কওমি শিক্ষার পাশাপাশি হোমিওপ্যাথি; সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত
খন্দকার জাহাঙ্গীর হুসাইন
প্রকাশ: ২৬ নভেম্বর ২০২৫, ১৩:৫৬
বাংলাদেশের সামাজিক ও ধর্মীয় কাঠামোতে কওমি মাদরাসাসমূহ এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা-ধারা। এখানে কোরআন-হাদিস, আরবি সাহিত্য, ফিকহ ও তাকমীল পর্যায়ের গভীর জ্ঞান অর্জন করে প্রতি বছর বহু তরুণ আলেম সমাজে অবতীর্ণ হন। কিন্তু একটি বাস্তব সংকট অস্বীকার করা যায় না- যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তাদের জন্য পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয় না। ইমাম, মুয়াজ্জিন, শিক্ষক অথবা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান–সংক্রান্ত কিছু নির্দিষ্ট চাকরি ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রই কওমি শিক্ষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বা উন্মুক্ত নয়। ফলে এ বিপুল সংখ্যক শিক্ষিত ও নৈতিকভাবে যোগ্য মানুষের আর্থিক স্বাবলম্বন নিশ্চিত করা পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র- সব ক্ষেত্রে একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দেয়।
অন্যদিকে, স্বাস্থ্যসেবার চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। বিশেষ করে প্রাথমিক ও সাশ্রয়ী চিকিৎসার দিকে মানুষের ঝোঁক আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি। ঠিক এই জায়গাটিতেই একটি বাস্তবসম্মত সমাধান হিসেবে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাশাস্ত্র গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কম খরচে, সহজ প্রশিক্ষণে এবং স্বল্প মূলধনে এটি একটি উদ্যোক্তা-ভিত্তিক পেশা গড়ে দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে। কওমি আলেমদের নৈতিকতা, মানুষের প্রতি আন্তরিকতা এবং সমাজ নেতৃত্বের অভিজ্ঞতা থাকায় হোমিওপ্যাথিকে তারা সহজেই কার্যকর কর্মক্ষেত্রে রূপ দিতে পারেন। এই সম্পাদকীয়তে আমরা দেখব—কেন হোমিওপ্যাথি কওমি আলেমদের জন্য এক বাস্তবমুখী কর্মক্ষেত্র হতে পারে, কীভাবে এটি ইসলামী নৈতিকতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং এর মাধ্যমে সমাজে কী ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে। একজন আলেম শুধু একজন ব্যক্তি নন- তিনি বহু মানুষের নৈতিক ও সামাজিক দিকনির্দেশনার উৎস। তার আর্থিক অস্থিরতা পরিবার, সমর্থিত ছাত্রসমাজ এবং সামাজিক দায়িত্বপালনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। তাই কর্মসংস্থানের বিকল্প পথ খুঁজে বের করা জরুরি। এই জরুরতার প্রেক্ষিতে হোমিওপ্যাথি একটি কার্যকর সমাধান হয়ে দাঁড়াচ্ছে; কারণ এটি শেখা সহজ, ব্যয় সামান্য এবং উপার্জনের দ্বার উন্মুক্ত।
১। হোমিওপ্যাথি : প্রাকৃতিক পদ্ধতির সহজ স্বাস্থ্যসেবা
হোমিওপ্যাথি প্রায় দুই শতাব্দী ধরে বিকশিত প্রাকৃতিক চিকিৎসাপদ্ধতি। এতে ব্যবহৃত ওষুধের মূল উৎস গাছপালা, ভেষজ উপাদান ও প্রাকৃতিক বস্তু- যা মানবদেহের প্রতিরোধক্ষমতা বাড়িয়ে রোগমুক্তির পথ সহজ করে।
এই চিকিৎসাপদ্ধতির কয়েকটি বৈশিষ্ট্য কওমি-শিক্ষিতদের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী-
(ক) শেখার প্রক্রিয়া সহজ। হোমিওপ্যাথিতে তেমন জটিল ল্যাব বা অস্ত্রোপচার-ভিত্তিক জ্ঞান প্রয়োজন হয় না। তত্ত্ব ও ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ নিয়ে দ্রুতই এটি আয়ত্ত করা যায়।
(খ) রোগী সেবার নৈতিকতা ও আন্তরিকতা। আলেমদের যে ধৈর্য, আন্তরিকতা, মানুষের প্রতি সদাচরণ এবং সহমর্মিতা থাকে- তা একজন ভালো চিকিৎসকের অতি প্রয়োজনীয় গুণ।
(গ) ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম। মানুষ স্বাভাবিকভাবেই নিরাপদ ও প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে চিকিৎসা নিতে স্বস্তি অনুভব করে। এ কারণে রোগীদের আস্থা বৃদ্ধিও সহজ হয়।
(ঘ) স্বল্প খরচে চেম্বার স্থাপন। একটি টেবিল, চেয়ার, ওষুধের কিছু স্টক- এই সীমাবদ্ধ উপকরণ দিয়েই একটি চেম্বার শুরু করা যায়। এতে ভাড়াব্যয়ও কম।
(ঙ) স্বাধীনভাবে উদ্যোগ গড়ার সুযোগ। চাকরির ওপর নির্ভর না করে নিজস্ব উদ্যোগে কর্মসংস্থান তৈরির সুযোগ সৃষ্টি হয়। অনেকেই বাসার একটি রুমকে চেম্বার হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। খেদমতের পাশাপাশি অতিরিক্ত আয়ের মাধ্যম হিসাবেও এটি মানানসই। এই বাস্তবতার কারণে কওমি আলেমদের মধ্যে হোমিওপ্যাথির প্রতি আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে।
২। ইসলামী নৈতিকতার সাথে হোমিওপ্যাথির সামঞ্জস্য
একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো- হোমিওপ্যাথি ইসলামী মূল্যবোধের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না? ইসলামী নৈতিকতা তিনটি বিষয়ে গুরুত্ব দেয়- মানুষকে উপকার করা, ক্ষতি থেকে বাঁচানো এবং শরীয়তসম্মত উপায়ে উপার্জন নিশ্চিত করা। হোমিওপ্যাথিতে এসব শর্ত অক্ষুণ্ন থাকে।
(ক) উপাদান প্রাকৃতিক : ভেষজ ও প্রাকৃতিক উপাদানের ব্যবহারে কোনো নিষিদ্ধ বা ক্ষতিকর দ্রব্য থাকে না। ফলে শরীয়তসিদ্ধতার প্রশ্ন ওঠে না।
(খ) প্রতারণা বা অযথা মৃত্যুঝুঁকি নেই : হোমিওপ্যাথির ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সাধারণত খুব কম। সঠিক জ্ঞান থাকলে চিকিৎসায় ঝুঁকি কম থাকে।
(গ) নৈতিক চিকিৎসা প্রদান সহজ : আলেমরা ধর্মীয় নৈতিকতায় সুদৃঢ় হওয়ায় চিকিৎসায় স্বচ্ছতা ও সততা বজায় থাকে। রোগীর অবস্থা বুঝে সঠিক পরামর্শ দেয়া ইসলামের অংশ।
(ঘ) দয়া ও মানবসেবার আদর্শ বজায় থাকে : অসুস্থ মানুষকে সেবা দেয়া ইসলামে অত্যন্ত মূল্যবান কাজ- হোমিওপ্যাথি শেখা ও প্রয়োগের মাধ্যমে আলেমরা এটি বাস্তবে প্রয়োগ করতে পারেন।
৩। কওমি মাদরাসা ও হোমিওপ্যাথির সমন্বয়ে সম্ভাবনা
এখন প্রশ্ন- হোমিওপ্যাথিকে কওমি শিক্ষাজগতের সাথে কীভাবে যুক্ত করা যায়?
(ক) মাদরাসার পাঠ্যক্রমে মৌলিক স্বাস্থ্যশিক্ষা : চিকিৎসার প্রাথমিক ধারণা, রোগ শনাক্তকরণ, স্যানিটেশন ইত্যাদি বিষয় যুক্ত করা যায়।
(খ) স্বল্পমেয়াদি হোমিওপ্যাথি ট্রেনিং : তাকমীল শেষে বা দাওরায়ে হাদিসের পাশাপাশি অনেকে সংক্ষিপ্ত সময়ের প্রশিক্ষণ নিতে পারেন।
(গ) মাদরাসায় হেলথ কর্নার চালু করা : মসজিদ-মাদরাসায় ছোট স্বাস্থ্যকেন্দ্র খুলে নেয়া যায়, যেখানে একজন প্রশিক্ষিত আলেম রোগী দেখতে পারেন।
(ঘ) সমাজে আস্থাভিত্তি বৃদ্ধি : আলেমদের প্রতি মানুষের আস্থা বেশি হওয়ায় চিকিৎসা পেতে তারা দ্রুত এগিয়ে আসে- এটি পেশার সাফল্যে অন্যতম শক্তি।
(ঙ) দাওয়াত ও সেবার সমন্বয় : রোগীকে চিকিৎসা দিতে গিয়ে ঈমান-আখলাক সম্পর্কিত শিক্ষা দেয়ার সুযোগও তৈরি হয়। এতে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আসে।
৪। অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা ও সামাজিক শক্তিশালীকরণ
