প্রতীকী ছবি
বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন হচ্ছে জাতীয় অগ্রাধিকার, কিন্তু এটি তখনই অর্থপূর্ণ হবে, যখন প্রতিটি রোগীর জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা-যন্ত্রপাতি সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী হবে। বর্তমানে অনেক রোগীর জীবন বাঁচাতে ও গুণগত সেবা দিতে প্রয়োজনীয় এমন বেশির ভাগ মেডিকেল ডিভাইস আমদানি নির্ভর। কিন্তু আমদানির উচ্চ শুল্ক, মূল্য পার্থক্য এবং নিয়মবিধি সংক্রান্ত জটিলতা রোগীদের চিকিৎসা ব্যয় বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং স্বাস্থ্যসেবায় বৈষম্যকে করুণ বাস্তবতায় পরিণত করছে।
বাংলাদেশে প্রায় ৯২-৯৫ শতাংশ মেডিকেল যন্ত্রপাতি আমদানি করা হয়। আমদানিকরণে শুল্ক ও কর বাড়ার প্রবণতা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বাজেট ২০২৫-২৬-এ বড় হাসপাতালগুলোর জন্য কিছু যন্ত্রপাতিতে শুল্ক-কর হ্রাস প্রস্তাব করা হলেও, সাধারণ পরিসরে এটি চাহিদামতো প্রয়োগ হচ্ছে কি না প্রশ্ন রয়ে গেছে। আমদানি কর ও বৃদ্ধি-শেষ কর (অ্যাডভান্স টেক্স) রোগী ও হাসপাতালগুলোতে অতিরিক্ত বোঝা হিসেবে প্রতিফলিত হয়।
ব্যবসায়ী এবং আমদানিকারকরা বলছেন, বর্তমান ‘ঔষধ ও কসমেটিকস আইন, ২০২৩’-তে মেডিকেল ডিভাইসগুলোকে ওষুধের আওতায় এনে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে, যা তাদের জন্য অসুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তারা দাবি করছেন একটি স্বতন্ত্র আইন প্রণয়ন করা উচিত যা মেডিকেল ডিভাইস-বিশেষ নীতিমালা রাখে এবং দ্রুত রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া, কম ফি ও সহজ আমদানি নিশ্চিত করবে।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের রেজিস্ট্রেশন, ফ্রি-সেল সার্টিফিকেট সত্যায়ন এবং ‘ইনডেন্ট অ্যাপ্রুভাল’ প্রক্রিয়া আমদানিকে দীর্ঘ ও ব্যয়বহুল করে তুলেছে, যা দাম বাড়ার একটি বড় কারণ।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের দায়িত্বে থাকা দপ্তরগুলো পর্যবেক্ষণ করেছে, কিছু মেডিকেল যন্ত্রপাতির আমদানি মূল্য এবং বিক্রয়মূল্যের মধ্যে ‘অস্বাভাবিক গ্যাপ’ রয়েছে। এমন ক্ষেত্রে মূল্য-নিয়ন্ত্রণের তৎপরতা কম এবং রোগীকে অতিরিক্ত খরচ গুনতে হচ্ছে।
বাংলাদেশের স্থানীয় মেডিকেল যন্ত্রপাতি শিল্প এখনো খুব শুরুতে রয়েছে। মাত্র ৫-৭ শতাংশ যন্ত্রপাতি দেশেই তৈরি হয়।
অক্সিজেন মনিটর, বেড, ছোট যন্ত্র ইত্যাদি কিছু স্তরে তৈরি হচ্ছে, কিন্তু উন্নত এবং প্রিমিয়াম ডায়াগনস্টিক ডিভাইস বা পুষ্টি-গভীর যন্ত্রপাতিতে নির্ভরতা আজও মুখ্যভাবে আমদানির ওপর।
স্থানীয় কোম্পানিগুলোর জন্য কাঁচামালের ওপর শুল্কও একটি বাধা- তাদের কিছু কাঁচামাল, যেমন পলিপ্রোপিলিন (পিপি) বা পচ ভিনাইল ক্লোরাইড (পিভিসি), আমদানিতে উচ্চ শুল্ক দিতে হয়, যা উৎপাদন ব্যয় বাড়ায়।
এ ছাড়া, নীতি-ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় একটি সামগ্রিক মেডিকেল ডিভাইস পলিসি এখনো অপেক্ষায় রয়েছে। অনেক উদ্যোক্তা বলছেন, শিল্পকে গতি দিতে একটি দশ বছরের উৎসাহমূলক নীতিমালা দরকার- যা বিনিয়োগকারীদের আত্মবিশ্বাস দেবে এবং উৎপাদন বাড়াবে। মান নিয়ন্ত্রণ, মাপ-ক্যালিব্রেশন এবং ডিভাইস নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য শক্তিশালী ব্যবস্থাপনার অভাব রয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে কম মানের বা গুণগতহীন যন্ত্রপাতি বাজারে প্রবেশ করছে, যা রোগীর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে।
রেজিস্ট্রেশন ফি অনেক ডিভাইসের জন্য অত্যধিক, যা আমদানিকরণ ব্যয় বাড়িয়ে রোগীর চিকিৎসা ব্যয়েও যুক্ত হয়ে যায়। ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলো বলেছে, ভারতে কিছু ক্লাস-এ বা ক্লাস-বি ডিভাইসে রেজিস্ট্রেশন ফি মাত্র কয়েক ডলার হলেও, বাংলাদেশে একই ধরনের ফি অনেক গুণ বেশি।
কেন সাধারণ মানুষের জন্য মূল্য সহজলভ্যতা অত্যন্ত জরুরি? জানতে চাইলে বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশের খবরকে বলছেন, উচ্চ চিকিৎসা ব্যয়- স্বাস্থ্য বৈষম্য রয়েছে আমাদের বাংলাদেশে। যেসব রোগী দরিদ্র বা মধ্যবিত্ত, তারা উন্নত ডায়াগনস্টিক যন্ত্র বা চিকিৎসা যন্ত্রপাতি ছাড়া সেবা পেতে পারে না। একদিকে রোগীর দারিদ্র্য, অন্যদিকে যন্ত্রপাতির উঁচু দাম, এটি দারুণ প্রতিকূলতা তৈরি করে।
তারা আরও বলেন, যদি আমদানির শুল্ক ও কর কমানো যায় এবং স্থানীয় উৎপাদন উৎসাহ দেওয়া যায়, তাহলে যন্ত্রপাতির দাম কমতে পারে। এর ফলে হাসপাতালগুলো কম ব্যয়ে উন্নত যন্ত্র কিনতে পারবে, যা রোগীদের চিকিৎসা খরচ কমাতে সহায়তা করবে।
গুণগত ডিভাইসের সহজলভ্যতা রোগীর সুরক্ষা বাড়ায়। যদি মানহীন বা অবৈধ ডিভাইস প্রবেশ করতে দেয়, তাহলে রোগীর জন্য ঝুঁকি বাড়ে। সমন্বিত নীতিমালা ও কন্ট্রোল সিস্টেম রোগীদের জন্য নিরাপদ চিকিৎসার পটভূমি গড়ে তুলতে পারে।
স্থানীয় উৎপাদন বাড়লে শুধু আমদানির ওপর নির্ভরতা কমবে না, অর্থনীতি ও শিল্প শ্রমশক্তিও গঠিত হবে। এ ধরনের ‘হেলথ মেক-ইন-বাংলাদেশ’ মডেল রোগ নিরাময় শক্তিশালী করবে।
কীভাবে সার্বজনীন সাশ্রয়ী মূল্যনীতিতে পৌঁছানো যায়? এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা কয়েকটি সুপারিশ করেছেন। যেমন- শুল্ক ও কর অব্যাহতি দেওয়া যেতে পারে। সরকারকে মেডিকেল ডিভাইস আমদানির ওপর নির্ধারিত শুল্ক এবং অ্যাডভান্স টেক্স কমিয়ে দিতে হবে, বিশেষত রোগ-সংবেদনশীল যন্ত্রপাতি ও জীবনরক্ষাকারী যন্ত্রের ক্ষেত্রে।
