ট্রাম্পের সফর ঘিরে তিন আরব দেশের কূটনৈতিক দৌড়ঝাঁপ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ১২ মে ২০২৫, ১১:১৫

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প /ছবি : সংগৃহীত
তিনটি তেল-সমৃদ্ধ উপসাগরীয় আরব দেশ এখন নিজেদের মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে গড়ে তোলা প্রভাবকে বাস্তব সুফলে রূপ দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরে উপসাগরীয় তিন দেশ সফরের আগে দেশগুলো নানা পরিকল্পনায় ব্যস্ত।
সৌদি আরব, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) – এই তিন দেশই ট্রাম্পের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তুলেছে এবং মার্কিন অর্থনীতিতে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। একইসঙ্গে, তারা নিজেদের ট্রাম্পের জন্য মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউক্রেন ও ইরান পর্যন্ত একাধিক সংকটের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে।
ট্রাম্পের প্রতি আনুগত্যের পুরস্কার হিসেবে তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরের গন্তব্য হিসেবে বেছে নিয়েছেন উপসাগরীয় এই তিন দেশকে। মঙ্গলবার সৌদি আরবে অবতরণের মধ্য দিয়ে শুরু হবে সফর, এরপর যাবেন কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে। সফর শেষ হবে ১৬ মে।
ট্রাম্পের ‘লেনদেনভিত্তিক’ বৈদেশিক নীতির ধরন বিবেচনায় এই দেশগুলো অনেক কিছু দিতে প্রস্তুত।
‘ট্রাম্পের দৃষ্টিতে উপসাগরীয় দেশগুলো সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ’, বলছেন বাহরাইনের ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের মধ্যপ্রাচ্য নীতিবিষয়ক জ্যেষ্ঠ গবেষক হাসান আলহাসান। তার ভাষায়, ‘তারা ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, আর মার্কিন অস্ত্র কিনতে বিপুল অর্থ ব্যয় করে।’
এই সুপরিকল্পিত কৌশলের পেছনে মূল লক্ষ্য – নিজেদেরকে যুক্তরাষ্ট্রের অনিবার্য নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক অংশীদার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। আর এর বদলে যতটা সম্ভব সুবিধা আদায় করে নেওয়া।
বাইডেন প্রশাসনের সময়ে নিজেদের প্রয়োজনকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি বলেই মনে করে উপসাগরীয় দেশগুলো। তাই তারা সামরিক, প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও বৈচিত্র্য আনতে চেয়েছিল। এখন ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তনকে তারা ‘একবারের জন্য পাওয়া সুযোগ’ হিসেবে দেখছে।
আবুধাবিভিত্তিক এমিরেটস পলিসি সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি এবতেসাম আল কেতবি বলেন, ‘এটাই সময় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করার, এমনকি বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের কাছ থেকে আরও বেশি সুবিধা আদায়ের।’
নিরাপত্তা চুক্তিই সৌদি আরবের মূল লক্ষ্য
সৌদি আরব ও উপসাগরের অন্যান্য দেশগুলোর প্রধান চাওয়া– ‘নিরাপত্তা, নিরাপত্তা এবং নিরাপত্তা’, বলছেন সৌদি রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক আলি শিহাবি।
তার মতে, ‘তারা যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে উপসাগরের স্থিতিশীলতা রক্ষায় নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতি চাইছে। ট্রাম্প অনেক বিষয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন, তাই তারা চান তাকে সম্পৃক্ত রাখার উপায় খুঁজে বের করতে।’
গত বছর যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব একটি প্রতিরক্ষা ও বাণিজ্য চুক্তির চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল। তবে চুক্তিটি থেমে যায় সৌদির একটি শর্তে—ইসরায়েলকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে।
এ ছাড়া সৌদি আরব একটি বেসামরিক পারমাণবিক কর্মসূচির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা চায়। তবে নিজ দেশে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার ইচ্ছার কারণে বিষয়টি আটকে আছে, যা যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের কাছে উদ্বেগের কারণ।
