ইসলামী নৈতিকতা ও সমাজনীতি- এই দুটি বিষয় আমরা প্রায়ই শুনি, কিন্তু অনেক সময়ই এগুলোকে কেবল কিছু নিয়ম-কানুন হিসেবে দেখি। অথচ এখানেই ভুলটা হয়। ইসলাম আসলে কোনো কঠিন বিধিবিধানের নয়, এটি এক পূর্ণাঙ্গ জীবনদর্শন। এই দর্শনের ভেতরেই লুকিয়ে আছে মানুষের আত্মিক বিকাশের সূত্র, আর সেই আত্মশুদ্ধিই সমাজে শান্তি ও ভারসাম্যের ভিত্তি গড়ে তোলে।
আমার বিশ্বাস, আজকের পৃথিবীর এই অস্থিরতা, যেখানে প্রতিদিন খবরের কাগজ খুললেই আমরা অন্যায়, হিংসা, দুর্নীতি আর অবিচারের গল্প দেখি- সেখানে ইসলামী নৈতিকতার নীতিগুলোই হতে পারত মানুষের জন্য এক বিশাল নিরাপত্তার সুযোগ। যেমন -
১) ব্যক্তিগত ভিতের গুরুত্ব: আত্মশুদ্ধির শুরু
ইসলামী নৈতিকতার যাত্রা শুরু হয় একেবারে নিজের ভেতর থেকে। বাইরে নয়। অন্তর থেকেই। এই যাত্রার প্রথম পাঠ হলো তাওহিদ, অর্থাৎ আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস, এবং আখিরাত, অর্থাৎ পরকালের জবাবদিহিতে বিশ্বাস। যখন একজন মানুষ অন্তর থেকে বিশ্বাস করে যে তার প্রতিটি কাজ, প্রতিটি চিন্তা এক সর্বদ্রষ্টা সত্তার সামনে নথিবদ্ধ হচ্ছে, তখন সে নিজের আচরণের প্রতি অন্যরকম সচেতন হয়ে ওঠে।
আমি প্রায়ই ভাবি, যদি সমাজের প্রতিটি মানুষ এমন অন্তর্দৃষ্টি অর্জন করত, তাহলে কি আমরা এত অনৈতিকতা, মিথ্যাচার, দুর্নীতি দেখতাম? হয়তো না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “তুমি সেই ব্যক্তি হও, যে অন্যের জন্যও সে-ই কামনা করে যা নিজের জন্য চায়।” (সহীহ মুসলিম)। এই বাণী শুধু এক সুন্দর নীতিবাক্য নয়, এটি আসলে মানবতার এক কঠিন পরীক্ষা। নিজের লাভ-ক্ষতির দোলাচলে থেকেও অন্যের কল্যাণ ভাবতে পারা- সেটাই প্রকৃত আত্মশুদ্ধির সূচনা। সত্যবাদিতা, আমানতদারি, এবং ওয়াদা রক্ষা- এই তিনটি গুণ হলো সেই ভিত্তি, যার ওপর দাঁড়িয়ে একজন মানুষ নিজের চরিত্র নির্মাণ করে।
২) সামাজিক ন্যায়বিচার ও ভ্রাতৃত্ব : সমাজের প্রাণস্পন্দন
ব্যক্তিগত নৈতিকতা যত দৃঢ় হয়, সমাজতন্ত্রের ভিত্তি তত শক্ত হয়। ইসলামে সমাজের সম্পর্ক রক্তের নয়, বর্ণেরও নয়- বরং বিশ্বাসের। কোরআনে বলা হয়েছে, “নিশ্চয় মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই।” (সূরা আল-হুজুরাত: ১০)। এই এক শব্দ, ভাই ভাই-আসলে সমাজনীতির প্রাণ। এটি মুখের কথা নয়, এটি বাস্তব জীবনের আচরণে, অন্যায়ের প্রতিবাদে, এবং দুর্বল মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মধ্যেই প্রকাশ পায়।
আমার দৃষ্টিতে ইসলামের সমাজনীতির সবচেয়ে গভীর দিক হলো ন্যায়বিচার (আদল)। বন্ধু হোক বা শত্রু, ধনী হোক বা দরিদ্র, ন্যায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কোনো পক্ষপাতের সুযোগ নেই। কুরআনে আছে: “তোমরা ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠা কর।” (সূরা আন-নাহল, ১৬:৯০)। এই নির্দেশ কেবল প্রতিটি মানুষের জন্য। প্রতিটি সিদ্ধান্তে, প্রতিটি লেনদেনে, প্রতিটি মন্তব্যে- ন্যায়কে প্রাধান্য দেওয়া। আমি মনে করি, একটি সমাজ তখনই সত্যিকার শক্তিশালী হয়, যখন সবচেয়ে দুর্বল মানুষটিও জানে-সে অবিচারের শিকার হলেও ন্যায় পাবে।
৩) সহানুভূতি ও ক্ষমাশীলতা : ভারসাম্যের চাবিকাঠি
মানুষ সামাজিক প্রাণী। ভুল করবে, কষ্ট দেবে, কষ্ট পাবে। কিন্তু এখানেই ইসলামের সৌন্দর্য: দয়া, ধৈর্য আর ক্ষমা। ইসলাম দান ও সেবাকে এক মহৎ গুণ হিসেবে তুলে ধরেছে। যাকাত, সদকা বা নফল দান-এগুলো শুধু অর্থনৈতিক ভারসাম্য আনতে নয়; এগুলো আসলে হৃদয়ের পরিশুদ্ধির উপায়।
যখন একজন সামর্থ্যবান মানুষ নিজের সম্পদ থেকে দরিদ্রের জন্য ব্যয় করে, তখন সে নিজের ভেতরের অহংকারটাকে ভেঙে দেয়। তখন দানটা তার কাছে কেবল সহানুভূতি নয়, বরং কৃতজ্ঞতার প্রকাশ। কারণ সে জানে, আল্লাহ তাকে দিয়ে অন্যের ভাগে আলো ছড়ানোর সুযোগ দিয়েছেন।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি হলো ধৈর্য (সবর) ও ক্ষমা। কুরআনে বলা হয়েছে: “যে রাগ নিয়ন্ত্রণ করে এবং মানুষকে ক্ষমা করে, সে আল্লাহর প্রিয় বান্দা।” (সূরা আল-ইমরান, ৩:১৩৪)। ব্যক্তিগত জীবনে আমি দেখেছি, প্রতিশোধ নেওয়া যত সহজ, ক্ষমা করা তত কঠিন। কিন্তু যখন কেউ রাগ গিলে নিয়ে ক্ষমা করে, তখন তার ভেতরে এক অদ্ভুত শান্তি জন্মায়। মনে হয়, যেন নিজের ভেতরের শ্রেষ্ঠ মানুষটাকে এক মুহূর্তের জন্য ছুঁয়ে ফেলেছি।
৪) পারিবারিক বন্ধন ও দায়িত্ব: নৈতিকতার প্রথম বিদ্যালয়
সমাজের শক্তি শুরু হয় পরিবার থেকে। একটি পরিবারই হলো মানুষের প্রথম নৈতিক প্রতিষ্ঠান। পিতা-মাতা, সন্তান, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী-এই সম্পর্কগুলোই গড়ে দেয় আমাদের মূল্যবোধ। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি তার প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়, সে ঈমানদার হতে পারে না।” (সহীহ মুসলিম)। এই কথাটা আমি খুব গভীরভাবে অনুভব করি। ঈমান কেবল নামাজ, রোজা, বা দোয়াতে নয়,এটি প্রকাশ পায় আমাদের আচরণে, আমরা কেমন প্রতিবেশী, কেমন সহকর্মী, কেমন মানুষ, তাতেই।
লেখক : কবি, লেখক, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক, নান্দাইল, ময়মনসিংহ