একজন কওমি আলেম যখন আর্থিকভাবে স্থিতিশীল হন, তখন তার সামাজিক ভূমিকা আরও শক্তিশালী হয়। অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা তিনটি দিক থেকে প্রভাব ফেলে।
(ক) পরিবারে আর্থিক নিশ্চয়তা : পরিবারের মৌলিক চাহিদা পূরণ হয়। সন্তানদের আধুনিক শিক্ষা নিশ্চিত করা সহজ হয়।
(খ) মসজিদ-মাদরাসায় দায়িত্ব পালনে স্বাচ্ছন্দ্য। অর্থসংকট না থাকলে ধর্মীয় কাজগুলো আন্তরিকতার সাথে পালন করা যায়।
(গ) সামাজিক নেতৃত্ব বৃদ্ধি : আর্থিকভাবে দুর্বল একজন আলেমের কথা সমাজে ততটা প্রভাব ফেলে না; কিন্তু স্বাবলম্বিতা তার কণ্ঠকে শক্তিশালী করে। হোমিওপ্যাথির মাধ্যমে এ তিনটি দিকেই উন্নতি ঘটানো সম্ভব।
৫। জাতীয় পর্যায়ে প্রভাব ও সম্ভাবনা
যদি কওমি আলেমদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ হোমিওপ্যাথির মতো নিরাপদ ও মানবিক চিকিৎসাপদ্ধতিতে যুক্ত হয়, তাহলে জাতীয় পর্যায়েও কয়েকটি ইতিবাচক সুবিধা দেখা দেবে।
(ক) গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবায় উন্নতি : বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে চিকিৎসক সংকট ব্যাপক। হোমিও চিকিৎসক এ ঘাটতি কিছুটা পূরণ করতে পারেন।
(খ) যুবসমাজের উদ্যোক্তা বৃদ্ধি : আলেমদের উদ্যোগ দেখে অন্যান্য তরুণও উদ্যোক্তা হওয়ার দিকে ঝুঁকবে, যা দেশের অর্থনীতিতে নতুন প্রবাহ সৃষ্টি করবে।
(গ) ধর্মীয় ও সামাজিক নেতৃত্বের মধ্যে ভারসাম্য তৈরি : আলেম সমাজ শুধু দীন শেখানোতেই সীমাবদ্ধ না থেকে বাস্তব সমাজসেবায় যুক্ত হলে সামাজিক ঐক্য বাড়ে।
(ঘ) সুশাসন ও নৈতিকতার চর্চা বৃদ্ধি : নৈতিকভাবে দৃঢ় মানুষের হাতে স্বাস্থ্যসেবা থাকলে রোগীরা আস্থা পায়; চিকিৎসায় প্রতারণা, অতিরিক্ত বিল বা বাণিজ্যিকতা কমে।
৬। চ্যালেঞ্জ ও করণীয়
হোমিওপ্যাথি যতই উপযোগী হোক, কিছু চ্যালেঞ্জ আছে- পর্যাপ্ত মানসম্পন্ন প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। চিকিৎসায় অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস দেখানো যাবে না। জটিল রোগে রোগীকে সময়মতো। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে পাঠাতে হবে। ওষুধ ব্যবহার হতে হবে। বৈজ্ঞানিক নিয়মে। নিজেকে নিয়মিত আপডেট রাখতে হবে। এসব মেনে চললে এই পেশা অত্যন্ত সফল এবং গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারে।
কওমি শিক্ষার উদ্দেশ্য শুধু ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন নয়- বরং নৈতিকভাবে সঠিক, মানবসেবায় নিবেদিত, সমাজের উন্নয়ন-সাধনে প্রস্তুত মানুষ তৈরি করা। অপরদিকে হোমিওপ্যাথি একটি প্রাকৃতিক, স্বাস্থ্যসম্মত ও সাশ্রয়ী চিকিৎসাপদ্ধতি, যা মানুষের কষ্ট লাঘবে সহায়ক। এই দুই ক্ষেত্রের সমন্বয় কওমি আলেমদের জন্য যেমন এক নতুন দিগন্ত খুলে দেয়, তেমনি সমাজের সাধারণ মানুষের কাছেও এটি আস্থার একটি সেতুবন্ধন গড়ে তোলে।
কওমি আলেমদের শ্রম, সততা, জ্ঞানের গভীরতা এবং সমাজসেবার মনোভাব- সবকিছু মিলিয়ে তারা হোমিওপ্যাথির মতো একটি মানবিক পেশায় বিশেষভাবে সফল হতে পারেন। এটি শুধু ব্যক্তিগত উপার্জনের পথ নয়; বরং জাতির স্বাস্থ্যসেবা–ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার একটি শান্ত ও সুন্দর উদ্যোগ।
এক কথায়- কওমি আলেমদের জন্য হোমিওপ্যাথি কেবল একটি কর্মসংস্থান নয়, বরং সমাজনির্মাণের একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক, হেমায়েতপুর, সাভার, ঢাকা

