্ঠা, সততা; সেগুলোই ইসলাম আরো সুন্দরভাবে শিক্ষা দেয়, সঙ্গে যোগ করে ঈমান, দোয়া, তাওয়াক্কুল ও আখিরাতের দৃষ্টি। অতএব, একজন মুসলমান শিক্ষার্থী যদি নিয়ত শুদ্ধ রাখে, নামাজ-দোয়া ও পরিশ্রমে অবিচল থাকে, হারাম থেকে দূরে থেকে আল্লাহর ওপর ভরসা রাখে; তবে দুনিয়ার পরীক্ষায়ও সে সফল হবে, আর আখিরাতের বড় পরীক্ষাতেও ইনশাআল্লাহ উত্তীর্ণ হবে।

লেখক : মুহাদ্দিস, জামিআতুস সুফফাহ আল ইসলামিয়া, গাজীপুর

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

মাদরাসা শিক্ষা

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর