আপনার অধিকার ও পুলিশের সীমাবদ্ধতা
সর্বোচ্চ রিমান্ড ১৫ দিন: রাত ৮টারপর নারী গ্রেপ্তারে সতর্কতা
মাসুম আহম্মেদ
প্রকাশ: ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:৪৪
বাংলাদেশে পুলিশি ক্ষমতা, গ্রেফতার ও হেফাজত- সবই আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। অনেক নাগরিকই জানেন না, গ্রেফতারের মুহূর্ত থেকে আদালতে তোলা পর্যন্ত তাদের কী অধিকার রয়েছে এবং পুলিশ কোন সীমার মধ্যে কাজ করতে বাধ্য। এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হলো নাগরিকের অধিকার ও পুলিশের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা।
গ্রেফতারের সময় আপনার মৌলিক অধিকার রয়েছে গ্রেফতারের কারণ জানার। সংবিধান অনুযায়ী, আপনাকে গ্রেফতার করার সঙ্গে সঙ্গে কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে তা স্পষ্টভাবে জানানো বাধ্যতামূলক। অস্পষ্ট বা অযৌক্তিক কারণে আটক করা আইনবিরোধী। আপনার রয়েছে আইনজীবীর সাহায্য পাওয়ার অধিকার। গ্রেফতারের পর আপনার আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগের অধিকার রয়েছে। পুলিশ এরূপ যোগাযোগে বাধা দিলে তা মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন হবে।
নির্যাতনমুক্ত থাকার অধিকার : পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদ বা হেফাজতে মানসিক বা শারীরিক নির্যাতন সংবিধান ও আইন উভয়েই নিষিদ্ধ। পুলিশ রিমান্ডেও নির্যাতন করা আইনত অপরাধ।
পরিবারকে খবর দেওয়ার অধিকার : গ্রেফতারের পর পুলিশের উচিত দ্রুত আপনার পরিবার বা পরিচিতজনকে জানানো। কাউকে ‘গায়েব’ করে রাখা আইন লঙ্ঘন।
হেফাজতে সময়সীমা : পুলিশ কতক্ষণ রাখতে পারে- গ্রেফতারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধান ও ফৌজদারি কার্যবিধি (CrPC) ৬১ ধারা অনুযায়ী- গ্রেফতারের পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে (আনা-নেয়ার সময় বাদে) ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করা বাধ্যতামূলক। এর বেশি সময় থানায় আটকে রাখা বেআইনি।
একাধিক অধিকারকর্মীরা বাংলাদেশের খবরকে জানান, আইন অনুযায়ী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করার কথা হলেও, অনেক ক্ষেত্রে বিলম্ব, রিম্যান্ডের অতিরিক্ত ব্যবহার, এবং গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ বাধাগ্রস্ত করার অভিযোগ পাওয়া যায়। এছাড়া কিছু ক্ষেত্রে পুলিশি হেফাজতে নির্যাতন, জিজ্ঞাসাবাদের নামে মানসিক চাপ বা পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাতের সীমাবদ্ধতাও আলোচিত সমস্যা।
আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন- “সংবিধান ও CrPC-তে অধিকার স্পষ্টভাবে বলা থাকলেও, আইন বাস্তবায়নেই বড় ঘাটতি দেখা যায়।”
রিম্যান্ডের সীমা : তদন্তের প্রয়োজনে আদালতের অনুমতি ছাড়া পুলিশ আপনার হেফাজত বাড়াতে পারে না। আদালত অনুমোদন দিলে রিমান্ড দেওয়া যায়, তবে রিমান্ডের প্রতিটি দিন আদালতের অনুমতি অনুযায়ী, সর্বোচ্চ ১৫ দিনের বেশি নয়, এবং প্রতিটি রিমান্ডের জন্য ম্যাজিস্ট্রেটকে কারণ উল্লেখ করতে হয়।
কোন পরিস্থিতিতে পুলিশ গ্রেফতার করতে পারে : cognizable offence এর ক্ষেত্রে। যেমন- হত্যা, ডাকাতি, অস্ত্র মামলা, মাদক, চুরি, ছিনতাই ইত্যাদি গুরুতর অপরাধে পুলিশ ওয়ারেন্ট ছাড়াই গ্রেফতার করতে পারে। পরিচয় যাচাই বা সন্দেহ সন্দেহ হলে গ্রেফতার করতে পারে। যদি আপনার নাম, ঠিকানা বা পরিচয় সন্দেহজনক হয় এবং আপনি তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানান- সে ক্ষেত্রেও আপনাকে আটক করা যেতে পারে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ আবুল কালাম এই প্রতিবেদককে বলেন, `ওয়ারেন্ট ছাড়াই পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারে। যেমন- হত্যা, ডাকাতি, ছিনতাই, অস্ত্র বা মাদক আইনভঙ্গ ইত্যাদি গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নিতে পারে। এ ছাড়া পরিচয় যাচাই না হওয়া বা দেয়া তথ্য সন্দেহজনক হলে অভিযুক্তকে থানায় নেওয়া যেতে পারে।'
এছাড়া Special Powers Act (SPA) অর্থাৎ জাতীয় নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়োজনে সরকার preventive detention অর্থাৎ অপরাধ করার আগেই কাউকে আটক করতে পারে। এই আইনে প্রাথমিকভাবে ৩০ দিন, পরে মেয়াদ বাড়ানো যেতে পারে। দেশের নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য প্রয়োজনে সরকার Special Powers Act, 1974 –এর অধীনে `preventive detention' বা প্রতিরোধমূলক আটক করতে পারে। এ ধরনের আটক আদালতে উপস্থাপন ছাড়াই করা যায়, তবে লিখিত কারণ জানানো বাধ্যতামূলক।
তথ্য অনুযায়ী, প্রাথমিকভাবে ৩০ দিন পর্যন্ত আটক রাখা যায়, এরপর প্রয়োজন অনুযায়ী ৬০-৯০ দিন, সর্বোচ্চ ১২০ দিন পর্যন্ত সময় বাড়ানো যায়, উপযুক্ত সরকারি অনুমোদনের ভিত্তিতে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বহুবার এই আইনের অপব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে।
পুলিশের সীমাবদ্ধতা : তারা যা করতে পারে না- কারণ না জানিয়ে গ্রেফতার করা যাবে না। আইন অনুযায়ী, গ্রেফতারকৃত ব্যক্তি কারণ জানতে পারবেন। ২৪ ঘণ্টার বেশি আটক রাখা বেআইনি। আদালতে হাজির করার আগে সীমা অতিক্রম করা আইন লঙ্ঘন। নির্যাতন, ভয়ভীতি বা স্বীকারোক্তি আদায় নিষিদ্ধ। জোর করে আদায়ের স্বীকারোক্তি আদালত গ্রহণ করে না। নারীকে রাত ৮টার পর গ্রেফতার না করা (বিশেষ পরিস্থিতি ছাড়া)। আইন অনুযায়ী নারীর ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা মানতেই হবে। ব্যক্তিগত জিনিস বাজেয়াপ্তের ক্ষেত্রে পুলিশ কোনো জিনিস বাজেয়াপ্ত করলে তার লিখিত তালিকা দিতে হবে।
নাগরিক কী করবেন? : গ্রেফতার করতে এলে কিংবা গ্রেফতার হলে আপনি এর কারণ জানতে চাইবেন। পরিবারের কাউকে খবর দিতে বলবেন। আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগের অনুরোধ করবেন। হেফাজতের সময়সীমা অতিক্রম হলে আদালতে অভিযোগ করতে পারবেন। নির্যাতনের শিকার হলে চিকিৎসা রিপোর্ট ও ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে অভিযোগ করতে পারবেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা জজ আদালতের আইনজীবী খায়রুল কবীর বাংলাদেশের খবরকে বলেন, পুলিশ অপরাধ দমন ও জননিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব পালন করে। তবে তাদের কার্যক্রম আইনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত থাকলেই আইনশৃঙ্খলা ও বিচারব্যবস্থার উপর আস্থা বৃদ্ধি পায়। Code of Criminal Procedure (CrPC) ১৮৯৮, Special Powers Act (SPA) ১৯৭৪ এবং বাংলাদেশের সংবিধান- এই তিনটি প্রধান আইনে গ্রেফতার-হেফাজত সম্পর্কিত বিধান বর্ণিত আছে।
এনএ

