Logo

ইসলাম

আজ মহান বিজয় দিবস

ইসলামের দৃষ্টিতে মুক্তি, ন্যায় ও আত্মত্যাগ

Icon

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

প্রকাশ: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৩:২৮

ইসলামের দৃষ্টিতে মুক্তি, ন্যায় ও আত্মত্যাগ

বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৬ ডিসেম্বর একটি গৌরবোজ্জ্বল ও তাৎপর্যপূর্ণ দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর বাঙালি জাতি অর্জন করে চূড়ান্ত বিজয়-স্বাধীনতা ও মুক্তি। ৫৫তম মহান বিজয় দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় আত্মত্যাগ, ন্যায়বিচার এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থানের চেতনা। ইসলামের দৃষ্টিতেও এই মূল্যবোধগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যার সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা কোরআন ও হাদিসে পাওয়া যায়।

ইসলাম কোনো ধরনের নিপীড়ন, জুলুম কিংবা অবিচারকে সমর্থন করে না। বরং ইসলাম মানুষকে স্বাধীনভাবে ও মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার অধিকার দেয় এবং জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে উৎসাহিত করে। মহান মুক্তিযুদ্ধ ছিল মূলত একটি ন্যায়সংগত সংগ্রাম, যেখানে একটি নির্যাতিত জাতি তার অধিকার, ভাষা ও অস্তিত্ব রক্ষার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছিল। এই প্রেক্ষাপটে ইসলামের শিক্ষা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মধ্যে গভীর সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়।

জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ : কোরআনের দৃষ্টিভঙ্গি

পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ, বৈষম্য ও গণহত্যা ছিল চরম জুলুমের বহিঃপ্রকাশ। কোরআন মাজিদে আল্লাহ তায়ালা নিপীড়িত মানুষের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন- আর তোমাদের কী হলো যে, তোমরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করো না এবং দুর্বল নর-নারী ও শিশুদের জন্য (যুদ্ধ করো না), যারা বলে- হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদেরকে এই জালিম জনপদ থেকে বের করে নাও। (সূরা আন-নিসা: ৭৫) এই আয়াত স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, নিপীড়িত মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করা একটি নৈতিক ও ধর্মীয় দায়িত্ব। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল ঠিক তেমনই একটি সংগ্রাম, যেখানে নিরস্ত্র মানুষ হত্যার শিকার হচ্ছিল, নারীরা নির্যাতিত হচ্ছিল এবং শিশুদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছিল। স্বাধীনতা ও মানবিক মর্যাদা

ইসলাম মানুষের মর্যাদাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব

দিয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- "নিশ্চয়ই আমি আদম সন্তানকে সম্মানিত করেছি।” (সূরা আল-ইসরা: ৭০)

মানবিক মর্যাদা তখনই প্রতিষ্ঠিত হয়, যখন মানুষ স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারে, নিজের ভাষা, সংস্কৃতি ও বিশ্বাস চর্চা করতে পারে। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ- উভয়ই ছিল এই মর্যাদা রক্ষার সংগ্রাম। মাতৃভাষা বাংলার অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার এই লড়াই ইসলামের মানবিক মূল্যবোধের পরিপন্থী নয়; বরং তা সমর্থনযোগ্য।

আত্মত্যাগ ও শহীদের মর্যাদা

মুক্তিযুদ্ধে লাখো মানুষ শহীদ হয়েছেন। ইসলামে শহীদের মর্যাদা অত্যন্ত উচ্চ। কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন- যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়, তাদেরকে মৃত মনে করো না; বরং তারা জীবিত, তাদের প্রতিপালকের কাছে রিজিকপ্রাপ্ত।" (সূরা আলে ইমরান: ১৬৯)

এই আয়াত আমাদের আশ্বস্ত করে যে, যারা ন্যায় ও সত্যের পথে জীবন উৎসর্গ করেছেন, তারা আল্লাহর কাছে সম্মানিত। মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী শহীদদের আত্মত্মত্যাগ এই অর্থেই ইসলামের শহীদী চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ইসলামের মূল শিক্ষা

ইসলামের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা। আল্লাহ তায়ালা নির্দেশ দেন- হে মুমিনগণ! তোমরা ন্যায়ের ওপর অবিচল থাকো, আল্লাহর জন্য সাক্ষ্যদাতা হও, যদিও তা তোমাদের নিজেদের বা পিতা-মাতা ও আত্মীয়স্বজনের বিরুদ্ধে হয়। "(সূরা আন-নিসা: ১৩৫)

মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি অন্যায় ও বৈষম্যমূলক রাষ্ট্রীয় কাঠামো থেকে বেরিয়ে এসে ন্যায়ের ভিত্তিতে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের সুযোগ পেয়েছে। বিজয় দিবস আমাদের সেই দায়িত্বের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়, যাতে স্বাধীনতার পরেও আমরা জুলুম,

দুর্নীতি ও বৈষম্য থেকে দূরে থাকি। দেশপ্রেম ও ইসলামী চেতনা

হাদিসে দেশপ্রেমকে সরাসরি ইবাদত বলা না হলেও, নবী মুহাম্মদ (সা.) নিজ মাতৃভূমির প্রতি গভীর ভালোবাসা প্রকাশ করেছেন। হিজরতের সময় তিনি বলেন- হে মক্কা! তুমি আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় ভূমি। যদি তোমার অধিবাসীরা আমাকে বের করে না দিত, তবে আমি কখনো তোমাকে ত্যাগ করতাম না।" (তিরমিজি: ৩৯২৫) এ হাদিস প্রমাণ করে যে, মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা ইসলামের পরিপন্থী নয়। বরং দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও কল্যাণ রক্ষা করা একটি নৈতিক দায়িত্ব।

পরিশেষে বলতে চাই, ৫৫তম মহান বিজয় দিবস আমাদের শুধু অতীতের গৌরব স্মরণ করায় না, বরং ভবিষ্যতের জন্য দায়িত্বশীল করে তোলে। ইসলামের আলোকে বিচার করলে দেখা যায়- মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যেমন ন্যায়, মানবিক মর্যাদা, আত্মত্যাগ ও জুলুমের বিরুদ্ধে অবস্থান- এসবই ইসলামের মৌলিক শিক্ষার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। তাই একজন সচেতন মুসলমান ও নাগরিক হিসেবে মহান বিজয় দিবসকে সম্মান করা, শহীদদের স্মরণ করা এবং স্বাধীনতার চেতনা সমুন্নত রাখা আমাদের নৈতিক ও ধর্মীয় কর্তব্য।

লেখক : কলাম লেখক ও ইসলাম বিষয়ক প্রবন্ধকার ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি

বিকেপি/আইএইচ

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

ইসলাম ধর্ম বিজয় দিবস মুক্তিযুদ্ধ

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর