এজাহারে নাম না থাকলেও আসামি করা যায়! আইন কী বলে?
আইন ও আদালত ডেস্ক
প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:৩১
ফৌজদারি মামলার সূচনা হয় এজাহার বা এফআইআর দিয়ে। কিন্তু এজাহারে যার নাম নেই, তিনি কি কখনও মামলার আসামি হতে পারেন? বাস্তবে বহু মামলায় দেখা গেছে- আদালত ও তদন্ত সংস্থা পরবর্তী পর্যায়ে নতুন ব্যক্তিকে আসামি হিসেবে যুক্ত করেছে। এই প্রসঙ্গে আইন কী বলছে, কোন কোন ক্ষেত্রে এবং কীভাবে নতুন আসামি অন্তর্ভুক্ত করা যায়- তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত ও আইনি বিশ্লেষণ তুলে ধরা হলো।
আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, এজাহার কেবল একটি প্রাথমিক দলিল, অপরাধ তদন্তের মূল ভিত্তি নয়। অনেক সময় ঘটনার মুহূর্তে ভুক্তভোগী বা অভিযোগকারী আতঙ্ক, বিভ্রান্তি বা পরিস্থিতির চাপের কারণে সব আসামির নাম উল্লেখ করতে পারেন না। আবার অনেক সময় প্রকৃত অপরাধীরা সচেতনভাবে নিজেদের আড়ালে রাখেন। ফলে তদন্তেই বেরিয়ে আসে নতুন তথ্য, নতুন নাম এবং অপরাধে সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ।
তদন্তে নতুন তথ্য এলে যুক্ত হতে পারে নতুন আসামি। পুলিশ তদন্ত চলাকালে যদি প্রমাণ পায় যে অপরাধে অন্য কেউ জড়িত ছিল, তবে তাকে চার্জশিটে আসামি হিসেবে যুক্ত করা যায়। তদন্ত কর্মকর্তা সাক্ষ্য, জবানবন্দি, সিসিটিভি ফুটেজ, ফরেনসিক রিপোর্ট, কল রেকর্ড বা অন্যান্য প্রযুক্তিগত তথ্যের ভিত্তিতে ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা নিশ্চিত করলে আইন অনুযায়ী তাকে গ্রেপ্তার ও জিজ্ঞাসাবাদ করাও সম্ভব।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আধুনিক অপরাধ তদন্তে সিসিটিভি ফুটেজ, মোবাইল লোকেশন, ডিএনএ রিপোর্টই অনেক সময় নতুন অপরাধীর পরিচয় তুলে আনে। এ ক্ষেত্রে এজাহারে নাম না থাকলেও ওই ব্যক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করতে বাধা নেই। আদালতের নিজস্ব ক্ষমতায় নতুন আসামি যুক্ত করার বিধান। ফৌজদারি কার্যবিধির ৩১৯ ধারায় আদালতকে বিশেষ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ চলাকালে যদি আদালত মনে করে যে সাক্ষ্য ও প্রমাণে অন্য কারও জড়িত থাকার বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে- তাহলে আদালত নিজেই তাকে নতুন আসামি হিসেবে যুক্ত করতে পারেন। এই ক্ষমতা আদালতের একান্ত নিজস্ব এবং বিচারকার্যের স্বার্থেই প্রয়োগ করা হয়।
বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, পাকিস্তানসহ কমনওয়েলথ দেশগুলোতে একই বিধানের মাধ্যমে আদালত যে কাউকে নতুন আসামি হিসেবে তলব ও গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিতে পারে। ভুক্তভোগী বা রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে আসামি যোগ করা। মামলার বাদী, ভুক্তভোগী অথবা রাষ্ট্রপক্ষ চাইলে আদালতে আবেদন করে নতুন ব্যক্তিকে আসামি করার অনুরোধ করতে পারেন। সাধারণত এই আবেদন দেয়া হয়- নতুন প্রমাণ উদঘাটিত হলে পূর্বে নাম বাদ পড়া আসামির সম্পৃক্ততা স্পষ্ট হলে, প্রভাবশালী ব্যক্তির কারণে নাম গোপন করা হয়েছে বলে সন্দেহ হলে আদালত প্রাথমিক যাচাই করে যদি যুক্তিযুক্ত মনে করে, তাহলে নতুন আসামি যুক্ত করার নির্দেশ দেয়।
কোন কোন পরিস্থিতিতে এজাহারে নাম না থাকলেও আসামি করা হয়- তদন্তে নতুন প্রমাণ পাওয়া গেলে, সাক্ষীর জবানবন্দিতে নতুন নাম এলে, সিসিটিভি বা প্রযুক্তিগত প্রমাণে সম্পৃক্ততা দেখা দিলে, ফরেনসিক রিপোর্টে নতুন পরিচয় বের হলে, আদালত সাক্ষ্যগ্রহণ চলাকালে নিজ উদ্যোগে নির্দেশ দিলে, ইচ্ছাকৃতভাবে প্রকৃত অপরাধীর নাম এজাহার থেকে বাদ দেয়া প্রমাণিত হলে,
আইনের প্রতিকার : নতুন আসামি কী করতে পারবেন? এজাহারে নাম না থাকলেও যখন কেউ আসামি হন, তখন আইন তাকে কয়েকটি প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ দেয়-
জামিন আবেদন : আসামি আদালতে জামিন চাইতে পারেন। আদালত তার সম্পৃক্ততা, প্রমাণের শক্তি এবং ঝুঁকি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে।
অব্যাহতির আবেদন (ডিসচার্জ) : যদি প্রমাণ দুর্বল বা ভিত্তিহীন হয়, তিনি অভিযোগপত্রের প্রাথমিক ধাপে অব্যাহতির আবেদন করতে পারেন।
রিভিশন আবেদন : আদালতের সিদ্ধান্ত ভুল মনে হলে তিনি উচ্চ আদালতে রিভিশন আবেদন করতে পারবেন।
মিথ্যা মামলার বিরুদ্ধে প্রতিকার : যদি দেখা যায় কাউকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে জড়ানো হয়েছে, তবে তিনি মানহানি মামলা বা ক্ষতিপূরণের আবেদনও করতে পারেন।
আইনজীবীরা মনে করেন, এজাহারই চূড়ান্ত দলিল- এ ধারণা ভুল। তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়ার সময় অপরাধী চিহ্নিত করাই আইনের মূল লক্ষ্য। তাই এজাহারে নাম না থাকা কোনো অবস্থাতেই অপরাধ থেকে ছাড় পাওয়ার নিশ্চয়তা নয়।
একজন অপরাধবিষয়ক বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশের খবরকে বলেন, “সত্যিকারের অপরাধী যেন ধরা পড়ে এবং নির্দোষ কেউ যেন হয়রানির শিকার না হয়- এটাই বিচারব্যবস্থার মূল নীতি। এ কারণে তদন্তের সময় নতুন আসামি যুক্ত করার সুযোগ রাখা হয়েছে।”
এজাহারে নাম না থাকা মানে দায়মুক্তি নয়। অপরাধে যে-ই জড়িত থাকুক, তদন্ত ও আদালতের প্রমাণই তার অবস্থান নির্ধারণ করে। প্রমাণ-ভিত্তিক বিচার নিশ্চিত করতেই আইনি কাঠামো এমনভাবে তৈরি হয়েছে যে প্রয়োজন হলে যেকোনো সময় নতুন আসামি যুক্ত করা যাবে। তবে একই সঙ্গে আসামির সুরক্ষার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে, যাতে কাউকে অযথা হয়রানি করা না যায়। আইন অনুযায়ী সত্যই চূড়ান্ত, এজাহার নয়।

