Logo

আইন ও বিচার

ভিক্ষাবৃত্তি: জনসম্মুখে বিকলাঙ্গতা প্রদর্শন আইন ও বাস্তবতা

Icon

আইন ও আদালত ডেস্ক

প্রকাশ: ২৬ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০৪

ভিক্ষাবৃত্তি: জনসম্মুখে বিকলাঙ্গতা প্রদর্শন আইন ও বাস্তবতা

রাজধানীর বিভিন্ন সড়কপথ, জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ ও উত্তরগেট, অন্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সামনে, রেলক্রসিং, বাস স্টপ অথবা ভিআইপি এলাকায় দেখা যায় একজন ভিক্ষুক তার দেহের ব্যাথা, তুলে ধরা প্রদাহ বা অঙ্গপ্রতিবন্ধিতা দেখিয়ে অন্যান্যদের সহানুভূতি আকর্ষণ করেন।

অনেক সময় এটি সত্য, কিন্তু নানারকম ভিক্ষুক সিন্ডিকেট এমন কৌশলও ব্যবহার করে অক্ষমতা বা রোগ দেখিয়ে ভিক্ষা তোলায়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, এ ধরনের “দূরারোগ্যতা প্রদর্শন” আইনগত দৃষ্টিকোণ থেকে কী দণ্ডনীয়, এবং বাস্তবে কীভাবে আইন প্রয়োগ হচ্ছে- এ প্রতিবেদনে সে দৃষ্টিকোণ তুলে ধরা হলো।

ভিক্ষাবৃত্তি ও প্রদর্শন অপরাধ : বাংলাদেশে ভিক্ষুকতা এবং জনসম্মুখে অঙ্গপ্রতিবন্ধতা বা রোগ প্রদর্শন বিষয়ে আইন রয়েছে, যা মূলত দৃষ্টিপাত করে ‘ভিক্ষাবৃত্তি’ এবং ‘ভবঘুরে বা নিরাশ্রয় ব্যক্তির অবস্থা’। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অরডিন্যান্স, ১৯৭৬ (DMP Ordinance, 1976)

ধারা ৮১ অনুযায়ী: “যে কোন ব্যক্তি সড়ক বা জন স্থান (public place)-এ ভিক্ষা চায় বা দান আবেদন করে, অথবা দেহে যন্ত্রণাদায়ক ক্ষত, প্রদাহ, অঙ্গপ্রতিবন্ধ বা বিকৃতি ‘উদ্দীপক দান আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্যে’ প্রদর্শন করে দণ্ডনীয় অপরাধ।  সাজা: সর্বোচ্চ এক মাস কারাদণ্ড। বহু সমালোচনায় এটি একটি স্পষ্ট ‘স্টেটাস ক্রাইম’ (status crime) হিসেবে বিবেচিত হয় অর্থাৎ দারিদ্র্য, অভাব বা প্রতিবন্ধিতাকে অপরাধ হিসেবে দণ্ডন করা হচ্ছে। 

ভবঘুরে ও নিরাশ্রয় ব্যক্তি (পুনর্বাসন) আইন, ২০১১ : ২০১১ সালের এই আইনটি প্রবর্তন করা হয় পুরাতন অনানুষ্ঠানিক “ভাগ্যাপত্র আইন” বা ভ্যাগ্রেন্স অ্যাক্ট (Vagrancy Act, ১৯৪৩-এর উত্তরাধিকারে)।  আইন ‘ভাগ্রান্ট (vagrant)’ এর সংজ্ঞা দেয়, এবং পুলিশ ও বিচারকারীদের যথেষ্ট ক্ষমতা দেয় তাদের গ্রেপ্তার ও পুনর্বাসন কেন্দ্র পাঠানোর জন্য।  একবার “vagrant” হিসেবে শনাক্ত হলে, একরকম “receiving centre” বা আশ্রয় কেন্দ্র (shelter home)-এ  সর্বোচ্চ ২ বছর সময়ের জন্য আটকা রাখা যেতে পারে।

যদি কেউ সেই কেন্দ্র থেকে পালিয়ে যায়, পালানোর জন্য তাকে ৩ মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড দেওয়া যেতে পারে।  আইনটি বলে যে গ্রেফতার বা সেন্টারে নেয়ার আগে “সোমালোচনা রিপোর্ট” বা অন্য প্রক্রিয়া থাকতে পারে, কিন্তু বাস্তবায়ন নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে।  এটি মোবাইল কোর্ট মাধ্যমে বিচারযোগ্য অপরাধ হিসেবে ধরা হয়েছে। 

শিশু আইন, ২০১৩ : ধারা ৭১: “শিশুকে ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত করা” অপরাধ। যদি কোনো ব্যক্তি শিশুকে ভিক্ষার কাজে কাজে লাগায়, তাকে সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদণ্ড অথবা ১ লাখ টাকা জরিমানা হতে পারে।  এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ অনেক ভিক্ষুক সিন্ডিকেট শিশুদের এবং অক্ষম শিশুকে কাজে লাগায় জনসুমুখে দান খয়রাত নেয়ার জন্য ।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ : আইনি ধারা রয়েছে ভিক্ষাবৃত্তি উদ্দেশ্যে শিশুর অঙ্গহানির জন্য (“ভিক্ষাবৃত্তি, ইত্যাদির উদ্দেশ্যে শিশুকে অঙ্গহানি”)। অর্থাৎ, শুধুমাত্র ভিক্ষায়ী করা নয়, যদি ভিক্ষাবৃত্তি উদ্দেশ্যেই শিশুকে শারীরিকভাবে দৃষ্টি আকর্ষণযোগ্য প্রতিবন্ধতার দিকে পরিচালিত করা হয় (অঙ্গহানি)- তা আইনগতভাবে দণ্ডনীয়। আইন থাকলেও, বাস্তবে এটি কতটা কার্যকর এবং ন্যায্যভাবে প্রয়োগ হচ্ছে  তাতে অনেক প্রশ্ন রয়েছে।

নতুম আইনটি এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যে পুনর্বাসন বলে যতদূর সম্ভব দণ্ড প্রদানে নজর বেশি রয়েছে, প্রকৃত ‘সহায়তা’ বা বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ কম। 

বিশেষত নারী ও শিশুকে গ্রেপ্তার করার সময় আইন সুনির্দিষ্ট গ্যারান্টি বা সুরক্ষা নাও দিতে পারে- মহিলা গ্রেফতার হলে মহিলা পুলিশ অফিসার নিয়োগ, নারী-বিশেষ বিধান, সেন্টারে বিশেষ স্পেস ইত্যাদির অভাব রয়েছে বলে সমালোচনা রয়েছে। 

আদালতে দেখা গেছে, ভিক্ষাবৃত্তি নিয়ে উচ্চ আদালত নির্দেশনা দিয়েছে, এবং ‘Beggars Rehabilitation and Alternative Employments Program -এর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা আছে।  পুলিশ প্রায় সবাইকে ধরতে পারে না বা ধরতে চায় না- অনেকেই বলছেন অনেক সময় ভিক্ষুকদের ধরার ক্ষেত্রে নরম মনোভাব রয়েছে বা প্রাথমিকভাবে “দরিদ্র অনুভব” নিয়ে আইন প্রয়োগ অনিয়মিত।  পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলোতে পর্যাপ্ত সুযোগ বা অবকাঠামো নেই বলে অভিযোগ। অনেক “আশ্রয় কেন্দ্র” অতিরিক্ত ভিড়, অপর্যাপ্ত চিকিৎসা, অবহেলা বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়ে থাকে। 

আরেকটি বড় সমস্যা- পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য অপরাধ ধারা রয়েছে, যা “পুনর্বাসন” প্রক্রিয়াকে দণ্ডমূলক হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ দেয়।  ভিক্ষুক গ্যাং ভিক্ষাকে পরিচালনা করে, যেখানে শারীরিক প্রতিবন্ধিতা বা অসুস্থতা “শখ করে” উপস্থাপন করা হয় দান বাড়ানোর জন্য, এবং এই গ্যাং আইন বা পুনর্বাসন ব্যবস্থার ফাঁক ব্যবহার করে থাকে।

দারিদ্র্য এবং অক্ষমতা এমন বিষয় যা সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং সহানুভূতির ভিত্তিতে সমাধান করা উচিত, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নয়। যখন পুনর্বাসন কেন্দ্র “জেল” বা কারাগারের মতো আচরণ করে, এটি আইনগত “সহজ শরণস্থল” না হয়ে দারিদ্র্য দমনে বাধ্যতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে পরিণত হতে পারে। আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগে অন্তর্ভুক্ত “ভিক্ষাবৃত্তি-সিন্ডিকেট” এর মিথ্যা বক্তৃতা ও শোষণমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সামাজিক ন্যায্যতা এবং মানবাধিকার বিমূর্ত ব্যালেন্সিং প্রয়োজন।

আইনজীবী সেলিম রহমান বলেন, ‘এই সমস্যার সমাধান কেবল আইন থাকা নয়, বরং নীতি, কার্যকারিতা এবং সমাজকে পরিবর্তন করার প্রয়োজন। পুনর্বাসন আইন পুনর্মূল্যায়ন করা উচিত যাতে দারিদ্র্য ও অক্ষমতা শাস্তিমূলক বিষয় হিসেবে নয়, সবচেয়ে প্রথমে সহায়তার বিষয় হিসেবে দেখা হয়। পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলোর আইনগত এবং প্রশাসনিক কাঠামোতে সুষম মনিটরিং এবং স্বচ্ছতা আনা দরকার-  যেন মানবাধিকার লঙ্ঘন রোধ করা যায়।’

পালানোর অপরাধ ধারা পুনর্বিচার করা এবং বিকল্প বা কম দণ্ডমূলক ব্যবস্থা (যেমন সামাজিক পর্যবেক্ষণ, কমিউনিটি সাপোর্ট) দেখা যেতে পারে। সরকার এবং দাতব্য সংস্থা (NGO)-গুলোর মধ্যে সমন্বয় বাড়িয়ে “ভিক্ষুক পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থাপন” কার্যক্রম সম্প্রসারিত করা।

পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলোর জন্য পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ এবং স্টাফ-প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন, বিশেষ করে নারীদের এবং শিশুর জন্য আলাদা, নিরাপদ ব্যবস্থাপনা। সচেতনতা এবং শিক্ষা প্রচার করা, যাতে সাধারণ জনগণ বুঝতে পারে ভিক্ষুকতা সমস্যার পেছনে দারিদ্র্য, যৌক্তিকতা এবং মানবাধিকার দৃষ্টিকোণ রয়েছে; এবং দান করার সময় ফলে-প্রভাব বা বিকল্প সহায়তা পথ সম্পর্কে ধারণা গড়ে ওঠে।

পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসন ও সমাজসেবার সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো দরকার যাতে ভিক্ষাবৃত্তি আইন প্রয়োগ করা হলেও পুনর্বাসন এবং মানবিক ব্যবস্থাপনায় ভারসাম্য বজায় থাকে। স্বাধীন মনিটরিং (যেমন মানবাধিকার সংগঠন, সিভিল সোসাইটি) স্থাপন করা উচিত, যারা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করবে পুনর্বাসন কেন্দ্র এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কার্যকলাপ।

জনসম্মুখে ভিক্ষাবৃত্তি ও অঙ্গপ্রতিবন্ধিতা প্রদর্শন কেবল সামাজিক সমস্যা নয়, আইনগত ও মানবাধিকার বিষয়ও। বর্তমান আইন- যেমন DMP Ordinance, ১৯৭৬ এবং ভ্যাগ্রান্স (Rehabilitation) আইন, ২০১১- দারিদ্র্যকে দণ্ড করার দৃষ্টিকোণ যোগ করে কিনা, তা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আইন প্রয়োগকারীদের সঙ্গে সমাজ ও সিভিল সোসাইটিরও দায়িত্ব রয়েছে: শুধু গ্রেফতার বা দমনের মাধ্যমে নয়, পুনর্বাসন এবং বিকল্প কর্মসংস্থান গড়ে তুলে বাস্তব সমাধান করতে হবে।

দেশকে “ভিক্ষাবৃত্তিমুক্ত” করার কথা বলা হলেও, এই পথ মানবিক, ন্যায়সঙ্গত এবং দীর্ঘমেয়াদী হতে হবে, শাস্তি নয়, সহযোগিতার ভিত্তিতেই। সমাজসেবা অধিদপ্তর-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ১৪১টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনায় প্রায় ২,৯০০ জন ভিক্ষুকে আটক করা হয়েছিল।  একই সময়ে, পর্যাপ্ত স্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্র না থাকার কারণে কিছু ভিক্ষুকে “ভিক্ষা না করার শর্তে” ছাড়া হয়েছিল — উঝঝ বলেছে, ৭৫০ জনকে এমনভাবে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। 

ভিক্ষাবৃত্তি এবং জনসুমুখে বিকলাঙ্গতা বা রোগ প্রদর্শন শুধুমাত্র আইনগত একটি সমস্যা নয়- এটি একটি সামাজিক ও মানবিক চ্যালেঞ্জ। পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট যে, সরকারের গ্রেফতার ও পুনর্বাসন উদ্যোগ রয়েছে, কিন্তু বর্তমান ব্যবস্থায় কার্যকারিতা, স্বচ্ছতা এবং মানবিক দৃষ্টিকোণ পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে না। একটি ন্যায়সঙ্গত, মানবিক এবং কার্যকর নীতি গঠন করতে হলে শুধু দণ্ড নয়, কিন্তু পুনর্বাসন, জীবিকা উন্নয়ন ও সামাজিক পুনর্গঠনে মনোনিবেশ অত্যাবশ্যক। 

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

আইন ও আদালত

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর