Logo

ইসলাম

ইসলাম ও স্বাধীনতার নৈতিকতা

Icon

আব্দুস সাত্তার সুমন

প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:৪৬

ইসলাম ও স্বাধীনতার নৈতিকতা

বিজয় শব্দটি শুধু যুদ্ধজয় নয়; এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে মানবসমাজকে একটি দায়িত্ব ও পরীক্ষার সম্মান। বাংলাদেশে বিজয় দিবস একটি জাতীয় অনুভূতি হলেও, ইসলামের দৃষ্টিতে এটি আল্লাহর নেয়ামত স্মরণ, নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রামের বৈধতা, ন্যায় প্রতিষ্ঠার সওয়াব এবং শহীদদের সম্মান ও দোয়ার একটি দিন। ইসলাম যুদ্ধকে ভালোবাসে না; কিন্তু জুলুমের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, নির্যাতিত মানুষের মুক্তি এবং মানবসম্মান রক্ষাকে ইবাদতের কর্ম হিসেবে স্থান দিয়েছে। তাই একটি জাতি যখন দাসত্ব, নিপীড়ন ও অত্যাচার থেকে মুক্ত হয় ইসলাম সেটিকে আল্লাহর রহমত ও পরীক্ষা এই দুইয়ের মাঝামাঝি অবস্থান হিসেবে দেখে। নীচে বিজয়, স্বাধীনতা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে কোরআন-হাদিসের আলোকে বিশদ ব্যাখ্যা তুলে ধরা হলো।

১. স্বাধীনতার মূলনীতি : আল্লাহ মানুষকে দাসত্বমুক্ত জন্ম দিয়েছেন। ইসলাম ঘোষণা করেছে মানুষের দাসত্ব আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে বৈধ নয়। আল্লাহ বলেন: আমি মানুষকে আদম সন্তানদের সম্মানিত করেছি। (সূরা আল-ইসরা ১৭:৭০)

এই আয়াত প্রমাণ করে, মানুষের উপর জুলুম করা হারাম। দাসত্বে আবদ্ধ রাখা হারাম। স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করা বৈধ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামও ছিল মানুষের মৌলিক অধিকার পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম, যা ইসলামে অনুমোদিত।

২. জুলুম ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ইসলামে বৈধ : আল্লাহ বলেন, যাদের উপর জুলুম করা হয়েছে তাদেরকে (যুদ্ধে) অনুমতি দেওয়া হলো- আল্লাহ অবশ্যই তাদেরকে বিজয় দান করতে ক্ষমতাবান। (সূরা হজ্জ ২২:৩৯)

এটি কোরআনের প্রথম যুদ্ধসংক্রান্ত অনুমতি এবং কারণ ছিল জুলুম। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও ছিল জাতিগত নিপীড়ন। ধর্মীয়ভাবে মসজিদে বোমা। নারী নির্যাতন। হত্যা ও গণহত্যা। এগুলো ইসলামের দৃষ্টিতে কঠোর অপরাধ। তাই নিপীড়িতের পক্ষে দাঁড়ানো একটি ইবাদতমূলক কাজ।

৩. বিজয় আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য ও ধৈর্যের ফল : আল্লাহ বলেন, তোমরা ধৈর্য ধরো; নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন। (সূরা আনফাল ৮:৪৬)

বাংলাদেশের যুদ্ধে ৯ মাসের ত্যাগ, ক্ষুধা-কষ্ট, শহীদদের রক্ত এসব ধৈর্যের পরীক্ষাই ইসলামের নুসরাত (সহায়তা) পাওয়ার উপযুক্ত কারণ।

আল্লাহ পাক আরও বলেন, বিজয় কেবল আল্লাহর নিকট থেকে আসে। (সূরা আল-ইমরান ৩:১২৬) অর্থাৎ রাষ্ট্র বা জাতি বিজয়ের মালিক নয়; বিজয় হলো আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত একটি নেয়ামত।

৪. শহীদদের সম্মান তাঁরা জীবিত : মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের অবস্থান সম্পর্কে ইসলামের অবস্থান অত্যন্ত মহিমান্বিত। আল্লাহ বলেন, আল্লাহর পথে নিহতদেরকে মৃত বলো না; বরং তারা জীবিত। (সূরা আল-বাকারা ২:১৫৪)

শহীদ সম্পর্কে হাদিসে আছে- রাসুল (সা.) বলেন, শহীদকে কিয়ামতের দিন রক্তের রঙ থাকবে কিন্তু মেশকের গন্ধ আসবে। (সহীহ বুখারি, হাদিস ২৮০৩) বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যারা জীবন দিলেন, ইসলামের আলোকে তারা শহীদ হবার যোগ্য।

৫. অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো ঈমানের দাবি : রাসুল (সা.) বলেন, তোমাদের মধ্যে যে কেউ অন্যায় দেখবে সে যেন তা হাতে পরিবর্তন করে; না পারলে মুখে, তা-ও না পারলে মনে ঘৃণা করে এটাই দুর্বল ঈমান। (সহীহ মুসলিম, হাদিস ৪৯)

অর্থাৎ জুলুমের সামনে নীরবতা ঈমানের বিরোধী। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা ঈমানের শক্তি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম এই হাদিসের বাস্তব রূপ।

৬. কৃতজ্ঞতার দিবস হিসেবে বিজয় দিবস : এক জাতি যখন নিপীড়ন থেকে মুক্ত হয় ইসলাম সেই দিনটিকে শুকরিয়া প্রকাশের দিন বলে। আল্লাহ বলেন, যদি তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর, আমি অবশ্যই তোমাদেরকে আরও বৃদ্ধি করে দেব। (সূরা ইবরাহিম ১৪:৭)

তাই বিজয় দিবস শহীদদের স্মরণ, আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা, স্বাধীনতা রক্ষার অঙ্গীকার, ন্যায় প্রতিষ্ঠার শপথ; এই চারটির সমন্বয় হওয়া উচিত।

৭. বিজয়ের পর ব্যর্থতা ইসলাম সতর্ক করেছে : কোরআনে আল্লাহ বলেন, কোনো জাতি নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন না করলে আল্লাহ তাদের অবস্থা পরিবর্তন করেন না। (সূরা আর-রাদ ১৩:১১)

অতএব, স্বাধীনতার পর দুর্নীতি করলে। অন্যায় করলে। দুর্বলতা এলে। এগুলো বিজয়ের নেয়ামত হারানোর কারণ হতে পারে। ইসলাম বিজয়কে কেবল যুদ্ধের সাফল্য নয় ন্যায় ও নৈতিকতা বজায় রাখার দায়িত্ব হিসেবে দেখে।

৮. বিজয়ের আসল লক্ষ্য ন্যায় প্রতিষ্ঠা : রাসুল (সা.) বলেন, একজন অত্যাচারী শাসকের সামনে সত্য কথা বলা এটাই সর্বোচ্চ জিহাদ। (সুনান আন-নাসাঈ, হাদিস ৪২০৯)

অর্থাৎ বিজয় মানে ক্ষমতা দখল নয়। বিজয় মানে ন্যায় প্রতিষ্ঠা। বিজয় মানে দুর্বল, দরিদ্র ও নির্যাতিত মানুষের অধিকার রক্ষা। বাংলাদেশের বিজয় তাই ইসলামের ন্যায় প্রতিষ্ঠার নীতির সাথে গভীরভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

বিজয় দিবসের করণীয়

১. শহীদদের জন্য দোয়া করা। হে আল্লাহ, তাঁদেরকে ক্ষমা করুন, রিজিক দিন, জান্নাত দিন।

২. আল্লাহর নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। ইবাদত, দোয়া, সাদাকা এসবের মাধ্যমে।

৩. অন্যায় ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া। স্বাধীনতার চেতনাকে পুনর্জাগরণ করা।

৪. তরুণ প্রজন্মকে সত্য ইতিহাস শেখানো। এটা আমানত, ইসলামী দায়িত্ব।

বিজয় দিবস ইসলামি দৃষ্টিতে শুধু জাতীয় উৎসব নয়, এটি আল্লাহর নুসরাতের দিন। শহীদদের স্মরণ দিবস। কৃতজ্ঞতার দিবস। ন্যায় প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার গ্রহণের দিন। স্বাধীনতা আল্লাহর নেয়ামত; আর এই নেয়ামতের অযোগ্য ব্যবহার আল্লাহর অসন্তোষ ডেকে আনতে পারে। তাই বিজয় দিবস মুসলিম জাতির জন্য শুধু আনন্দের নয়– এটি দায়িত্বেরও মুহূর্ত।

লেখক : প্রাবন্ধিক, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট বাংলাদেশ

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

ইসলাম ধর্ম

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর