Logo

ইসলাম

মব সংস্কৃতি : ইসলাম কী বলে

Icon

ড. মাহবুবুর রহমান

প্রকাশ: ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:৩৮

মব সংস্কৃতি : ইসলাম কী বলে

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় একটি ভয়ংকর প্রবণতা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে-তা হলো মব সংস্কৃতি কোনো একটি ঘটনা, গুজব কিংবা অভিযোগকে কেন্দ্র করে হঠাৎ করে একদল উত্তেজিত মানুষ জড়ো হয়ে যায়। যাচাই-বাছাই ছাড়াই তারা কাউকে দোষী সাব্যস্ত করে, অপমান করে, মারধর করে, কখনো কখনো জীবননাশ পর্যন্ত ঘটায়। এই ঘটনাগুলো আমাদের সমাজে নতুন নয়, কিন্তু ইদানীং এর ব্যাপকতা ও নিষ্ঠুরতা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে।

মব সংস্কৃতি শুধু কিছু বিচ্ছিন্ন সহিংস ঘটনার নাম নয়। এটি এক ধরনের মানসিকতা। এই মানসিকতায় মানুষ আইন, নৈতিকতা ও মানবিকতা ভুলে যায়। ভিড়ের উত্তেজনাই হয়ে ওঠে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। ফলে সমাজে ন্যায়বিচারের জায়গায় প্রতিশোধ, শৃঙ্খলার জায়গায় বিশৃঙ্খলা এবং যুক্তির জায়গায় আবেগ প্রাধান্য পায়।

মব সংস্কৃতি কীভাবে সমাজে জন্ম নেয়

মব সংস্কৃতির মূল উৎস হলো হুজুগ, গুজব এবং উত্তেজনা। একটি খবর-সত্য হোক বা মিথ্যা-দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এই জড়িয়ে পড়াকে আরও ত্বরান্বিত করে। মানুষ যাচাই না করেই বিশ্বাস করে, আবার বিশ্বাস না করেই প্রতিক্রিয়া দেখায়। কেউ একজন উত্তেজনা সৃষ্টি করলে বাকিরা সেটার সঙ্গে যুক্ত হয়। ধীরে ধীরে একটি ভিড় তৈরি হয়, আর সেই ভিড় নিজেকে ন্যায়বিচারের একমাত্র প্রতিনিধি মনে করতে শুরু করে।

এই প্রক্রিয়ায় ব্যক্তি আর ব্যক্তি থাকে না, মানুষ আর মানুষ থাকে না-সবাই হয়ে যায় একেকটি আবেগপ্রবণ অংশ এখানে বিবেক কাজ করে না, যুক্তি থেমে যায়। এর পরিণতি যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তা আমরা ইতোমধ্যেই বিভিন্ন ঘটনার মাধানে দেখেছি।

রাষ্ট্রের জন্য কেন এটি ভয়ংকর

একটি রাষ্ট্র টিকে থাকে আইন ও নিয়মের ওপর। সেখানে বিচার হবে আদালতে, অপরাধের তদন্ত হবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে, আর শাস্তি নির্ধারিত হবে নিরপেক্ষ প্রক্রিয়ায়। মব সংস্কৃতি এই পুরো ব্যবস্থাকেই অস্বীকার করে। যখন মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নেয়, তখন রাষ্ট্র দুর্বল হয়ে পড়ে। নাগরিকরা ভাবতে শুরু করে-আইন আমাদের নিরাপত্তা দিতে পারছে না, তাই আমরাই বিচার করব। এই চিন্তা ছড়িয়ে পড়লে সমাজে কেউই নিরাপদ থাকে না। আজ যে মনের অংশ, কাল সে-ই হতে পারে মবের শিকার।

মর সংস্কৃতি সামাজিক ঐকা ধ্বংস করে দেয়। মানুষ মানুষকে সন্দেহ করতে শেখে। ভিন্নমত, ভিন্ন পরিচয় বা সামান্য অভিযোগও বড় সংঘাতের জন্ম দেয়। রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন ও শান্তি-সবকিছুই তখন ঝুঁকির মুখে পড়ে।

ইসলামে মানুষের জীবনের মর্যাদা

ইসলাম মানুষের জীবনকে অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ বলে ঘোষণা করেছে। কোরআনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে- "যে ব্যক্তি কোনো মানুষকে হত্যা করল-সে যদি হত্যার অপরাধে বা পৃথিবীতে ফিতনা সৃষ্টির কারণে না হয়-তবে সে যেন সমগ্র মানবজাতিকে হত্যা করল।" (সূরা আল-মায়িদা: ৩২)

এই আয়াত থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, ইসলামে মানুষের জীবনের মূল্য কতটা বেশি। মব সংস্কৃতিতে প্রায়ই নিরপরাধ মানুষ শান্তির শিকার হয়-কখনো ভুল অভিযোগে, কখনো গুরুবে, কখনো ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণে। ইসলামের দৃষ্টিতে এটি চরম অন্যায় ও হারাম।

মব সংস্কৃতিতে প্রায়ই নিরপরাধ মানুষ শান্তির শিকার হয় কখনো ভুল তথ্যের কারণে, কখনো ব্যক্তিগত শত্রুতার ফলে, আবার কখনো নিছক সন্দেহের ভিত্তিতে মানুষ নিগৃহীত হয়। ইসলামের দৃষ্টিতে এটি চরম জুলুম।

ন্যায়বিচার সম্পর্কে ইসলামের শিক্ষা

ইসলাম ন্যায়বিচারের কথা বলেছে বারবার। তবে এই ন্যায়বিচার আবেগের ওপর নয়, প্রমাণ ও সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত। কোরআন আমাদের শিক্ষা দেয়-ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে হবে, এমনকি তা নিজের বা নিজের আপনজনের বিরুদ্ধেও হলে। এর অর্থ হলো, ইসলাম কখনো দলগত আবেগ বা ভিড়ের চাপে বিচার করার অনুমতি দেয় না। বিচার হতে হবে নিরপেক্ষ, শান্ত ও সুবিবেচনাপূর্ণ। মব সংস্কৃতি ঠিক তার বিপরীত-এখানে উত্তেজনাই বিচারক।

ইসলাম শুধু ইবাদতের ধর্ম নয়। এটি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ধর্ম। কোরআনে বারবার ন্যায়ের কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন- "হে মুমিনগণ। ন্যায়বিচারে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকো এবং আল্লাহর জন্য সাক্ষ্য দাও-যদিও তা তোমাদের নিজেদের বা পিতা-মাতা ও আত্মীয়স্বজনের বিরুদ্ধে হয়।" (সুরা আন-নিসা: ১৩৫) এই আয়াত আমাদের শেখায়-ন্যায়বিচার কখনো আবেগনির্ভর হতে পারে না। দল, গোষ্ঠী বা ভিড়ের চাপে সত্য বদলে যেতে পারে না। অথচ মৰ সংস্কৃতিতে ঠিক উল্টোটা ঘটে। এখানে বিচার হয় আবেগে, শান্তি হয় উত্তেজনায়।

গুজব ও হুজুগ: মব সংস্কৃতির প্রধান অস্ত্র

মব সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় শক্তি হলো গুজব। যাচাই না করা খবর, অতিরঞ্জিত অভিযোগ কিংবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যা তথ্য দ্রুত মানুষের মনে আগুন ধরিয়ে দেয়। অথচ ইসলাম এই বিষয়ে আমাদের কঠোরভাবে সতর্ক করেছে। কোরআন বলে-কোনো খবর এলে তা যাচাই না করে বিশ্বাস করা উচিত নয়।

এই একটি নীতি মানলেই সমাজে অর্ধেকের বেশি অশান্তি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কিন্তু আমরা প্রায়ই এই দায়িত্ব এড়িয়ে যাই, আর তার ফল ভোগ করে পুরো সমাজ।

ফিতনা ও মব সংস্কৃতি

ইসলামে 'ফিতনা' বলতে এমন বিশৃঙ্খলাকে বোঝায়, যা সমাজের শান্তি ও নিরাপত্তা ধ্বংস করে দেয়। কোরআনে বলা হয়েছে-ফিতনা হত্যার চেয়েও ভয়ংকর। মব সংস্কৃতি আসলে এই ফিতনারই আধুনিক রূপ। ইসলামে "ফিতনা" শব্দটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফিতনা মানে এমন বিশৃঙ্খলা, যা সমাজের শান্তি ও নিরাপত্তা ধ্বংস করে দেয়। আল-কোরআনে বলা হয়েছে "ফিতনা হত্যা অপেক্ষাও ভয়ংকর।" (সূরা আল-বাকারা: ১৯১)

মব সংস্কৃতি মূলত এই ফিতনারই আধুনিক রূপ। এটি মানুষকে মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করে, ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করে এবং সমাজকে অস্থির করে তোলে এটি মানুষকে ভীত করে, সমাজে অবিশ্বাস সৃষ্টি করে এবং ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনব্যবস্থাকে অচল করে দেয়। যেখানে ফিতনা ছড়ায়, সেখানে দ্বীন, নৈতিকতা ও মানবিকতা- সবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ইসলামে মব সংস্কৃতি কেন হারাম

ইসলামের দৃষ্টিতে মব সংস্কৃতি স্পষ্টভাবে হারাম, কারণ এটি ন্যায়বিচার, মানবিকতা ও শৃঙ্খলার মৌলিক ইসলামী নীতির পরিপন্থী। মৰ সংস্কৃতিতে যাচাই-বাছাই ছাড়াই অভিযোগের ভিত্তিতে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়, যা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আল-কোরআনে আল্লাহ তাআলা নির্দেশ দিয়েছেন- "হে মুমিনগণ। কোনো ফাসিক ব্যক্তি যদি তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তবে তা যাচাই করে নাও" (সূরা আল-হুজুরাত: ৬) অথচ মব সংস্কৃতি গুজব ও হুজুগের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। ইসলাম মানুষের জীবন ও সম্মানকে অত্যন্ত পবিত্র ঘোষণা করেছে। কোরআনে বলা হয়েছে- "যে ব্যক্তি একজন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করল, সে যেন সমগ্র মানবজাতিকে হত্যা করল।" মব সহিংসতায় প্রায়ই নিরপরাধ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা চরম জুলুম। এছাড়া ইসলাম আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া নিষেধ করেছে।

ন্যায়বিচার হবে প্রমাণ ও সুবিবেচনার মাধ্যমে, আবেগের মাধ্যমে নয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন- "জুলুম থেকে বেঁচে থাকো; কারণ কিয়ামতের দিন জুলুম অন্ধকারে পরিণত হবে। (সহিহ মুসলিম)। অতএব, মব সংস্কৃতি ফিতন সৃষ্টি করে, ন্যায়বিচার নষ্ট করে এবং মানবজীবনের মর্যাদা লঙ্ঘন করে এই কারণেই ইসলামের দৃষ্টিতে এটি হারাম।

সব দিক বিবেচনা করলে স্পষ্ট হয়-মব সংস্কৃতি ইসলামে হারাম কারণ এটি নিরপরাধ মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, ন্যায়বিচারের পথ রুদ্ধ করে, গুজব ও মিথ্যার ওপর নির্ভর করে এবং সমাজে ফিতনা ছড়ায়। ইসলামে ভালো উদ্দেশ্য থাকলেও অবৈধ পন্থায় তা অর্জন করা বৈধ নয়।

আমাদের করণীয়

এই বাস্তবতায় আমাদের সবার দায়িত্ব আছে। আইন নিজের হাতে না নেওয়া, গুজবে কান না দেওয়া, সামাজিক মাধ্যমে দায়িত্বশীল থাকা এবং সহিংসতাকে প্রত্যাখ্যান করা-এসবই নাগরিক দায়িত্বের অংশ।

বিশেষ করে ধর্মীয় নেতা, শিক্ষক, সাংবাদিক ও সচেতন মানুষদের আরও সতর্ক ভূমিকা রাখতে হবে। কারণ তাদের কথা সমাজে বেশি প্রভাব ফেলে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন- "যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে, সে যেন ভালো কথা বলে অথবা চুপ থাকে।" (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)। এই হাদিস সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগে আমাদের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।

মব সংস্কৃতি কোনো সুস্থ সমাজের লক্ষণ নয়। এটি রাষ্ট্রকে দুর্বল করে, সমাজকে বিভক্ত করে এবং মানুষের জীবনকে অনিরাপদ করে তোলে। ইসলামের শিক্ষা আমাদের স্পষ্টভাবে বলে-শান্তি প্রতিষ্ঠা করো, ন্যায়বিচারের পথে থাকো, ফিতনা থেকে দূরে থাকো। আজ যদি আমরা মব মানসিকতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে না পারি, তবে আগামী দিনে এর ক্ষতি আমাদের সবাইকেই বহন করতে হবে। ইসলাম আমাদের আগুন লাগাতে নয়, আগুন নেভাতে শিখিয়েছে-এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় শিক্ষা।

লেখক : প্রভাষক, রাজশাহী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

ইসলাম ধর্ম মব

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর