Logo

ইসলাম

ফজরের ভোরে ঈমান পরীক্ষা, তাকওয়া অর্জন ও জান্নাতের সুখবর

Icon

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

প্রকাশ: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৭:১০

ফজরের ভোরে ঈমান পরীক্ষা, তাকওয়া অর্জন ও জান্নাতের সুখবর

নামাজ মুমিনদের বৈশিষ্ট্য। একমাত্র মুমিনই আল্লাহর কাছে মর্যাদাশীল। আর কোরআনে বহু জায়গায় মুমিনদের একটি গুণ এই উল্লেখ করা হয়েছে যে, তারা নামায কায়েম করে। এর মধ্য দিয়ে আল্লাহ বস্তুত নামাযের উপর গুরুত্বারোপ করছেন যে, যদি মুমিন হও তাহলে নামায কায়েম কর। আল্লাহ ইরশাদ করেন- তোমাদের বন্ধু তো কেবল আল্লাহ, তাঁর রাসুল ও মুমিনগণ, যারা সালাত কায়েম করে, যাকাত আদায় করে এবং তারা বিনয়ী। (সূরা মায়েদা: ৫৫)

আল্লাহ অন্যত্র বলেছেন- "মুমিন তো তারাই, (যাদের সামনে) আল্লাহকে স্মরণ করা হলে তাদের হৃদয় ভীত হয় এবং যখন তাদের সামনে তাঁর আয়াতসমূহ পড়া হয়, তখন তা তাদের ঈমান বাড়িয়ে দেয় এবং তারা তাদের রবেরই উপর ভরসা করে। যারা নামায কায়েম করে এবং আমি তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি, তা থেকে ব্যয় করে। তারাই সত্যিকার মুমিন। তাদের জন্য তাদের রবের কাছে রয়েছে বহু মর্যাদা, ক্ষমা ও সম্মানজনক রিযিক।" (সূরা আনফাল: ২-৪)

এখানে সত্যিকার মুমিনদের গুণাবলি কী তা আলোচনা করা হয়েছে। তাদের একটি গুণ হল তারা নামায কায়েম করে। এ থেকে বোঝা গেল সত্যিকার মুমিন হতে হলে নামায আদায় করতে হবে। নামায ছাড়া সত্যিকার মুমিন হওয়া যাবে না।

শীতের সকাল মানেই ঘন কুয়াশা, কনকনে ঠান্ডা বাতাস এবং আরামদায়ক বিছানার প্রবল টান। এই সময় ঘুম ভেঙে ওঠা মানুষের জন্য স্বাভাবিকভাবেই কঠিন। ঠিক এই মুহূর্তেই ফজরের নামায একজন মুমিনের জন্য ঈমানের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা হয়ে দাঁড়ায়। শীতের কষ্ট উপেক্ষা করে যে ব্যক্তি আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে নামাযে দাঁড়ায়, সে প্রকৃত অর্থে আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয়। কোরআন ও হাদিসে ফজরের নামাযের গুরুত্ব বিশেষভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

১. ফেরেশতাদের সাক্ষ্যপ্রাপ্ত বিশেষ ইবাদত

আল্লাহ তাআলা কোরআনে বলেন- আর ফজরের নামায; নিশ্চয়ই ফজরের নামাযে রাত ও দিনের ফেরেশতারা উপস্থিত থাকে। (সূরা বনি ইসরাইল: ৭৮) এই আয়াত থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, ফজরের নামায এমন এক ইবাদত, যা সরাসরি ফেরেশতাদের সাক্ষ্য লাভ করে। সহিহ হাদিসে এসেছে, রাতের ফেরেশতা ও দিনের ফেরেশতা ফজরের সময় একত্রিত হয়। (সহিহ বুখারি ৫৫৫) শীতের সকালে কষ্ট সহ্য করে এই নামায আদায় করলে এর সওয়াব ও মর্যাদা আরও বৃদ্ধি পায়।

২. শীতের সকালে ফজরের নামায: ঈমানের বাস্তব পরীক্ষা

ফজরের নামায ঘুম ভেঙে আদায় করতে হয়, আর শীতকালে এই কাজ আরও কঠিন হয়ে ওঠে। এই কঠিন মুহূর্তেই আল্লাহ বান্দার ঈমান যাচাই করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-"মানুষ কি মনে করে যে, 'আমরা ঈমান এনেছি' বললেই তাদের পরীক্ষা করা হবে না?" (সূরা আল-আনকাবুত: ২)

শীতের সকালে ফজরের নামায আদায় করা এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার একটি বাস্তব ও জীবন্ত দৃষ্টান্ত।

৩. মুনাফিকি থেকে মুক্ত থাকার সুস্পষ্ট প্রমাণ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- "মুনাফিকদের কাছে সবচেয়ে কঠিন নামায হলো এশা ও ফজরের নামায।"(সহিহ বুখারি: ৬৫৭; সহিহ মুসলিম: ৬৫১) এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, নিয়মিত ফজরের নামায আদায় করা ঈমানের দৃঢ়তার পরিচয় এবং মুনাফিকি থেকে মুক্ত থাকার একটি স্পষ্ট আলামত।

৪. দুনিয়া ও আখিরাতের শ্রেষ্ঠ সম্পদ

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- ফজরের দুই রাকাত সুন্নত দুনিয়া ও দুনিয়ার সব কিছুর চেয়েও উত্তম।" (সহিহ মুসলিম: ৭২৫) যখন কেবল সুন্নতের মর্যাদা এত বেশি, তখন ফজরের ফরজ নামাযের গুরুত্ব যে কত মহানড়তা সহজেই অনুমেয়। শীতের সকালে সামান্য কষ্ট আল্লাহ অশেষ সওয়াবে পরিণত করেন।

৫. আল্লাহর জিম্মা ও নিরাপত্তা লাভ

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে ব্যক্তি ফজরের নামায আদায় করে, সে আল্লাহর জিম্মায় থাকে। (সহিহ মুসলিম: ৬৫৭) আল্লাহর জিম্মায় থাকা মানে দুনিয়া ও আখিরাতের নিরাপত্তা, হেফাজত ও কল্যাণ লাভ করা। শীতের সকালে ফজরের নামায এই নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতিকে আরও দৃঢ় করে।

৬. জান্নাতে প্রবেশের নিশ্চিত সুসংবাদ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি দুই ঠান্ডা সময়ের নামায (ফজর ও আসর) আদায় করে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। "(সহিহ বুখারি ৫৭৪; সহিহ মুসলিম: ৬৩৫)

শীতকালে ফজরের নামায প্রকৃত অর্থেই 'ঠান্ডা সময়ের নামায'। তাই এই সময়ের ইবাদত জান্নাতের পথে অগ্রসর হওয়ার এক শক্তিশালী মাধ্যম।

৭. অন্তরের নূর ও দিনের বরকত

আল্লাহ তাআলা বলেন- আল্লাহই আসমানসমূহ ও জমিনের নূর।" (সূরা আন-নূর: ৩৫) ফজরের নামাযের মাধ্যমে বান্দা এই নূরের অংশীদার হয়। শীতের অন্ধকার ভেদ করে নামাযে দাঁড়ালে অন্তরে এমন নূর সৃষ্টি হয়, যা সারাদিন মানুষকে গুনাহ থেকে দূরে রাখে এবং জীবনে বরকত দান করে।

৮. পরিবার ও সমাজ গঠনে ফজরের নামায আল্লাহ তাআলা বলেন- তোমরা নিজেদের ও তোমাদের পরিবারকে আগুন থেকে রক্ষা করো।" (সূরা আত-তাহরিম: ৬)

পরিবারকে শীতের সকালে ফজরের নামাযে অভ্যস্ত করা মানে তাদের ঈমানি আলোয় আলোকিত করা। এর ফলে পরিবারে শৃঙ্খলা, নৈতিকতা ও আল্লাহভীতি প্রতিষ্ঠিত হয়, যা একটি সুস্থ সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

৯. আল্লাহর বিশেষ ভালোবাসা অর্জনের কারণ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- আল্লাহ তাআলা সেই বান্দার প্রতি বিস্মিত হন, যে শীতল বিছানা ছেড়ে আমার নামাযের জন্য উঠে আসে। "(মুসনাদ আহমাদ : ২৩৮০২)

এই হাদিস শীতের সকালে ফজরের নামাযের বিশেষ মর্যাদা ও আল্লাহর ভালোবাসা অর্জনের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরে।

পরিশেষে বলতে চাই, শীতের সকালে ফজরের নামায আদায় করা কেবল একটি ফরজ দায়িত্ব পালন নয়; বরং এটি ঈমানের শক্তি, তাকওয়ার পরিচয় এবং জান্নাত অর্জনের একটি নিশ্চিত পথ। যে ব্যক্তি শীতের কষ্ট উপেক্ষা করে আল্লাহর ডাকে সাড়া দেয়, আল্লাহ তার দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জীবনকে বরকত, নিরাপত্তা ও

কল্যাণে ভরে দেন। তাই আসুন, শীতের প্রতিটি ভোরকে ফজরের নামাযের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের সুবর্ণ সুযোগে পরিণত করি।

লেখক : ধর্ম বিষয়ক প্রবন্ধকার ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান: জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

ইসলাম ধর্ম

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর