ইসলাম এমন এক দীন, যার ভিত্তি ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র ও মানবসভ্যতার সকল ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য ন্যায়নীতি ও তাকওয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত। পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্ম, মতবাদ বা দর্শন সময়ের সাথে সাথে রূপান্তরিত বা হ্রাস-বৃদ্ধি পেলেও ইসলামের মৌলিক সত্তা একই থাকে- এতে যোগ-বিয়োগ, পরিবর্তন বা বিকৃতি গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ ইসলাম কোনো ব্যক্তির উদ্ভাবিত মতবাদ নয়; এটি আল্লাহ প্রদত্ত পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যা প্রেরিত হয়েছে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে। আল্লাহ মানুষকে এমনই জীবন ব্যবস্থা দিয়েছেন যেখানে দাসত্ব কেবল আল্লাহরই, কোনো ব্যক্তি বা ব্যবস্থার নয়। এই মৌলিকত্বই ইসলামের প্রকৃত স্বরূপকে অভিন্ন করে রেখেছে পৃথিবীর সবখানে, সব যুগে। আর এই অভিন্নতা মুসলিমজীবনে নিরাপত্তা, বিশ্বাস, সমতা ও নৈতিক দৃঢ়তা এনে দেয়; কোনো বিরোধ, দ্বিধা বা জটিলতা সৃষ্টি করে না। তাই ইসলাম কখনো অঞ্চলভেদে, সভ্যতাভেদে বা সংস্কৃতিভেদে পরিবর্তিত হয় না; এর সার্বজনীনতা মানুষকে একই পথে পরিচালিত করে সত্য, ন্যায়, শান্তি ও মানব মর্যাদার পথে।
তাওহিদ : ইসলামের অভিন্নতম কেন্দ্রবিন্দু
ইসলামের সবচেয়ে মৌলিক ও অভিন্ন ধারণা হলো তাওহিদ- এক আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস। তাওহিদ শুধু আল্লাহ একজন বলেই শেষ হয় না; বরং এই বিশ্বাস মানুষের চিন্তা, মনন, সিদ্ধান্ত, নীতি, সমাজ, রাজনীতি- জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়। একজন মুসলমান যতই ভৌগোলিকভাবে দূরবর্তী অঞ্চলে বাস করুক, তার বিশ্বাস একই: সৃষ্টিকর্তা একজন- তিনি অদ্বিতীয়, অমিত্র, অনন্ত। তাওহিদ মানুষকে দাসত্বমুক্ত করে, কারণ সে তখন কোনো ক্ষমতাবান ব্যক্তি, রাষ্ট্র, প্রথা বা সংস্কৃতির দাস থাকে না। সে হয় কেবল আল্লাহর বান্দা। এই স্বাধীনতা ইসলামের মৌলিকত্বের মূল জ্বালানী। আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ বিশ্বাস মানুষকে অহংকার থেকে দূরে রাখে এবং বিনয়, ন্যায়পরায়ণতা ও মানবিকতার মানদণ্ডে প্রতিষ্ঠিত করে। তাওহিদ যেমন মক্কায়, মদিনায়, বাংলাদেশে বা মরক্কোতে একইভাবে শেখানো হয়, তেমনি মানুষের আত্মার গভীরে একই আলো জ্বালিয়ে দেয়। এই অভিন্ন তাওহিদী ধারা ইসলামের গোড়া থেকে আজ পর্যন্ত অটুট রয়েছে; কখনো দুর্বল হয়নি, কখনো পরিবর্তনের পথে হাঁটেনি। তাই ইসলামের মৌলিকত্বের কেন্দ্রে তাওহিদই সেই আলো, যা সব যুগের মুসলমানকে একই চেতনায় বাঁধে।
নবুয়ত ও গ্রন্থ : ইসলামের অপরিবর্তনীয় শিক্ষা
ইসলামের মৌলিকত্বকে অভিন্ন রাখার আরেক মহাশক্তি হলো নবুয়ত ও কোরআনের শিক্ষা। কোরআন কোনো ঐতিহাসিক দলিল নয়; এটি আল্লাহর কালাম, যা কিয়ামত পর্যন্ত মানুষের জন্য দিশা, বিধান, উপদেশ ও আইন। পৃথিবীর কোনো ভাষা, উপজাতি, দেশ বা সভ্যতা এটিকে পরিবর্তন করতে পারে না। কোরআন যেমন ১৪০০ বছর আগে আরবের মরুভূমিতে ছিল, আজও ঠিক তেমনি অক্ষুণ্ন- এক বর্ণও নষ্ট হয়নি। মহা নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সুন্নাহও একইভাবে সংরক্ষিত, যা ইসলামের শিক্ষা-ব্যবস্থায় সর্বত্র একই। পৃথিবীর পূর্ব-পশ্চিমে কোনো মুসলিম বলবে না যে তার নবী দুইজন, বা কোরআন একাধিক; কারণ নবুয়ত ও কোরআন ইসলামের অভিন্ন ভিত্তি স্থাপন করে। এই অভিন্ন ভিত্তিই মুসলিম উম্মাহকে বিভাজিত হতে দেয় না, বরং একক আলোকিত পথে পরিচালিত করে। এই ব্যবস্থায় মানুষ দয়ার শিক্ষা পায়, সৎ কাজের প্রতি উৎসাহ পায়, আর নিষিদ্ধ কাজ থেকে দূরে থাকে। নবুয়তের এই সার্বজনীনতা ইসলামের মৌলিক মূল্যবোধকে যুগে যুগে নবীন, সতেজ ও রক্ষিত রেখেছে।
ইবাদত ও বিধান : সময়ের পরিবর্তনে অটুট
ইসলামের ইবাদত ব্যবস্থা- যেমন নামাজ, রোজা, জাকাত, হজ- কোনো যুগে পরিবর্তন হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। নামাজ পাঁচ ওয়াক্ত- অবিচল। রমজানের রোজা- চিরন্তন বিধান। জাকাতের হিসাব- কোরআনে নির্ধারিত। হজ- ইবরাহিম (আ.)-এর স্মৃতি বহন করে এবং এক রকমেই পালন করা হয়। পৃথিবীর পুরো মুসলিম জনগোষ্ঠী একই সময়ে একই কাঠামোতে এই ইবাদত পালন করে, যা ইসলামের মৌলিকত্বকে অভিন্ন রাখার অনন্য উদাহরণ। কোনো ধর্মীয় নেতা, রাজনৈতিক শাসক, পণ্ডিত, কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান এই বিধান বদলাতে পারে না। কারণ এসব বিধান আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত। ইবাদতের এই একত্ব মুসলিমদের মাঝে অটুট আধ্যাত্মিক সংহতি তৈরি করে- তাদের হৃদয়-চিন্তা-আচরণে এক ধরনের ঐক্যবদ্ধতা সৃষ্টি করে। ইসলামে এই মৌলিক ইবাদত ব্যবস্থাই প্রমাণ করে যে ইসলাম সংস্কৃতি-নির্ভর নয়; এটি আল্লাহ-নির্ভর একটি জীবনব্যবস্থা। এই অভিন্নতার কারণেই ইসলামের ইবাদত পৃথিবীর যেকোনো স্থানে একই রূপে সৌন্দর্য বিকশিত করে।
নৈতিকতা: মানবতা ও সমতার ভিত্তি
ইসলামের নৈতিকতা সময় বা সমাজের ইচ্ছানুযায়ী পরিবর্তিত হয় না। সত্য বলা, আমানত রাখা, প্রতারণা না করা, গীবত-চুগলি থেকে দূরে থাকা, নারী-পুরুষের শালীনতা রক্ষা, পিতা-মাতাকে সম্মান করা- এসব মূল্যবোধ যেকোনো যুগে একই শক্তিতে বলা হয়। ইসলাম নৈতিকতার এমন এক মানদণ্ড স্থাপন করেছে, যা মানবজাতির সকল বিভ্রান্তিকে দূরে সরিয়ে সত্যিকারের মানবিকতাকে সামনে আনে। একে পরিবর্তন করলে ইসলাম তার মৌলিক রূপ হারাবে; তাই ইসলাম নৈতিকতার ক্ষেত্রে কোনো সমঝোতা করে না। মুসলিম একজন ব্যবসায়ী হলেও সে প্রতারণা করবে না; সে রাজনীতিক হলেও ঘুষ গ্রহণ করবে না; সে বিচারক হলেও পক্ষপাতিত্ব করবে না; কারণ ইসলামের নৈতিক শিক্ষা সর্বদা অভিন্ন। এ কারণেই ইসলাম শুধু একটি আধ্যাত্মিক দীন নয়; এটি মানবধর্ম, ন্যায়ের ধর্ম। ইসলামের এই নৈতিক শক্তিই সমাজকে অশান্তি ও দুর্নীতি থেকে বাঁচিয়ে রাখে। আজও যারা ইসলামের মৌলিক নৈতিকতাকে আঁকড়ে ধরেছে, তারা ব্যক্তিজীবন ও সমাজ উভয় ক্ষেত্রেই আলোর পথ দেখাতে সক্ষম।
শরিয়াহ : ন্যায়ের সর্বজনীন ধারণা
শরিয়াহ ইসলামি আইনব্যবস্থার কেন্দ্রীয় ধারা, যা কোরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে তৈরি। শরিয়াহর মূল লক্ষ্য শাস্তি নয়; বরং মানবকল্যাণ, ন্যায়পরায়ণতা, অধিকার সংরক্ষণ এবং সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা। পিতামাতার অধিকার, নারীর সম্মান, এতিম-দরিদ্রের ন্যায্য অংশ, শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি, প্রতিবেশীর প্রতি দায়িত্ব- এসব শরিয়াহর মূলনীতি পৃথিবীর সব মুসলমানের জন্য সমান। কোনো দেশ, শাসক কিংবা সমাজ শরিয়াহর মূলনীতি বদলাতে পারে না। শরিয়াহর এই অভিন্নতা ইসলামের মৌলিকত্বকে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরে। শরিয়াহ একটি স্থির আদর্শ হলেও এর প্রয়োগে রয়েছে প্রজ্ঞা, নমনীয়তা ও বিচারবুদ্ধির জায়গা। কিন্তু মৌলিক আইন ও মূল্যবোধ- ন্যায়, সততা, সত্যবাদিতা, পবিত্রতা- সব যুগে এক ও অটুট। আজ বিশ্বে যখন নানা আইন বিভিন্ন মতাদর্শের চাপে পরিবর্তিত হয়, তখন ইসলামের শরিয়াহ একই রকম আলো ছড়ায়। মানুষকে অধিকার দেয়, শান্তি দেয় এবং ন্যায়ের পথে পরিচালিত করে।
ইসলামের সামাজিক কাঠামো : বৈচিত্র্যের মাঝে অভিন্নতা
ইসলাম সামাজিক কাঠামোতে বৈচিত্র্যকে স্বীকার করে, কিন্তু মৌলিক মূল্যবোধে কোনো পরিবর্তন হতে দেয় না। বিয়ে, পরিবার, প্রতিবেশী সম্পর্ক, সম্পদ বণ্টন, লেনদেন- এসব বিষয়ে ইসলাম একই নীতি দেয়, কিন্তু প্রয়োগে সমাজভেদে সাংস্কৃতিক কিছু পার্থক্য থাকতে পারে। বাংলাদেশের কোনো মুসলিম যেমন বিয়েতে পাত্র-পক্ষের আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে পারে, তেমনি মরক্কোর মুসলিম ভিন্ন আচার করতে পারে- তাদের সংস্কৃতি ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু নিকাহর শর্ত একই, অধিকার একই। সমাজে অভিন্ন নিয়ম- পিতা-মাতার সম্মান, স্ত্রীর অধিকার, সন্তানের দায়িত্ব, প্রতিবেশীর হক- এসব কখনো পরিবর্তন হয় না। এই অভিন্নতার কারণে ইসলামের সমাজব্যবস্থা বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে একই শান্তিময় কাঠামো তৈরি করে। এটি মানুষকে নৈতিক শক্তি দেয়, পরিবারকে স্বস্তিতে রাখে, সমাজকে কল্যাণমুখী করে তোলে। সমাজ যতই আধুনিক হোক, ইসলামের এই মৌলিক ভিত্তি কখনো নষ্ট হয় না।
অর্থনৈতিক ব্যবস্থা : ন্যায়সঙ্গত, সুদমুক্ত অভিন্ন নীতি
ইসলামের অর্থনীতি সুদের কঠোর নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে এক অভিন্ন ন্যায়ব্যবস্থা তৈরি করেছে। সুদকে আল্লাহ ঘোষণা করেছেন সমাজকে ধ্বংসকারী অন্যায় প্রথা হিসেবে। ইসলামী অর্থনীতি শ্রম, বিনিয়োগ, মুনাফা ও ঝুঁকি ভাগাভাগির উপর ভিত্তি করে। এতে কোনো অন্যায়, শোষণ বা বঞ্চনা নেই। এই নীতি পৃথিবীর সব মুসলিম সমাজেই একই। ইসলাম ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য কমিয়ে আনে জাকাত, সদকা, ফি-সাবিলিল্লাহ খরচ, স্বচ্ছ বাণিজ্য, হালাল আয়- এসব মৌলিক নীতির মাধ্যমে। আজও মালয়েশিয়া, কাতার, সৌদি আরব, পাকিস্তান, বাংলাদেশ; সব ইসলামি অর্থব্যবস্থায় এই নীতিই অভিন্নভাবে প্রয়োগ করা হয়। ইসলাম অর্থনীতিকে শুধু টাকা লেনদেনের বিষয় মনে করে না; এটি নৈতিকতার অংশ মনে করে। হালাল-হারাম, আমানতদারি, ওয়াদা পালন- এসব নীতিই একজন মুসলমানকে সত্যিকারের অর্থনৈতিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে শেখায়। এই অভিন্ন অর্থনৈতিক দর্শন ইসলামকে পৃথিবীর সকল অর্থনৈতিক মতবাদ থেকে আলাদা ও শ্রেষ্ঠ করে দাঁড় করায়।
উপসংহার : ইসলাম তার মৌলিকত্বেই মহান
ইসলাম এমন এক দীন, যা মানুষের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বব্যবস্থায় পূর্ণাঙ্গ প্রভাব বিস্তার করে। এর প্রতিটি শিক্ষা- তাওহিদ, নৈতিকতা, শরিয়াহ, ন্যায়নীতি, ইবাদত, অর্থনীতি, মানবসম্প্রীতি- সবই অভিন্ন, অপরিবর্তনীয় এবং সর্বজনীন। ইসলামের মৌলিকত্বের কারণে বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমান একই পথে, একই বিশ্বাসে, একই নৈতিকতায় জীবনযাপন করতে পারে। কোনো শাসক, প্রথা বা সভ্যতা ইসলামকে পরিবর্তন করতে পারে না; বরং সত্যিকার ইসলাম মানুষের জীবনকে পরিবর্তন করে। আজকের পৃথিবীতে যখন নীতি ভেঙে পড়ছে, সংস্কৃতি বদলে যাচ্ছে, মতাদর্শ টিকে থাকছে না- তখন ইসলাম তার অভিন্ন মৌলিকত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অটুট, শান্তিময়, পরিপূর্ণ এবং আলোকিত এক জীবনব্যবস্থা হিসেবে।
লেখক : কবি, শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক, শিক্ষার্থী, ডিপার্টমেন্ট অব (এসআইপিজি), নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, বসুন্ধরা - ঢাকা, ১২২৯

