Logo

ইসলাম

গালিগালাজ ও কুরুচিপূর্ণ ভাষা মুমিন চরিত্রে অকল্পনীয় স্বভাব

Icon

হাফেজ মুফতী রাশেদুর রহমান

প্রকাশ: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৪:০১

গালিগালাজ ও কুরুচিপূর্ণ ভাষা মুমিন চরিত্রে অকল্পনীয় স্বভাব
বর্তমান সমাজে ‘মুখের অসংযম’ বা গালিগালাজ এক ভয়াবহ সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়ছে। পাড়া-মহল্লার আড্ডা থেকে শুরু করে টেলিভিশনের টকশো, এমনকি হাতের মুঠোয় থাকা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম; সবখানেই এখন কুরুচিপূর্ণ ভাষার ছড়াছড়ি। অথচ একজন মুসলিমের মূল পরিচয়ের সাথে এই অভ্যাসটি সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্পষ্ট ঘোষণা অনুযায়ী, কোনো গালিগালাজকারী ব্যক্তি প্রকৃত মুমিন হতে পারে না।

ইসলামে জিহ্বার হেফাজত ও গুরুত্ব

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনদর্শন ও উন্নত আচরণের সমন্বয়ের নাম। মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে সতর্ক করে বলেছেন, “মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে, তার কাছে একজন সদা প্রস্তুত প্রহরী (ফেরেশতা) তা লিপিবদ্ধ করার জন্য উপস্থিত থাকে।” (সূরা কাফ, আয়াত: ১৮)। অর্থাৎ, আমাদের প্রতিটি শব্দ- তা ফেসবুকের কমেন্ট বক্সে টাইপ করা হোক কিংবা জনসম্মুখে চিৎকার করে বলা হোক- সবই পরকালের আমলনামায় রেকর্ড হচ্ছে। মূলত মানুষের উন্নত চরিত্রের প্রথম ধাপই হলো নিজের জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণ করা।

হাদিসের কঠোর হুঁশিয়ারি

রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, “মুমিনকে গালি দেওয়া ফাসেকি (পাপ) এবং তাকে হত্যা করা কুফরি।” (সহীহ বুখারী: ৪৮, সহীহ মুসলিম: ৬৪)। অনেকে মনে করেন, রাগের মাথায় বা ঝগড়ার সময় গালি দিলে হয়তো ক্ষমা পাওয়া যাবে। অথচ নবীজি (সা.) ঝগড়ার সময় গালিগালাজে নেমে আসাকে মুনাফিকের স্বভাব হিসেবে উল্লেখ করেছেন। - সহীহ বুখারী: ৩৩। একবার বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আবু যার রা. জনৈক ব্যক্তিকে লক্ষ করে কটু কথা বললে রাসুল (সা.) চরম বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন এবং একে জাহিলী যুগের কাজ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন।- সহীহ বুখারী: ৩০ মুমিনের পরিচয় সম্পর্কে হাদীসে এসেছে, “মুমিন ব্যক্তি কখনো খোঁটা দানকারী, লানতকারী, অশ্লীল কুরুচিপূর্ণ কথা বলা ও গালিগালাজকারী হতে পারে না।” (জামে তিরমিযী: ১৯৭৭)। 

ভিন্নমতাবলম্বীদের প্রতি আচরণের কোরআনিক নীতিমালা

ইসলামের সৌন্দর্য হলো, এটি কেবল নিজের বলয়ে নয়, বরং ভিন্ন আদর্শের মানুষের সাথেও কুরুচিপূর্ণ আচরণ করতে নিষেধ করেছে। এমনকি যারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কিছুর পূজা করে, তাদের দেব-দেবীকেও গালি দিতে কোরআন কঠোরভাবে বারণ করেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আল্লাহকে ছেড়ে যাদের তারা ডাকে, তাদের তোমরা গালি দিও না। তাহলে তারা অজ্ঞতাবশত সীমালঙ্ঘন করে আল্লাহকেও গালি দেবে।” (সূরা আনআম, আয়াত: ১০৮)। এই শিক্ষাটি বর্তমান সময়ের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। রাজনৈতিক বা ধর্মীয় বিতর্কে আমরা যখন প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করি, তখন তারা ক্ষিপ্ত হয়ে আমাদের পবিত্র বিষয়গুলো নিয়ে বিদ্রƒপ করে। ফলে আমাদের দেওয়া গালি প্রকারান্তরে আমাদের নিজেদের বিশ্বাসের অবমাননার পথই তৈরি করে দেয়।

বর্তমান প্রেক্ষাপট ও সামাজিক মাধ্যম

আজকের টকশোগুলোর দিকে তাকালে মনে হয়, যার ভাষা যত তীক্ষè এবং যিনি যত বেশি ব্যক্তিগত আক্রমণ করতে পারেন, তিনিই যেন সবচেয়ে বড় বীর। বিতর্কের ন্যূনতম শালীনতা হারিয়ে আমরা এখন কুৎসা রটনায় মত্ত। সামাজিক মাধ্যমে ‘ট্রোল’ করার নামে যে ভাষা ব্যবহার করা হয়, তা কোনো সভ্য সমাজের পরিচয় হতে পারে না। আমাদের মনে রাখা উচিত, কীবোর্ডের প্রতিটি স্ট্রোক কিয়ামতের দিন আমাদের বিপক্ষে সাক্ষ্য দিতে পারে। স্ক্রিনের ওপাশে বসে কাউকে গালি দেওয়া মানে কেবল তার সম্মানহানি করা নয়, বরং নিজের রুচি ও পারিবারিক শিক্ষার দীনতাকেই প্রকাশ করা। রাসুল (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের ওপর বিশ্বাস রাখে, সে যেন ভালো কথা বলে অথবা চুপ থাকে।” (সহীহ বুখারী: ৬০১৮)।

মহৎ প্রাণদের কর্মনীতি থেকে শিক্ষা

মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবার আদব অধ্যায়ের বর্ণনায় সাহাবী ও তাবেয়ীদের জীবনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তাঁরা জিহ্বার গুনাহকে প্রচণ্ড ভয় পেতেন। প্রখ্যাত তাবেয়ী ইব্রাহিম নাখঈ (রহ.) বলতেন, “পূর্বসূরিগণ গালিগালাজকে এতটাই ঘৃণা করতেন যে, তাঁরা জালেমকেও গালি দিতে অপছন্দ করতেন-পাছে নিজের জিহ্বা অপবিত্র হয়ে যায়।” এমনকি হযরত আবু বকর (রা.) নিজের জিহ্বা টেনে ধরে বলতেন, “এই অঙ্গটিই আমাকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে।” সিদ্দিকে আকবরের মতো মহামানব যদি নিজের জিহ্বা নিয়ে এত ভীত থাকেন, তবে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কতটা সতর্ক হওয়া উচিত?

আত্মশুদ্ধি ও উত্তরণের পথ

গালিগালাজ মূলত একটি মানসিক সহিংসতা যা সমাজের ভ্রাতৃত্ব নষ্ট করে দেয়। বিশেষ করে বর্তমান প্রজন্মের কিশোর-কিশোরীরা যখন কন্টেন্ট ক্রিয়েটরদের গালিগালাজপূর্ণ ভিডিও দেখে প্রভাবিত হয়, তখন আমাদের নৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে পড়ে। এই সংস্কৃতি থেকে বের হতে হলে আমাদের ব্যক্তিগত সচেতনতা জরুরি। কোনো কথা বলার আগে ভাবতে হবে এটি নেক আমল কি না। গালিগালাজপূর্ণ আড্ডা বা সামাজিক মাধ্যমের গ্রুপ বর্জন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, কেউ গালি দিলেও তার বিপরীতে ধৈর্য ধরাই হলো প্রকৃত বীরত্ব। গালিগালাজ বা অশ্লীল ভাষা মূলত চারিত্রিক দেউলিযাত্বেরই বহিঃপ্রকাশ। একজন প্রকৃত মুমিনের বৈশিষ্ট্য হলো তার জিহ্বা ও হাত থেকে অন্য মানুষ নিরাপদ থাকবে। কিয়ামতের ময়দানে মিজানের পাল্লায় সুন্দর আচরণের চেয়ে ভারি আর কিছুই হবে না। তাই টকশো, ফেসবুক আর ব্যক্তিজীবন- সবখানেই আমাদের জিহ্বাকে মহান আল্লাহর জিকির এবং সুন্দর কথায় অভ্যস্ত করে ইসলামের আসল সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা উচিত। আল্লাহ আমাদের সবাইকে জিহ্বার হেফাজত করার এবং উন্নত চরিত্রের অধিকারী হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমীন।

লেখক : সিনিয়র পেশ ইমাম, বুয়েট সেন্ট্রাল মসজিদ, ঢাকা

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

ইসলাম ধর্ম

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর