মাদরাসা শিক্ষার মূল্যায়নে ইসলামি চিন্তাবিদদের ক্ষমতায়ন জরুরি
খন্দকার জাহাঙ্গীর হুসাইন
প্রকাশ: ২২ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৭:৪৫
উপমহাদেশের মুসলিম সমাজ আজ এক জটিল শিক্ষাগত, নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সংকটের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে। এই সংকট নতুন নয়; বরং এর গভীর শিকড় রয়েছে ইতিহাসের গভীরে, ঔপনিবেশিক শাসনের ধ্বনিত শিক্ষা ও চিন্তাভাবনার মধ্যে। বিশেষত মাদরাসা শিক্ষা- যা একসময় মুসলিম সমাজের জ্ঞানচর্চা, নেতৃত্ব ও রাষ্ট্র পরিচালনার প্রাণকেন্দ্র ছিল- আজও রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পর্যায়ে অবমূল্যায়িত। এই বাস্তবতায় মাদরাসা শিক্ষার পুনর্মূল্যায়ন এবং ইসলামি চিন্তাবিদদের প্রকৃত ক্ষমতায়ন সময়ের এক অপরিহার্য দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পৃথিবীতে যুগে যুগে যে সকল শিক্ষার আবির্ভাব হয়েছে তন্মধ্যে সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ হলো মাদরাসা শিক্ষা। যার সূচনা সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে। আল্লাহ পাক নিজেই এই শিক্ষার সর্বপ্রথম শিক্ষক। ইরশাদ হয়েছে- “করুণাময় আল্লাহ্। তিনি কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন।” (সূরা-রাহমান, আয়াত-১,২)
আল্লাহ্ তায়ালা হযরত জিবরাইলের মাধ্যমে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এই শিক্ষা দিয়েছেন। অতঃপর এই শিক্ষার অমীয় সূধা পান করে তৃপ্ত হয়েছেন আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি., আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি., আবু হুরায়রা রাযি.। সৃষ্টি হয়েছেন ইমাম আবু হানিফা রহ., ইমাম শাফেয়ী রহ., ইমাম মালিক রহ., ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. প্রমুখ আইম্মায়ে কেরাম।
মাদরাসা শিক্ষা মানে নববী শিক্ষা। এটি সাধারণ কোনো বিষয় নয়। এ শিক্ষার মৌলিক সিলেবাস প্রণয়নকারী বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ তায়ালা ঈমানদারদের ওপর অনুগ্রহ করেছেন যে, তাদের মাঝে তাদের মধ্য থেকে এমন একজন নবী পাঠিয়েছেন। যিনি তাদের সম্মুখে তাঁর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করেন, তাদেরকে আত্মশুদ্ধি করেন, তাদেরকে কিতাব ও হিকমত (সুন্নাহ) শিক্ষা দেন। বস্তুত: তারা ছিল পূর্ব থেকেই পথভ্রষ্ট।’ (সূরা-আল ইমরান, আয়াত-১৬৪)
এই মাদরাসা শিক্ষার উদ্দেশ্য ও মৌলিক বিষয়াদি দুনিয়ার সকল বিষয়কেই অন্তর্ভূক্ত করে। এ শিক্ষার অবকাঠামো ক্ষুন্ন করতে যুগ যুগ ধরে অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে ইসলাম বিদ্বেষীরা।
১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পর ব্রিটিশরা শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করেনি; তারা দখল করেছিল জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসর। ১৮৩৫ সালে টমাস ব্যাবিংটন ম্যাকলে প্রণীত শিক্ষা নীতির মাধ্যমে ইংরেজি ভাষা এবং পশ্চিমা জ্ঞানকে ‘আধুনিকতার’ একমাত্র মানদণ্ড হিসেবে চাপিয়ে দেওয়া হয়। বিপরীতে মাদরাসা শিক্ষাকে ধীরে ধীরে অনুৎপাদনশীল, যুগোপযোগী নয় এমনভাবে চিহ্নিত করা হয়।
অথচ ব্রিটিশ আগমনের আগে উপমহাদেশের মাদরাসাগুলো শুধু ধর্মীয় শিক্ষা নয়; বরং গণিত, দর্শন, চিকিৎসা, আইন ও প্রশাসনিক প্রশিক্ষণের কেন্দ্র ছিল। এখান থেকেই তৈরি হতো বিচারক, মুফতি, শিক্ষক এবং রাষ্ট্রকর্মী। ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা সেই প্রাকৃতিক নেতৃত্ব কাঠামো ভেঙে দেয় এবং মাদরাসাকে সীমিত করে ‘ধর্মীয় আচার ও কেবল ইবাদতের শিক্ষা’- তে। এই সংকীর্ণ সংজ্ঞা আজও আমাদের সমাজচিন্তায় প্রোথিত।
বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের মুসলিম রাষ্ট্রগুলো রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভ করলেও শিক্ষা দর্শনে প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন করতে পারেনি। রাষ্ট্র পরিচালনায় যারা ক্ষমতায় বসেছেন, তাদের একটি বড় অংশই পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত এবং পশ্চিমা উন্নয়ন মডেলের প্রতি অন্ধভাবে অনুরক্ত। ফলশ্রুতিতে জাতীয় শিক্ষা নীতিতে মাদরাসা শিক্ষা বরাবরই অবহেলিত হয়েছে।
কখনো বলা হয়েছে, “মাদরাসা শিক্ষায় কর্মসংস্থান হয় না”; আবার কখনো এটিকে ‘চরমপন্থার সম্ভাব্য উৎস’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এইরকম বক্তব্য শুধুই পক্ষপাতমূলক নয়, বরং তথ্যগতভাবেও অসম্পূর্ণ। কারণ সমস্যাটি মাদরাসা শিক্ষার মৌলিক দর্শনে নয়; সমস্যাটি হলো নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ইসলামি চিন্তাবিদদের কার্যকর অংশগ্রহণের অভাব।
মাদরাসা শিক্ষা কখনোই কেবল অতীতনির্ভর ছিল না। ইসলামি সভ্যতার ইতিহাসে মাদরাসা ছিল বিজ্ঞান, দর্শন, গণিত, চিকিৎসা ও সমাজবিজ্ঞানের বিকাশকেন্দ্র। বাগদাদের বাইতুল হিকমা, কায়রোর আল-আজহার, দামেস্ক, বুখারা এবং আন্দালুসের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো তার উজ্জ্বল উদাহরণ।
আজকের বাংলাদেশেও মাদরাসা শিক্ষায় শিক্ষিত লক্ষাধিক তরুণ সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করছে- ইমামতি, শিক্ষা, গবেষণা, লেখালেখি, সামাজিক উন্নয়ন এবং উদ্যোক্তা হিসেবেও। কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিসকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়ায় শিক্ষার্থীরা এখন বৈধভাবে সমাজে অংশ নিতে পারছে। তবে স্বীকৃতি একতরফা অর্জন যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন ইসলামি চিন্তাবিদদের প্রকৃত ক্ষমতায়ন এবং নৈতিক ও প্র্যাকটিক্যাল শিক্ষা সংস্কারের বাস্তবায়ন।
প্রকৃত ক্ষমতায়ন বলতে বোঝায়- শিক্ষা নীতি প্রণয়ন, পাঠ্যক্রম সংস্কার, গবেষণা কাঠামো নির্মাণ এবং জাতীয় বুদ্ধিবৃত্তিক বিতর্কে ইসলামি চিন্তাবিদদের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
আজকের শিক্ষা সংস্কারের নামে অনেক সময় এমন প্রস্তাব আসে, যা মাদরাসা শিক্ষার মৌলিক আত্মাকে উপেক্ষা করে। এতে শিক্ষার্থীর আত্মপরিচয়ের সংকট সৃষ্টি হয়। ইসলামি চিন্তাবিদদের নেতৃত্বে সংস্কার মানে আধুনিক জ্ঞানকে প্রত্যাখ্যান নয়; বরং ধর্মীয় জ্ঞান ও আধুনিক বিজ্ঞানের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ সমন্বয়।