তবে যদি ট্রাম্প সৌদি পারমাণবিক প্রকল্পে সমর্থন দেন, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোর জন্য তা হতে পারে একটি লাভজনক সুযোগ।
মার্চে ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘সৌদি আরব যদি যুক্তরাষ্ট্রে এক ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে, তবে আমি সেখানে যাব।’ সৌদি সরকার যদিও এই অঙ্ক নিশ্চিত করেনি, তবে জানুয়ারিতে তারা যুক্তরাষ্ট্রে আগামী চার বছরে ৬০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা ঘোষণা করে।
তবে এই বিনিয়োগের জন্য অর্থ লাগবে, যার বড় উৎস তেল। আর তেলের দাম কমে যাওয়ায়, বিশেষ করে ট্রাম্পের শুল্কনীতির কারণে, সৌদির এই রূপান্তর পরিকল্পনা হুমকির মুখে পড়ছে। অথচ ট্রাম্প চান তেলের দাম কমুক, যা সৌদির উচ্চ রাজস্ব চাওয়ার বিপরীত।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় নেতৃত্বের স্বপ্ন আরব আমিরাতের
ইউএই অর্থনৈতিক বিনিয়োগকে মার্কিন সম্পর্কের মূল ভিত্তি হিসেবে দেখছে। ইতোমধ্যে তারা যুক্তরাষ্ট্রে এক ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে এবং ভবিষ্যতে আরও ট্রিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
আল কেতবি বলেন, ‘বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানোই হচ্ছে কৌশলগত অংশীদারত্ব দৃঢ় করার উপায়। যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়, আর একইসঙ্গে তাদের অর্থনীতি উপসাগরের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।’
মার্চে ইউএই ঘোষণা দেয়, আগামী ১০ বছরে এআই, সেমিকন্ডাক্টর, উৎপাদন ও জ্বালানি খাতে ১.৪ ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে। এ লক্ষ্য অর্জনে তাদের দরকার মার্কিন মাইক্রোচিপ।
বাইডেন প্রশাসন যেসব এআই রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ জারি করেছিল, সেগুলো ১৫ মে থেকে কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। ইউএই তাদের মধ্যে একটি। তবে বৃহস্পতিবার ট্রাম্প প্রশাসন ঘোষণা দিয়েছে, তারা বাইডেন যুগের কিছু রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা বাতিল করবে।
কূটনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে জায়গা চায় কাতার
কাতার উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সবচেয়ে প্রাতিষ্ঠানিক নিরাপত্তা সম্পর্কযুক্ত। সেখানে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটি, যা মার্কিন সামরিক অভিযানে অপরিহার্য হিসেবে বিবেচিত।
গত বছর ওয়াশিংটন চুপিসারে এই ঘাঁটিতে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি আরও ১০ বছর বাড়ানোর চুক্তি করে। ১৯৯২ সালের প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তিও সংশোধন করে আরও শক্তিশালী করা হয়েছে দ্বিপক্ষীয় নিরাপত্তা সম্পর্ক।
২০২২ সালে বাইডেন প্রশাসন কাতারকে ‘মেজর নন-ন্যাটো অ্যালাই’ ঘোষণা করে, যা মার্কিন সামরিক অংশীদারদের দেওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্মানসূচক উপাধি।
গাজা যুদ্ধ থেকে আফগানিস্তান – নানা সংকটের মধ্যস্থতায় কাতারের ভূমিকা ওয়াশিংটনের কাছে তাদের গুরুত্ব বাড়িয়েছে। আলহাসান বলেন, ‘এই মধ্যস্থতা কৌশলই উপসাগরীয় দেশগুলোকে ট্রাম্পের এজেন্ডার অংশীদার হিসেবে উপস্থাপন করছে।’
এ ছাড়া সিরিয়ার নতুন প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারার সঙ্গে কাতারের সম্পর্ক রয়েছে। ট্রাম্পের সফরে কাতার চাইবে যুক্তরাষ্ট্র যেন ‘সিজার অ্যাক্ট’-এর আওতায় সিরিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। কাতার জানিয়ে দিয়েছে, মার্কিন অনুমোদন ছাড়া তারা সিরিয়াকে কোনো আর্থিক সহায়তা দেবে না।
লাভজনক সুযোগ
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সফর ট্রাম্পের জন্য যেমন লাভজনক চুক্তির সুযোগ, তেমনি উপসাগরীয় দেশগুলোর জন্যও এক নতুন যুগের দরজা।
ইউরেশিয়া গ্রুপের ফিরাস মাকসাদ বলেন, ‘ট্রাম্প এখানে আসছেন কারণ তিনি বিশ্বাস করেন, এসব চুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ও তার নিজস্ব স্বার্থের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাই বড় বড় ঘোষণা আসবে, এমনটা আশা করাই যায়।‘
ওএফ