এ ছাড়া প্রয়োজন স্বতন্ত্র আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন। একটি বিশেষ ‘মেডিকেল ডিভাইস আইন’ তৈরি করা দরকার, যা শুধু ওষুধ নয়, মেডিকেল যন্ত্রপাতি-বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে নিয়ন্ত্রণ ও মান নির্ধারণ করবে। ব্যবসায়ীরাও এর দাবি করেছেন।
সেই আইন সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডার (মেডিকেল ডিভাইস আমদানি-বিক্রয়কারী, হাসপাতাল, রোগী প্রতিনিধি, নীতিনির্ধারক)সহ কমিটি গঠন করার প্রস্তাব তুলে আনা যেতে পারে, যাতে কার্যকর নীতি তৈরি ও বাস্তবায়ন করা যায়।
রেজিস্ট্রেশন ফি পুনর্বিবেচনা করা উচিত। যেমন- ব্যবসায়ীদের প্রস্তাব অনুযায়ী, ক্লাস অ-ডিভাইসের জন্য অনেক কম ফি নির্ধারণ করা যায়। ‘রেসিপি অনুমোদন’, ‘ইনডেন্ট অ্যাপ্রুভাল’ এবং এফএসসি সত্যায়ন প্রক্রিয়া সহজ ও দ্রুত করা উচিত, যাতে আমদানির সময় ও খরচ কমে যায়।
জানতে চাইলে ঢাকা আদালতের আইনজীবী শহীদুল্লাহ মিয়া বলেন, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষ ও স্বাস্থ্য নিয়ন্ত্রকরা নিয়মিতভাবে আমদানি এবং বিক্রয় মূল্যের মধ্যে ব্যবধান পর্যবেক্ষণ করতে পরিপূর্ণ কমিটি গঠন করতে পারে। মূল্য তালিকা প্রকাশ বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে, যাতে বাজারে স্বচ্ছতা ও প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পায় এবং মুনাফা অতিরিক্ততায় সীমা আসে।
স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ ডা. নাজমুল হক বলেন, ‘বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যয়ের বড় অংশ আসে মেডিকেল ডিভাইস থেকে। আমরা যদি যন্ত্রপাতির দাম কমাতে পারি, তাহলে সাধারণ মানুষের চিকিৎসা ব্যয় কমে যাবে। শুল্ক কমানো, রেজিস্ট্রেশন ফি হ্রাস এবং স্থানীয় উৎপাদন বাড়ানো- এই তিনটি পদক্ষেপই সবচেয়ে জরুরি।’
ডা. সেলিনা রহমান বলেন, ‘অনেক উন্নত যন্ত্রপাতি আমরা চাইলেও কিনতে পারি না কারণ দাম অত্যন্ত বেশি। শিশু চিকিৎসায় নির্ভুল ডায়াগনস্টিক না হলে শিশুর জীবন ঝুঁকিতে পড়ে। তাই মেডিকেল ইকুইপমেন্ট সহজলভ্য করা শুধু অর্থনীতির বিষয় নয়, এটি শিশুদের জীবন রক্ষার প্রশ্ন।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকার বাইরের একটি সরকারি হাসপাতালের প্রশাসক বলেন, ‘বিভাগীয় শহর ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে রোগীর চাপ অত্যন্ত বেশি কিন্তু যন্ত্রপাতির ঘাটতি নিয়মিত। নীতি-নির্ধারকরা যদি জেলা পর্যায়ে আলাদা বাজেট ও কর ছাড় দেন, তাহলে আমরা দ্রুত ডায়াগনস্টিক সরঞ্জাম বাড়াতে পারব। এতে রোগীকে ঢাকা বা বিদেশে ছুটতে হবে না।’
ইঞ্জিনিয়ার রাশেদ মাহমুদ বলেন, ‘আমরা অনেক যন্ত্রপাতি দেশেই তৈরি করতে পারি, কিন্তু কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক বেশি হওয়ায় উৎপাদন ব্যয় বাড়ে। সরকার যদি কাঁচামালে আরও কর সুবিধা দেয়, তবে আমরা ৪০-৫০ শতাংশ কম দামে স্থানীয়ভাবে মানসম্মত ডিভাইস তৈরি করতে পারব।’
রোগী অধিকার কর্মী ও ভোক্তা প্রতিনিধি রুবাইয়া আক্তার বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘একটি সিটি-স্ক্যান বা গজও টেস্টের খরচ অনেক পরিবারের জন্য দুঃস্বপ্ন। যন্ত্রপাতির দাম কমলে টেস্টের খরচও কমবে। সাধারণ মানুষকে সেবা দিতে হলে প্রথম কাজ- যন্ত্রপাতির দাম কমানো।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মেডিকেল ডিভাইস আমদানিকারক বলেন, ‘ঔষধ ও কসমেটিকস আইনে ডিভাইসকে ওষুধের মতো নিয়ন্ত্রণ করায় আমদানির প্রক্রিয়া দীর্ঘ হয়, ব্যয়ও বাড়ে। আমরা চাই একটি স্বাধীন ‘মেডিকেল ডিভাইস আইন’, যাতে দ্রুত আমদানি ও সাশ্রয়ী মূল্য নিশ্চিত করা যায়।’
এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট এক ব্যবসায়ী জানান, ‘সরকার ও শিল্প নীতিমালার মধ্যে সহযোগিতা বাড়াতে হবে: কম সুদে ঋণ, ভ্যাট বা কর সুবিধা, প্রযুক্তি স্থানান্তর সহায়তা ইত্যাদির মাধ্যমে। কাঁচামালের আমদানিতে শুল্ক হ্রাসের পাশাপাশি স্থানীয় যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারকদের জন্য ইনফ্রাস্ট্রাকচার বৃদ্ধির প্রয়োজন- যেমন পরীক্ষাগার, ক্যালিব্রেশন ল্যাব, গবেষণা কেন্দ্র। দীর্ঘমেয়াদি নীতি পরিকল্পনা (ডিভাইস শিল্প নীতি) তৈরি করা যা আগামী দশকে যন্ত্র তৈরিতে স্বনির্ভরতা বাড়ানোর লক্ষ্যে কাজ করবে।’
রোগী ও সাধারণ জনগণকে জানানো উচিত তাদের স্বাস্থ্য-যন্ত্রপাতি অধিকার ও মূল্য-নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া সম্পর্কে। রোগী সংগঠন, এনজিও ও সেবা-প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে মূল্যাভিযোগ ও প্রাপ্যতা বিষয়ক রিপোর্ট ও কমিউনিটি পর্যবেক্ষণ গঠন করা যেতে পারে।
স্বাস্থ্যসেবা একটি মৌলিক মানবাধিকার এবং এতে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি শুধু একটি প্রযুক্তিগত উপাদান নয়- এগুলো রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার ভিত্তি। যদি মেডিকেল ইকুইপমেন্টের দাম অসাধ্য হয়ে যায়, তাহলে উন্নত চিকিৎসা সেবা শুধু ধনী ও মধ্যবিত্তের জন্য সীমিত হয়ে যাবে, যা বাংলাদেশের সমাজে স্বাস্থ্যবৈষম্যকে আরও গভীর করবে।
সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই, এখন সময় এসেছে: সরকার, শিল্প, নীতি-নির্ধারক ও জনসাধারণ মিলিতভাবে কাজ করে মেডিকেল যন্ত্রপাতিকে সাশ্রয়ী ও ন্যায্যমূল্যে নাগালযোগ্য করে তুলুক। এটি শুধু রোগীদের জন্য নয়- সমগ্র দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করার একটি অপরিহার্য পথ।

