শীতার্ত মানুষের প্রতি মমতা
রহমতের ধর্ম ইসলামের দাওয়াত
মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
প্রকাশ: ২৭ নভেম্বর ২০২৫, ১৩:২৮
শীতকাল শুধু ঋতুর পরিবর্তন নয়- এটি মানুষের জন্য ইবাদত, সহমর্মিতা ও মানবিকতার অনন্য সুযোগ নিয়ে আসে। শস্য–শ্যামল সুজলা–সুফলা আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ আল্লাহর এক অপার নেয়ামত। ষড়ঋতুর দেশ বলা হলেও বাস্তবে শীত ও গ্রীষ্ম- এই দুই ঋতুই এখন প্রকটভাবে অনুভূত হয়। পবিত্র কুরআনেও আল্লাহ তাআলা শুধু শীত ও গ্রীষ্মের উল্লেখ করেছেন- “তাদের জন্য শীত ও গ্রীষ্মকালের সফরকে সহজ করে দেওয়া হয়েছিল।”- (সূরা কুরাইশ-২)
এ আয়াতের মাধ্যমে বোঝা যায়- শীত-গ্রীষ্ম সবই আল্লাহর হুকুম; আর এসব অবস্থায় তাঁরই ইবাদত করা মানুষের দায়িত্ব। আল্লাহ আরও বলেন- “তিনি রাতকে দিনে প্রবেশ করান এবং দিনকে রাতে প্রবেশ করান; তিনিই সূর্য ও চন্দ্রকে নিয়ন্ত্রণ করেন।- ( সূরা ফাতির-১৩) সুতরাং শীতও আল্লাহর সৃষ্টি- যার মাধ্যমে তিনি আমাদের মানবিকতা যাচাই করেন।
শীত- দরিদ্র মানুষের জন্য এক নীরব দুর্যোগ
শীত আমাদের কারও কাছে আনন্দের বার্তা হলেও দরিদ্র, ছিন্নমূল ও বস্ত্রহীন মানুষের জন্য শীত হলো সবচেয়ে বড় দুর্ভোগ। দেশে ইতিমধ্যে শৈত্যপ্রবাহ ও হিমেল বাতাস তীব্র হয়েছে। অনেক জেলায় শীতের কারণে বৃদ্ধ, শিশু ও দরিদ্র মানুষের কষ্ট অসহনীয় হয়ে উঠেছে। তাদের নেই গরম পোশাক, নেই কম্বল, নেই ন্যূনতম আশ্রয়। রাস্তায় খড়কুটা জ্বালিয়ে আগুন পোহানোই তাদের একমাত্র উপায়। শীতের তীব্রতায় শিশু–বৃদ্ধ মৃত্যুবরণও করছে প্রতিনিয়ত। শীতজনিত রোগ- যেমন জ্বর, নিউমোনিয়া, সর্দি–কাশি, কোল্ড ডায়রিয়া- হারে হারে বাড়ছে। চিকিৎসা, ওষুধপত্র, শীতনিবারক বস্ত্র- সবই তাদের নাগালের বাইরে। এ অবস্থায় সামর্থ্যবানদের দায়িত্ব তাদের পাশে দাঁড়ানো।
অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো- সর্বোত্তম ইবাদত
ইসলাম মানবিকতা, দয়া ও সহানুভূতির ধর্ম। শীতার্ত, ক্ষুধার্ত বা দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়ানোই প্রকৃত মুত্তাকিদের পরিচয়। আল্লাহ বলেন- “পূর্ব-পশ্চিম মুখ ফেরানোতে ধর্ম নয়; বরং প্রকৃত সৎকর্ম হলো- আল্লাহর প্রেমে আত্মীয়স্বজন, এতিম, মিসকিন, অভাবীদের জন্য ব্যয় করা।- ( সূরা আল-বাকারা-১৭৭)
মানবসেবা ও দান সম্পর্কে নবী করিম (সা.)-এর শিক্ষা
নবী করিম (সা.) আমাদের মানবসেবা ও দানের গুরুত্ব অনুধাবন করানোর জন্য বহু হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বস্ত্রদান, খাদ্যদান ও পানি পান করানোর মাধ্যমে মানুষকে সাহায্য করার ফজিলত বিশেষভাবে তুলে ধরেছেন।
১. বস্ত্রদান
যে মুসলমান অন্য মুসলমানকে কাপড় দান করবে, আল্লাহ তাকে জান্নাতে পোশাক পরাবেন।” (সুনান আবু দাউদ- ১৬৭২) একজন মুসলিম ভাই বা বোনের প্রয়োজন মেটানো আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের পথ।
২. খাদ্যদান
যে ক্ষুধার্তকে খাদ্য দান করবে, আল্লাহ তাকে জান্নাতের ফল খাওয়াবেন।(সুনান আবু দাউদ- ২৭৯৪)খাদ্য দিয়ে কারো ক্ষুধা মেটানো কেবল দান নয়, বরং এটি আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পার্থিব ও আখিরাতের সমৃদ্ধির মাধ্যম।
৩. পানি পান করানো
যে তৃষ্ণার্তকে পানি পান করাবে, আল্লাহ তাকে জান্নাতে সিলমোহরকৃত পাত্র থেকে পান করাবেন।-(সুনান আবু দাউদ- ২৭৯৫) মৌলিক মানবিক প্রয়োজন যেমন পানি মেটানোও আল্লাহর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে এবং জান্নাতের সন্মানিত স্থান অর্জনের সুযোগ দেয়।
৪. মানুষের দুর্দশা দূর করার ফজিলত
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে মুমিনের দুনিয়ার একটি কষ্ট দূর করবে, আল্লাহ তাকে কিয়ামতের দিনের কষ্ট থেকে মুক্তি দেবেন।” - (সহিহ মুসলিম-২৬৯৯)
দান-সদকা দ্রুত করা উত্তম
অনেকেই শীত বাড়লে বা প্রচারমাধ্যমে প্রতিবেদন দেখলে দান করেন। অথচ ইসলাম শিক্ষা দেয়- সাহায্য করতে বিলম্ব নয়, বরং দ্রুত এগিয়ে আসতে হবে। রাসুল (সা.) বলেছেন- সর্বোত্তম দান হলো, যখন তুমি সুস্থ ও কৃপণ অবস্থায় দান কর- যখন দারিদ্র্যের ভয় কর এবং ধনী হওয়ার আশা রাখ।- ( সহিহ বুখারি-১৪১৯) অর্থাৎ মৃত্যুসময়ে দান নয়- জীবনের উচ্ছল সময়ে দানই প্রকৃত ঈমানের পরিচয়।
শীত মোকাবিলায় সমাজের দায়িত্ব
শীতের দুর্ভোগ শুধু ব্যক্তিগত দায়িত্ব নয়, এটি সামাজিক দায়বদ্ধতাও। সরকার, সমাজ, সংগঠন, গণমাধ্যম- সবাইকে উদ্যোগী হতে হবে। বিশেষ করে- শীতবস্ত্র বিতরণ, চিকিৎসা–সেবা, ওষুধপত্র সহায়তা, ফুটপাতবাসীদের আশ্রয়, প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিশেষ সেবা ক্যাম্প, সবই এখন জরুরি।মিডিয়া এ বিষয়ে রিপোর্ট করলে সচেতনতা বাড়ে- বিত্তবানরা উদ্বুদ্ধ হয়।
ইসলাম সকল সৃষ্টির প্রতি দয়া শেখায়
মানুষের প্রতি ভালোবাসা, সহানুভূতি ও সাহায্য করা শুধু সামাজিক কর্তব্য নয়- এটি ঈমানের দাবি। নবী করিম (সা.) বলেছেন- “আল্লাহ তাঁর বান্দাকে সাহায্য করেন, যতক্ষণ বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্য করে।”- (সহিহ মুসলিম-২৬৯৯) অর্থাৎ আপনি কারও দুঃখে পাশে দাঁড়ালে আল্লাহ আপনার দুঃখ দূর করবেন।
পরিশেষে বলতে চাই, প্রতি শীতেই অনেক মানুষকে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে দেখা যায়- এটি অবশ্যই প্রশংসনীয়। তবে দানের উদ্দেশ্য যেন কখনো প্রচার–প্রদর্শন না হয়। বরং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিঃস্বার্থভাবে সাহায্য করতে হবে। শীতের তীব্রতা শুরু হওয়ার আগেই শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো উচিত। কারণ, সামান্য একটি কম্বল- কোনো শিশুর প্রাণ বাঁচাতে পারে, কোনো বৃদ্ধের রাতের ঘুম ফিরিয়ে দিতে পারে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে সামর্থ্য অনুযায়ী শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর তাওফিক দিন। আমিন।
লেখক : ইসলাম বিষয়ক গবেষক ও কলামিস্ট