শিক্ষার সঙ্গে প্র্যাকটিক্যাল আমল, আখলাক ও নৈতিক চর্চা সমন্বয় করা হলে মাদরাসা শিক্ষার সুফল সর্বাধিক বৃদ্ধি পাবে। প্রতিটি পেশাজীবীর জীবনযাপন কর্মমুখী পরিবেশে ইসলামচর্চার বাতাবরণ সৃষ্টি করতে পারলে শিক্ষার্থীরা কেবল জ্ঞান অর্জনই করবে না, বরং নৈতিক উদাহরণও স্থাপন করবে।
ন্যায্য নীতি, সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে নৈতিক দিকগুলোর অনুশীলন ছাড়া, নৈতিক অবক্ষয়ের আঁধারে নিমজ্জিত বাংলাদেশ কখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না। শিক্ষা কেবল পড়ালেখা নয়; এটি হলো সমাজ ও রাষ্ট্রকে নৈতিকভাবে শক্তিশালী করার হাতিয়ার।
মাদরাসা শিক্ষা সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরিতে গণমাধ্যমের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা ব্যক্তির অপরাধকে পুরো মাদরাসা ব্যবস্থার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু মূলধারার শিক্ষায় শিক্ষিত কারও অপরাধকে কখনো পুরো ব্যবস্থার ব্যর্থতা হিসেবে দেখানো হয় না। এই দ্বৈত মানদণ্ড স্পষ্টভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক বৈষম্যের পরিচয় দেয়। ইসলামি চিন্তাবিদরা যদি গবেষণা ও মিডিয়া ক্ষেত্রে আরও দৃশ্যমান ভূমিকা নিতে পারেন, তবে মাদরাসা শিক্ষার সঠিক চিত্র জনগণের সামনে আসতে পারে।
আজকের মাদরাসা শিক্ষার্থীরা আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন। তারা প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, গবেষণায় আগ্রহী হচ্ছে, ভাষা শিখছে এবং বৈশ্বিক আলোচনায় যুক্ত হচ্ছে। তারা আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে নেই; বরং আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরতে প্রস্তুত। এই পরিবর্তন প্রমাণ করে- আগামী দিনে মাদরাসা শিক্ষার মূল্যায়ন আর বাইরের কেউ করবে না; করবে তারাই, যারা এই ব্যবস্থার ভেতর থেকে উঠে এসেছে এবং এর শক্তি ও দুর্বলতা দুটোই জানে।
মাদরাসা শিক্ষাকে মর্যাদাসম্পন্ন করতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন মানসিক পরাধীনতা থেকে মুক্তি। পশ্চিমা মডেলই যে উন্নয়নের একমাত্র পথ- এই ধারণা পরিত্যাগ করে আমাদের নিজেদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও বাস্তবতার আলোকে শিক্ষা দর্শন নির্মাণ করতে হবে।
শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক ও প্র্যাকটিক্যাল চর্চার সমন্বয় নিশ্চিত করতে হবে। ইসলামি চিন্তাবিদরা যখন শিক্ষানীতি ও সংস্কারের কেন্দ্রে থাকবেন, তখনই মাদরাসা শিক্ষা আত্মমর্যাদা ও জাতীয় উন্নয়নের অংশীদার হবে। এভাবে নৈতিক ও জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার সমন্বয় ঘটানো ছাড়া বাংলাদেশের মুসলিম সমাজ বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা অর্জন করতে পারবে না। ইসলামি চিন্তাবিদদের প্রকৃত ক্ষমতায়নই সেই পথের প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক- হেমায়েতপুর, সাভার, ঢাকা।

