Logo

ইসলাম

যে গুনাহে বক্তা ও শ্রোতা উভয়েই পাপী

Icon

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

প্রকাশ: ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:১১

যে গুনাহে বক্তা ও শ্রোতা উভয়েই পাপী

ইসলামে মানুষের সম্মান রক্ষা করা ঈমানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই সম্মান নষ্ট করার অন্যতম বড় মাধ্যম হলো গীবত বা পরনিন্দা। গীবত শুধু একটি সামাজিক দোষ নয়; বরং এটি ইসলামের দৃষ্টিতে কবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত একটি মারাত্মক পাপ। কোরআন ও সহীহ হাদিসে গীবত সম্পর্কে কঠোর নিষেধাজ্ঞা এবং ভয়াবহ পরিণতির কথা স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী, গীবত করা যেমন হারাম, তেমনি গীবত শোনা বা নীরবে সহ্য করাও একই অপরাধের অংশ।

মানুষ স্বভাবতই কথাবার্তায় অভ্যস্ত। তবে ইসলাম এমন কোনো কথাবার্তাকে অনুমোদন দেয় না, যা অন্যের সম্মান, চরিত্র বা মর্যাদা ক্ষুন্ন করে। তাই জিহ্বার এই গুনাহ থেকে বাঁচতে মুসলিমকে সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে।

কোরআনের আলোকে গীবতের ভয়াবহতা

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা গীবতকে অত্যন্ত ঘৃণ্য কাজ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি ইরশাদ করেন- এদের মধ্যে কেউ কারো গীবত করো না; তোমরা কি তোমার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে চাইবে? নিশ্চয়ই তোমরা তা অপছন্দ করবে। (সুরা আল-হুজুরাত ১২) এই আয়াতে গীবতকে মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, যা মানুষের স্বভাবগতভাবেই ঘৃণার উদ্রেক করে। এর মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে, গীবত শুধু অন্যায় নয়, বরং এটি মানবিকতা ও ঈমানবিরোধী এক জঘন্য কাজ। গীবত ব্যক্তি পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকে না: এটি পরিবার, সমাজ ও জাতির মধ্যে বিভেদ ও অবিশ্বাস সৃষ্টি করে।

হাদিসে গীবতের সঠিক সংজ্ঞা

গীবত কী- এ বিষয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) অত্যন্ত স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়েছেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন- তোমরা কি জানো গীবত কী?"

সাহাবীগণ বললেন, 'আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই ভালো জানেন। তিনি বললেন- তোমার ভাই সম্পর্কে সে যেমন কিছু অপছন্দ করবে, সেই বিষয়ে কথা বলা- সেটাই গীবত। একজন সাহাবী জিজ্ঞেস করলেন, 'যদি কথাটি সত্যিই তার মধ্যে থাকে?'

রাসুলুল্লাহ (সা.) উত্তর দিলেন- যদি তা সত্যিই থাকে, তবেই তুমি তার গীবত করেছ; আর যদি তা সত্য না থাকে, তবে তুমি তাকে মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছ। (সহীহ মুসলিম ২৫৮৯) এই হাদিস থেকে স্পষ্ট হয়, সত্য কথা বললেই তা বৈধ হয়ে যায় না। অন্যের অপছন্দনীয় সত্য কথাও গীবতের অন্তর্ভুক্ত। আর মিথ্যা হলে তা আরও ভয়াবহ গুনাহ।

গীবত শোনা কেন গুনাহ

ইসলামে কেবল গীবত করা নয়, গীবত শোনা ও নীরবে সহ্য করাও নিষিদ্ধ। কারণ শ্রোতার নীরবতা গীবতকারীকে উৎসাহ দেয় এবং পাপের বিস্তার ঘটায়। ইসলামী নির্দেশনা অনুযায়ী, কেউ গীবত শুরু করলে তাকে থামানো, আল্লাহকে ভয় করার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া অথবা সেই স্থান ত্যাগ করা একজন মুমিনের দায়িত্ব। এতে বোঝা যায়, গীবত শোনা নিজেও পাপের অংশীদার হওয়া।

পরকালে গীবতের শাস্তি

গীবতের পরিণতি শুধু দুনিয়ায় সীমাবদ্ধ নয়; আখিরাতেও এর শাস্তি অত্যন্ত ভয়াবহ। হজরত আনাস ইবনু মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন- মি'রাজের রাতে আমি এমন এক সম্প্রদায়কে দেখেছি, যাদের নখ ছিল তামার মতো। তারা সেসব নখ দিয়ে নিজেদের মুখমণ্ডল ও বক্ষদেশ আঁচড়াচ্ছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, 'হে জিবরাইল। এরা কারা?'

তিনি বললেন- এরা তারা, যারা মানুষের গীবত করত এবং তাদের সম্মান নষ্ট করত। (সুনান আবু দাউদ: ৪৮৭৮)-(মুসনাদ আহমাদ: ১২৬৯৭) এই দৃশ্য গীবতের ভয়াবহতা ও পরিণতির একটি জ্বলন্ত প্রমাণ।

গীবতের কাফফারা ও সংশোধনের পথ

যে ব্যক্তি গীবতে লিপ্ত হয়েছে, তার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আন্তরিক তওবা করা। পাশাপাশি যার বিরুদ্ধে গীবত করা হয়েছে, তার জন্য দোয়া ও ক্ষমা প্রার্থনা করা।

ইমাম বায়হাকি (রহ.) বর্ণিত হাদিসে এসেছে- গীবতের কাফফারা হলো- যার গীবত করা হয়েছে, তার জন্য দোয়া করা। শু'আবুল ঈমান, বায়হাকি ৬৭৪১) গীবত মানুষের নেক আমল ধ্বংস করে দেয় এবং কিয়ামতের দিন মানুষকে নিঃস্ব করে দিতে পারে।

মুসলিমের করণীয়

ইসলামের শিক্ষা পরিষ্কার- গীবতের পথে পা দেওয়া যাবে না, জিহ্বাকে সংযত রাখতে হবে এবং অন্যের সম্মান রক্ষায় সচেতন হতে হবে। কেউ গীবত করলে তা প্রতিরোধ করা বা সেখান থেকে সরে যাওয়াই ঈমানদারের পরিচয়।

গীবত করা ও গীবত শোনা-উভয়ই মারাত্মক কবীরা গুনাহ। সমাজে শান্তি, ভ্রাতৃত্ব ও মানবিক মর্যাদা রক্ষার জন্য প্রতিটি মুসলিমের উচিত এই গুনাহ থেকে নিজেকে রক্ষা করা। আল্লাহ তা'আলা আমাদের সবাইকে গীবত থেকে বাঁচার তাওফিক দান করুন। আমীন।

লেখক : কলাম লেখক ও ইসলাম বিষয়ক প্রবন্ধকার ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

ইসলাম ধর্ম

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর