ঠান্ডা রাতের উষ্ণ ইবাদত
শীতে তাহাজ্জুদের গুরুত্ব ও ফজিলত
ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
প্রকাশ: ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৩:৪৬
শীতকাল মুসলমানদের জন্য আল্লাহর এক বিশেষ অনুগ্রহ। এই ঋতুতে রাত দীর্ঘ হয়, ঘুম ভাঙা সহজ হয় এবং চারদিকে এমন নীরবতা থাকে, যা মনকে আল্লাহর দিকে একান্তভাবে নিবদ্ধ করে। আলেমরা এ কারণেই শীতকালকে “ইবাদতের ঋতু” হিসেবে অভিহিত করেছেন। বিশেষত তাহাজ্জুদ নামাজ। যা মুমিনের মর্যাদা বাড়ায়, দোয়া কবুলের বিশেষ সুযোগ এনে দেয়।
কোরআনে তাহাজ্জুদের প্রশংসা
১. রাতের নফল ইবাদত মর্যাদা বৃদ্ধি করে: আল্লাহ তাআলা বলেন- রাতের কিছু অংশে জাগ্রত থেকে তাহাজ্জুদ পড়; এটি তোমার জন্য অতিরিক্ত ইবাদত। আশা করা যায় তোমার রব তোমাকে ‘মাকাম মাহমুদ’-এ অবস্থান দান করবেন।- সুরা বনি ইসরাইল: ৭৯
এই আয়াত প্রমাণ করে যে রাতের সালাত বান্দাকে আল্লাহর নিকটে বিশেষ সম্মানের আসনে পৌঁছে দেয়।
২. মুত্তাকীদের গুণ: আল্লাহ বলেন- “তারা রাতের সামান্য অংশ ব্যতীত ঘুমায় না।- (সুরা আয-যারিয়াত: ১৭) এ আয়াতে রাতের সালাত মুত্তাকীদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।
৩. রাতের ইবাদতকারীর মর্যাদা আলাদা: আল্লাহ বলেন- রাতের বেলায় সিজদায় ও দাঁড়িয়ে ইবাদত করে যারা, তারা কি সমান হবে তাদের সাথে যারা তা করে না?- (সুরা আয-যুমার: ৯) রাতের ইবাদত আল্লাহর কাছে বিশেষ মর্যাদার প্রতীক।
হাদিসে তাহাজ্জুদের ফজিলত
১. শেষ রাতে আল্লাহ সবচেয়ে নিকটবর্তী হন: রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন- আমাদের রব প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশে নেমে আসেন এবং ঘোষণা করেন: কে আমাকে ডাকবে, যাতে আমি তার ডাকে সাড়া দিই? কে আমার কাছে চাইবে, যাতে আমি তাকে দিই? কে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে, যাতে আমি তাকে ক্ষমা করি?- (সহিহ বোখারি- ১১৪৫; সহিহ মুসলিম-৭৫৮) এই সময়টি দোয়া কবুলের শ্রেষ্ঠতম সময়।
২. সর্বোত্তম নফল সালাত: নবী (সা.) বলেন- ফরজ নামাজের পর সর্বোত্তম সালাত হলো রাতের সালাত (তাহাজ্জুদ)।- (সহিহ মুসলিম-১১৬৩)
৩. তাকওয়া, গুনাহ মাফ ও রোগ থেকে সুরক্ষা: রাসূল (সা.) বলেন- রাতের কিয়াম ধার্মিকতার চাবিকাঠি, গুনাহের প্রায়শ্চিত্ত এবং শরীরকে রোগ থেকে রক্ষা করে।- (জামে তিরমিজি-৩৫৪)
শীতকালে তাহাজ্জুদের বিশেষ সুবিধা
১. রাত দীর্ঘ হওয়া: শীতে রাত বেশি দীর্ঘ হওয়ায় ঘুমানো এবং আবার উঠা সহজ হয়। ফলে তাহাজ্জুদের জন্য সময় বের করা কঠিন হয় না।
২. শীত মুমিনের বসন্তকাল: অনেক সালাফ বলেছেন- “শীতকাল মুমিনের বসন্তকাল।” কারণ, দিনে রোজা রাখা সহজ। রাতে দীর্ঘ সময় ইবাদত করা সহজ।
ইমাম হাসান বসরি (রহ.) বলেছেন, “শীতের রাত দীর্ঘ, তাই তাহাজ্জুদের জন্য এটি সর্বোত্তম সময়।”
৩. মন ও দেহে প্রশান্তি: শীতের নীরবতা ও ঠান্ডা মনকে সংযত করে। গভীর রাতের ইবাদত মনকে পরিশুদ্ধ করে, হৃদয়ে প্রশান্তি আনে।
তাহাজ্জুদ পড়ার সহজ পদ্ধতি
১. ইশার নামাজের পর কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিন।
২. প্রথমে ২ রাকাত দিয়ে শুরু করুন।
৩. নবী (সা.) অধিকাংশ সময় ৮-১৩ রাকাত পড়তেন।
৪. দীর্ঘ কিরাআত না পারলে সংক্ষিপ্ত সূরা পড়লেও যথেষ্ট।
৫. রাতের শেষ তৃতীয়াংশ লক্ষ্য করুন- এ সময় দোয়া দ্রুত কবুল হয়।
৬. দোয়া করতে ভুলবেন না; এটি তাহাজ্জুদের মূল সৌন্দর্য।
তাহাজ্জুদের সুফল
গুনাহ মাফের বিশেষ সুযোগ। দোয়া কবুলের সম্ভাবনা বৃদ্ধি। হৃদয় নরম হয় ও আত্মশুদ্ধি অর্জিত হয়। হতাশা, দুশ্চিন্তা ও মানসিক চাপ দূর হয়। ইমান শক্তিশালী হয়। কঠিন সমস্যার সমাধানে সহায়তা করে। আল্লাহর বিশেষ রহমত অন্তরে প্রবেশ করে। আধুনিক গবেষণায়ও প্রমাণ হয়েছে- নিশীথের নীরব পরিবেশে আধ্যাত্মিক অনুশীলন মানসিক প্রশান্তি বাড়ায় এবং উদ্বেগ কমায়।
পরিশেষে, শীতকাল ইবাদতের জন্য আল্লাহর এক বিশেষ রহমত। শীতের দীর্ঘ রাত ও ঠান্ডা পরিবেশ একজন মুমিনকে তাহাজ্জুদ পড়ার আদর্শ সুযোগ এনে দেয়। প্রতিদিন না পারলেও সপ্তাহে কয়েক দিন তাহাজ্জুদের জন্য সময় বের করা আমাদের আত্মিক উন্নতি, দোয়া কবুল, মানসিক শান্তি এবং আল্লাহর নৈকট্যের দিকে আরও এগিয়ে দেবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে শীতের রাতগুলোকে তাহাজ্জুদের মাধ্যমে বরকতময় করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক : ইসলাম বিষয়ক প্রবন্ধকার, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি

