স্বদেশ প্রত্যাবর্তন : ইসলামে দেশপ্রেম ও দায়িত্ববোধ
ডা.মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
প্রকাশ: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৪:১৬
মানুষের জীবনে জন্মভূমি বা স্বদেশ কেবল একটি ভৌগোলিক সীমানার নাম নয়; এটি স্মৃতি, আত্মপরিচয়, সংস্কৃতি ও দায়িত্বের এক গভীর বন্ধন। জীবনের প্রয়োজনে মানুষ কখনো স্বদেশ ছাড়ে- জীবিকা, শিক্ষা, নিরাপত্তা কিংবা রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে। কিন্তু দীর্ঘ প্রবাসজীবনের পর স্বদেশে প্রত্যাবর্তন যখন ঘটে, তখন তা শুধু শারীরিক ফেরত নয়; বরং আত্মিক, নৈতিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতার এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
ইসলাম মানুষকে শিকড়বিচ্ছিন্ন করতে শেখায় না। বরং প্রয়োজন হলে ত্যাগের শিক্ষা দেয়, আবার উপযুক্ত সময় এলে স্বদেশে ফিরে এসে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোর নির্দেশও দেয়। কোরআন ও সুন্নাহ এই বিষয়ে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে।
হিজরত ও স্বদেশপ্রেম: নবীজির (সা.) শিক্ষা
নবী মুহাম্মদ (সা.)- এর জীবনে হিজরত একটি ঐতিহাসিক ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। মক্কার জুলুম-নির্যাতনের কারণে তিনি মদিনায় হিজরত করেন। তবে মক্কার প্রতি তাঁর ভালোবাসা কখনো কমেনি। হিজরতের সময় তিনি মক্কার দিকে ফিরে আবেগভরে বলেছিলেন-
“আল্লাহর কসম! তুমি আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় ভূমি এবং আমার কাছেও সবচেয়ে প্রিয়। যদি তোমার অধিবাসীরা আমাকে বের করে না দিত, তবে আমি কখনোই তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।- (সুনান আত-তিরমিজি: ৩৯২)
এই হাদিস স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে, স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা ঈমানের পরিপন্থী নয়। বরং অন্যায়ের কারণে দেশ ছাড়তে বাধ্য হলেও, স্বদেশে ফিরে আসার আকাক্সক্ষা মানবিক ও ইসলামসম্মত।
স্বদেশ প্রত্যাবর্তন মানে দায়িত্ব গ্রহণ
ইসলাম মানুষকে নিঃসঙ্গ দর্শক হতে শেখায় না; বরং সমাজের কল্যাণে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে উৎসাহ দেয়। কোরআনে বলা হয়েছে- তোমাদের মধ্য থেকে এমন একটি দল থাকা উচিত, যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে, সৎকাজের আদেশ দেবে এবং অসৎকাজে নিষেধ করবে।-(সুরা আলে ইমরান : ১০৪)
প্রবাসে অর্জিত অভিজ্ঞতা, শিক্ষা ও দক্ষতা যদি নিজ দেশের মানুষের কল্যাণে কাজে না লাগে, তবে সেই অর্জন অপূর্ণ থেকে যায়। তাই স্বদেশে প্রত্যাবর্তন মানে কেবল ফিরে আসা নয়; বরং দেশের উন্নয়ন ও নৈতিক পুনর্গঠনে অংশগ্রহণ করা।
নবীদের জীবনেও প্রত্যাবর্তনের দৃষ্টান্ত
কোরআনে নবীদের জীবনে স্বদেশে ফিরে আসার বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। হজরত মূসা (আ.) অন্যায় পরিস্থিতির কারণে মিসর ত্যাগ করে মাদইয়ানে অবস্থান করেন। পরে আল্লাহর নির্দেশে তিনি আবার মিসরে ফিরে যান তাঁর জাতিকে মুক্তির পথ দেখাতে- অতঃপর তুমি ফেরাউনের নিকট যাও, সে সীমালঙ্ঘন করেছে।- ( সুরা তাহা : ২৪) এই প্রত্যাবর্তন ছিল ভোগের জন্য নয়; বরং দায়িত্ব পালনের জন্য। এখানেই ইসলামের মৌলিক শিক্ষা- যোগ্যতা অর্জনের পর স্বদেশে ফিরে এসে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো।
কৃতজ্ঞতা ও শিকড়ের প্রতি দায়বদ্ধতা
রাসুলুল্লাহ (সা.) কৃতজ্ঞতাকে ঈমানের অংশ হিসেবে উল্লেখ করেছেন- যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞ নয়, সে আল্লাহর প্রতিও কৃতজ্ঞ নয়।- (সুনান আবু দাউদ : ৪৮১১) স্বদেশ সেই সমাজের বৃহত্তর রূপ, যে সমাজ মানুষকে গড়ে তোলে। তাই স্বদেশে ফিরে এসে মানুষের পাশে দাঁড়ানো কৃতজ্ঞতার বাস্তব প্রকাশ।
প্রত্যাবর্তনে ধৈর্য ও ইতিবাচক মানসিকতা
দীর্ঘ প্রবাসজীবনের পর স্বদেশে ফিরে অনেকেই হতাশ হন-ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, সামাজিক অবক্ষয় কিংবা রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখে। কিন্তু ইসলাম হতাশাকে নিরুৎসাহিত করে। কোরআনে বলা হয়েছে- নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।” - (সুরা বাকারা : ১৫৩) রাসুল (সা.) আরও বলেছেন- মুমিনের অবস্থা বিস্ময়কর। তার সব অবস্থাই কল্যাণকর।- (সহিহ মুসলিম : ২৯৯)
এই শিক্ষা স্বদেশে প্রত্যাবর্তনকারীদের জন্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য—সমস্যার মাঝেও কল্যাণের পথ খুঁজে নেওয়া।
পরিশেষে বলতে চাই, স্বদেশে প্রত্যাবর্তন ইসলামের দৃষ্টিতে নিছক আবেগের বিষয় নয়। এটি ঈমান, দায়িত্ব ও মানবিকতার সমন্বিত রূপ। কোরআন ও হাদিস আমাদের শেখায়- জুলুমের মুখে প্রয়োজনে দেশ ছাড়তে হয়, আবার সুযোগ এলে স্বদেশে ফিরে এসে ন্যায়, সত্য ও কল্যাণের পক্ষে দাঁড়ানোই প্রকৃত সফলতা। স্বদেশে ফেরা মানে শুধু ঘরে ফেরা নয়; নিজের শিকড়ে, নিজের মানুষের কাছে এবং নিজের দায়িত্বের জায়গায় ফিরে আসা। আর এই প্রত্যাবর্তন যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি ও মানুষের কল্যাণের নিয়তে হয়, তবে তা নিঃসন্দেহে ইবাদতের মর্যাদা লাভ করে।
লেখক : কলাম লেখক ও গবেষক ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি

