পশ্চিমবঙ্গের ভোটার তালিকায় কি অমুসলিমরাই বেশি বাদ পড়েছেন?
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ২১ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:০৫
ভারতের নির্বাচন কমিশন প্রকাশিত পশ্চিমবঙ্গের ভোটার তালিকায় নিবিড় সংশোধন বা এসআইআরের খসড়া তালিকা থেকে যাদের নাম বাদ পড়েছে, তাদের একটা বড়ো অংশ অমুসলিম বলে প্রাথমিক বিশ্লেষণের উঠে এসেছে।
এ তালিকায় থাকা ভোটারদের বলা হচ্ছে ‘আনম্যাপড’। অর্থাৎ যাদের নিজের অথবা পরিবারের কোনও সদস্যের নাম ২০০২ সালের সর্বশেষ এসআইআরে পাওয়া যায়নি।
গোটা রাজ্যে প্রায় ৫৮ লক্ষেরও বেশী মানুষকে খুঁজেই পাওয়া যায়নি – তারা হয় মৃত, নয়তো ঠিকানা বদলিয়েছেন। এর বাইরে আরও প্রায় ৩০ লক্ষ ‘আনম্যাপড’ ভোটারও আছেন বলে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক আগেই জানিয়েছিলেন।
ওই ‘আনম্যাপড’ ভোটারদের তালিকা পুরো এখনও বিশ্লেষণ করা যায়নি। তবে কলকাতা ও কয়েকটি জেলার খসড়া তালিকা বিশ্লেষণ করে গবেষকরা দেখতে পাচ্ছেন যে, যাদের নাম বাদ গেছে, তাদের একটা বড়ো অংশ হিন্দু।
কলকাতা শহরের মুসলমান অধ্যুষিত এলাকাগুলিতেও হিন্দু পদবীধারীদের নামই বেশি সংখ্যায় বাদ গেছে বলে গবেষকরা জানাচ্ছেন। তারা এও বলছেন যে, গ্রামাঞ্চলের তুলনায় কলকাতা, হাওড়া, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, আসানসোলের মতো শহরাঞ্চলেই নাম বাদ পড়া ভোটারের সংখ্যা বেশি।
অন্যদিকে সীমান্তবর্তী যে-সব জেলায় মুসলমান ভোটারের সংখ্যা বেশি, সেখানে নাম বাদ যাওয়া ভোটারের সংখ্যা খুবই কম।
মতুয়া সংখ্যাধিক্য রয়েছে, এমন বিধানসভা অঞ্চলগুলিতে আবার দেখা যাচ্ছে বড়ো সংখ্যায় তাদের নাম ‘আনম্যাপড’ হয়ে আছে।
কিন্তু গবেষকরা এটাও জানাচ্ছেন যে এসআইআরের পরবর্তী ধাপে যখন নথি যাচাই করা শুরু হবে, তখন কত সংখ্যক মানুষ আসলে বাদ পড়ছেন, তার দিকে নজর রাখতে হবে।
প্রাথমিক তথ্য বিশ্লেষণ করে একাধিক গবেষক বলছেন, বিজেপি যে আখ্যান দিত যে বিপুল সংখ্যক অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে চলে এসেছে এবং অনেকগুলি জেলায় ধর্মভিত্তিক জনবিন্যাস বদলে গেছে - তার সঙ্গে এসআইআরের তথ্য মিলছে না।
কলকাতায় হিন্দুদের নামই বেশি বাদ গেছে
ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধনের যে খসড়া তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে, তা বিশ্লেষণ করছেন সমাজ গবেষণা সংস্থা ‘সবর ইনস্টিটিউট’-এর দুই গবেষক অসীন চক্রবর্তী ও সৌপ্তিক হালদার।
তারা কলকাতা শহর ও পার্শ্ববর্তী ২১টি বিধানসভা অঞ্চলের তালিকা খতিয়ে দেখেছেন ইতোমধ্যেই। ওই বিশ্লেষণে তারা দেখছেন যে, মুসলমান অধ্যুষিত নয়, এমন এলাকাতে বিপুল সংখ্যক মানুষের নাম ‘আনম্যাপড’ থেকে গেছে। অর্থাৎ ২০০২ সালের তালিকায় তাদের অথবা পরিবারের কারও নাম ছিল না।
বিধাননগর বিধানসভা আসন, যেটি সল্ট লেক এলাকা, সেখানে সবথেকে বেশি মানুষের নাম বাদ গেছে। মোট ভোটারের ১৪.৫৯ শতাংশ নাম খসড়া তালিকায় নেই। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর ভবানীপুর বিধানসভা এলাকায় ১১.৯৯ শতাংশ মানুষের নাম বাদ গেছে। সবথেকে কম সংখ্যক মানুষের নাম বাদ পড়েছে মহেশতলা বিধানসভা আসনে – মাত্র ৫.৭৮ শতাংশ।
গবেষকরা বলছিলেন যে, কলকাতার তথ্য বিশ্লেষণ করা তাদের পক্ষে সুবিধাজনক হয়েছে, কারণ এখানকার ভোটার তালিকা ইংরেজিতে করা হয়েছে।
অসীন চক্রবর্তীর কথায়, ‘তালিকায় থাকা লক্ষ লক্ষ মানুষের পদবি তো আর এক এক করে খতিয়ে দেখা সম্ভব না। তাই আমরা একটা মেশিন লার্নিং মডেল ব্যবহার করেছি। কিন্তু সেটা আবার শুধু ইংরেজি হরফই শনাক্ত করতে পারে। আমরা তাই আগে ইংরেজি তালিকায় কলকাতার যা আছে, সেগুলোর বিশ্লেষণ করেছি। পুরো রাজ্যের বিশ্লেষণ করতে তাই সময় লাগছে।’
মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলের চিত্রটা কেমন?
‘সবর ইনস্টিটিউট’র ওই দুই গবেষক কলকাতার মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলগুলি নিয়ে পৃথক বিশ্লেষণ করেছেন।
অসীন চক্রবর্তী ও সৌপ্তিক হালদার জানাচ্ছেন, কলকাতার মুসলমান প্রধান অঞ্চল – যেমন বন্দর, পার্ক সার্কাস, রাজাবাজার এবং কসবা অঞ্চলে দেখা যাচ্ছে মুসলমানদের তুলনায় হিন্দুদের নাম বেশি বাদ পড়েছে, অর্থাৎ আনম্যাপডদের তালিকায় আছেন। একমাত্র ব্যতিক্রম মেটিয়াবুরুজ আসনটি।
‘মুসলমান প্রধান মেটিয়াবুরুজ এলাকায় যাদের নাম খসড়া থেকে বাদ গেছে, তার মধ্যে ৫৮.৫২ শতাংশ মানুষ মুসলমান, বাকিরা হিন্দু। আবার কলকাতা বন্দর আসনে যতজনের নাম বাদ গেছে, তার মধ্যে মুসলমান ভোটার ৩৮.৩৪ শতাংশ, অমুসলমান ৬১.৬৫ শতাংশ। কসবা বিধানসভা আসনে বাদ পড়া হিন্দু ভোটার ৭৮.১৪ শতাংশ, আর মুসলমান ভোটার হলেন ২১.৮৬ শতাংশ,’ বলেন ওই দুই গবেষক।
গবেষক অসীন চক্রবর্তী বলেন, ‘কলকাতা শহরে যাদের নাম আনম্যাপড হয়ে আছে, পদবি ধরে আমরা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখছি তাদের একটা বড়ো সংখ্যা হচ্ছে অবাঙালি-হিন্দু। ধরে নেওয়া যেতে পারে যে এরা আসলে অন্য রাজ্য থেকে কলকাতায় কাজ করতে আসা মানুষ – যাদের নাম ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় ছিল না।’
মুসলমান প্রধান জেলায় কত নাম বাদ?
পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান প্রধান জেলার মধ্যে পড়ে মুর্শিদাবাদ আর মালদা। দুটিই আবার ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী জেলা।
এ জেলাদুটিতে এমনিতেই ‘আনম্যাপড’ ভোটারের সংখ্যা খুবই কম। অর্থাৎ এখানকার প্রায় সব বাসিন্দারই ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় হয় নিজের নাম ছিল বা পরিবারের কারও নাম ছিল।
‘সবর ইনস্টিটিউট’র সমাজ গবেষক সাবির আহমেদ বলছেন, ‘রাজ্যের মধ্যে সর্বাধিক মুসলমান ভোটার আছে মুর্শিদাবাদের ডোমকল ও মালদার সুজাপুর আসন দুটিতে। সুজাপুরে মাত্র ০.৫ শতাংশ এবং ডোমকলে ৯.৪ শতাংশ মানুষের নাম আনম্যাপড থেকে গেছে।’
মালদা-মুর্শিদাবাদ অঞ্চলের আরও কয়েকটি বিধানসভা আসনের তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে ভগবানগোলায় ২.৬ শতাংশ, লালগোলাতে ১.১ শতাংশ, সামশেরগঞ্জে এক শতাংশ, রাণীনগরে ০.৯ শতাংশ মানুষের নাম আনম্যাপড হয়ে আছে।
অসীন চক্রবর্তী ও সৌপ্তিক হালদার বলেন, ‘মালদা-মুর্শিদাবাদের মতো মুসলমান অধ্যুষিত জেলা থেকে যখনই মতুয়া অঞ্চলের দিকে নেমে আসা হচ্ছে – যেমন নদীয়া বা উত্তর ২৪ পরগনা, সেখানে আনম্যাপড ভোটারের সংখ্যা বাড়ছে।’
মতুয়ারা পশ্চিমবঙ্গের সর্ববৃহৎ তপশিলি জাতির ভোটার। এদের একটা বড়ো অংশ ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হওয়ার পরে পূর্ব পাকিস্তান থেকে চলে এসেছিলেন। বহু মতুয়া বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও এসেছেন।
সাবির আহমেদের কথায়, ‘বাস্তবে, আনম্যাপড ভোটারদের সর্বাধিক সংখ্যা লক্ষ্য করা গেছে মতুয়া-অধ্যুষিত বলয়ে, কোনো মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় নয়। মতুয়া-অধ্যুষিত বিধানসভা কেন্দ্রগুলিতে আনম্যাপড ভোটারদের গড় ৯.৪৩ শতাংশ - যা রাজ্যের গড় ৩.৯৯ শতাংশের দ্বিগুণেরও বেশি।’
তাদের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, উত্তর ২৪ পরগনা জেলার গাইঘাটায় ১৪.৫১ শতাংশ, বাগদা আসনে ১২.৬৯ শতাংশ, রাণাঘাট উত্তর পূর্ব আসনে ১১.১৯ শতাংশ ভোটার আনম্যাপড হয়ে আছেন। অর্থাৎ ২০০২ সালের ভোটার তালিকার সঙ্গে কোনও যোগসূত্র এরা দেখাতে পারেননি।
অর্থনীতিবিদ ও নাগরিকত্বের গবেষক প্রসেনজিৎ বসুর কথায়, ‘মতুয়া অঞ্চলগুলিতে আনম্যাপড ভোটারের সংখ্যা খুব বেশী, এটা ঠিক। কিন্তু যাচাই করার পর্বে এরা কতজন নথি দেখাতে পারবেন, সেটাও দেখতে হবে।’
মতুয়া ভোট একসময়ে একচেটিয়া ভাবে পেত বামফ্রন্ট। কিন্তু তারপর তৃণমূল কংগ্রেস সেই ভোট ব্যাংকের দখল নেয়। আরও পরে তাতে আবার ভাগ বসিয়েছে বিজেপিও। মতুয়া মহাসংঘের আড়াআড়ি দুটি ভাগ হয়ে গেছে – একটির প্রধান হলেন কেন্দ্রীয় জাহাজ প্রতিমন্ত্রী - বিজেপির শান্তনু ঠাকুর, আর অন্য অংশটির নেতৃত্বে আছেন তৃণমূল কংগ্রেসের সংসদ সদস্য মমতা বালা ঠাকুর।
লাখ লাখ ‘অনুপ্রবেশ’-এর কথা কি ভিত্তিহীন?
বিজেপি এবং হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো অনেকদিন ধরেই দাবি করে আসছে যে, বাংলাদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশ করেছেন এবং নিজেদের নাম ভোটার তালিকায় তুলে ফেলেছেন।
কয়েক বছর আগে থেকে তার সঙ্গে জুড়েছে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের অভিযোগ। সীমান্তবর্তী অঞ্চলে ধর্মভিত্তিক জনবিন্যাসও বদলিয়ে গেছে বলে অভিযোগ করা হত।
বহু বাংলাদেশি এবং অনেক রোহিঙ্গা যে অবৈধ ভাবে পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশ করেন, সেটা ঘটনা। কিন্তু তাদের সংখ্যাটা কত, এ নিয়ে সবসময়েই ধোঁয়াশা থেকেছে।
এ সপ্তাহের গোড়ায় সংসদের নিম্ন কক্ষ লোকসভায় এক লিখিত জবাবে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক জানিয়েছে যে ২০১৪ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে ৭৫২৮ বার অনুপ্রবেশের চেষ্টা হয়েছে এবং ১৮ হাজার ৮৫১ জনকে অনুপ্রবেশের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে।
এবছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১০৪ বার অনুপ্রবেশের চেষ্টা হয়েছে, আটক হয়েছেন ২৫৬৬ জন।
তবে এ সংখ্যাটা অনুপ্রবেশের সময়ে গ্রেফতার হওয়ার। সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলে থাকেন গ্রেফতারি এড়িয়ে আরও বহু মানুষ ভারতে অবৈধভাবে এসে থাকেন।
ভারতের নির্বাচন কমিশন যখন এসআইআরের ঘোষণা দিয়েছিল, তখন তারা একথাও বলেছিল যে একজনও বিদেশি যাতে ভোটার তালিকায় না থাকেন, সেটা নিশ্চিত করতেই এই প্রক্রিয়া চালানো হবে।
অর্থনীতিবিদ ও কংগ্রেস নেতা প্রসেনজিৎ বসু বলেন, ‘বিজেপি যে আখ্যানটা দেওয়ার চেষ্টা করে যে কয়েক কোটি বাংলাদেশি আর রোহিঙ্গা ঢুকে পড়েছে তার সঙ্গে বাস্তবের কোনও মিল যে নেই, সেটা তো এসআইআরেই দেখা গেল। মালদা মুর্শিদাবাদে তো খুব সামান্যই আনম্যাপড দেখা যাচ্ছে - অর্থাৎ তারা ২০০২ সালেও ছিলেন। আবার বিহারে তো কবে নির্বাচন হয়ে গেছে, এখনও পর্যন্ত একজন অনুপ্রবেশকারীকে দেখাতে পেরেছে নির্বাচন কমিশন?’ তথ্যসূত্র-বিবিসি
এমবি

