Logo

আইন ও বিচার

গ্যারেজে অবৈধ চার্জিং ব্যবসা আইন আছে প্রয়োগ নেই

Icon

মাসুম আহম্মেদ

প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:৪১

গ্যারেজে অবৈধ চার্জিং ব্যবসা আইন আছে প্রয়োগ নেই

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় রাত নামলেই গ্যারেজে শুরু হয় অন্য এক ব্যস্ততা। ব্যাটারি চালিত রিকশা, ভ্যান ও ইলেকট্রিক ত্রিচক্রযানের সারি লেগে থাকে চার্জ দেওয়ার জন্য। বাইরে থেকে দেখলে সাধারণ চার্জিং কার্যক্রম মনে হলেও বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন।

বেশিরভাগ গ্যারেজই অবৈধভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়ে নীরবে চলছে কোটি টাকার বিদ্যুৎ চুরি। আর এর প্রত্যক্ষ ফল ভোগ করছেন আবাসিক এলাকার সাধারণ মানুষ ঘনঘন লোডশেডিং, লো-ভোল্টেজ, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির ক্ষতি ও দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় চরম দুর্ভোগ।

আরও ভয়াবহ সত্য হলো এই অবৈধ সংযোগগুলো শুধু সাধারণ গ্যারেজ মালিকদের উদ্যোগে নয়; বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থার কিছু অসাধু কর্মচারী-কর্মকর্তার সহযোগিতা ছাড়া এমন চুরি অচল। বাংলাদেশের খবর এর কাছে অনেকেই অভিযোগ করেছেন, মাস শেষে নিয়মিত চাঁদা আদায় করেই গ্যারেজে অবৈধ সংযোগ টিকিয়ে রাখা হচ্ছে। ব্যাটারি রিকশা হাজার হলেও ভয়াবহ লোড নিচ্ছে এই গ্যারেজগুলো, যার কারণে আশেপাশের এলাকার মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা অন্ধকারে কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন।

অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ চলছে রাতের ব্যবসা :

রাজধানীর অনেক গ্যারেজে দেখা যায়, রাস্তায় একটি বা দুটি মিটারের নাম রয়েছে গ্যারেজ মালিকের নামে, কিন্তু গ্যারেজের ভেতরে ৫০-১০০টি রিকশা চার্জ হচ্ছে। লোডের জন্য প্রয়োজন কমপক্ষে ৩০-৬০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ। কিন্তু মিটারে রেকর্ড হয় ২-৩ কিলোওয়াট। কীভাবে সম্ভব? উত্তর একটাই- হুকিং বা ট্যাপিং। গতকাল রাজধানীর আশেপাশে এলাকায় বিভিন্ন গ্যারেজে সরোজমিনে দেখা যায়, গ্যারেজ মালিকরা বেশিরভাগ সময় বৈদ্যুতিক লাইন কেটে সরাসরি সংযোগ নেন।

অনেক ক্ষেত্রে মিটার বাইপাস করে অতিরিক্ত লোড চালানো হয়। এতে বিদ্যুৎ কোম্পানির হিসাবের বাইরে চলে যায় বিশাল বিদ্যুৎ ব্যবহার, যা সরাসরি বিদ্যুৎ চুরি। বিদ্যুৎ চুরি শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি সৃষ্টি করছে না, বরং সরবরাহ লাইন অতিরিক্ত লোড বহন করতে না পারায় পুরো এলাকায় লো-ভোল্টেজ ও লোডশেডিং হচ্ছে। অন্যদিকে, অবৈধ সংযোগের কারণে আগুন লাগার ঝুঁকিও থাকে। গ্যারেজগুলো বেশিরভাগই টিনশেড-তার জটলা, সকেটের স্তুপ, কোথাও আবার পানি জমা। একটু অসতর্কতা মানেই অগ্নিকাণ্ড।

আবাসিক এলাকায় সংকট :

মিরপুর, বাড্ডা, যাত্রাবাড়ী, কদমতলী, ডেমরা, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, মুগদা, কামরাঙ্গীরচরসহ বহু এলাকায় একই চিত্র। সন্ধ্যার পর পরই বিদ্যুৎ চলে যায়, বা ভোল্টেজ কমতে থাকে। ওইসব অঞ্চলের বাসিন্দারা অভিযোগ করেন, ‘রিকশাগুলো চার্জ নেওয়া শুরু করলেই ভোল্টেজ পড়ে যায়। বাচ্চার অনলাইন ক্লাস, অফিসের কাজ সব বন্ধ হয়ে যায়। ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন নষ্ট হচ্ছে। অথচ অভিযোগ করেও কোনো সমাধান পাওয়া যায় না।’


গতকাল সন্ধ্যার পর রাজধানীর একাধিক গ্যারেজ মালিক নিজেরাই বাংলাদেশের খবরের কাছে স্বীকার করেছেন, ‘তারা মাস শেষে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের লোককে দেন। এর বিনিময়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয় না।’ অন্যদিকে, বৈধ গ্রাহকদের রাজধানীর দক্ষিণ যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা কামাল হোসেন, শহীদুল্লাহ প্রধান এবং আওলাদ মিয়া অভিযোগ করেন, ‘আমরা বিল দেই, অথচ বিদ্যুৎ পাই না। গ্যারেজে চার্জ পড়ে বলেই লাইন লোড নেয় না।’

রাজধানীতে ব্যাটারি রিকশার সংখ্যা :

ঢাকায় বর্তমানে ব্যাটারি চালিত রিকশা ও ইলেকট্রিক ভ্যানের সংখ্যা প্রায় ৭-১০ লাখের বেশি বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। এই রিকশাগুলোর একেকটি ব্যাটারি চার্জ করতে লাগে প্রায় ৬-৮ ইউনিট বিদ্যুৎ। গড়ে একেকটি গ্যারেজ প্রতিদিন ৫০-৮০টি ব্যাটারি চার্জ করে।

অর্থাৎ প্রতিদিন এক গ্যারেজে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ :

৫০ * ৬ = ৩০০ ইউনিট (ন্যূনতম)। ঢাকায় হাজারো গ্যারেজ- যার বড় অংশই অবৈধ সংযোগে চলছে। তার মানে কোটি টাকার বিদ্যুৎ প্রতিদিনই চুরি হচ্ছে।

আইন কী বলে?- Electricity Act ২০১৮-এর কঠোর বিধান : দেশে বিদ্যুৎ চুরি, অবৈধ সংযোগ, মিটার বাইপাস, এবং অনুমতি ছাড়া বিদ্যুৎ ব্যবহার- সবই অপরাধ। Electricity Act, ২০১৮- তে এ বিষয়ে কঠোর দণ্ড নির্ধারিত রয়েছে।

ধারা ৩২ - বিদ্যুৎ চুরি। বিদ্যুৎ চুরি করলে- সর্বোচ্চ ৩ বছর কারাদণ্ড, অথবা চুরিকৃত বিদ্যুতের মূল্য দ্বিগুণ ক্ষতিপূরণ, অথবা ৫০,০০০ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড (ব্যবসায়িক কাজে হলে জরিমানা আরও বেশি)।

ধারা ৩৩-  কৃত্রিম উপায়ে সংযোগ / হুকিং / ট্যাপিং। অবৈধ সংযোগ বা মিটার বাইপাস করলে ৩ বছর কারাদণ্ড অথবা ৫ লক্ষ টাকার জরিমানা, অথবা উভয় দণ্ড। ধারা ৩৮- মিটার ট্যাম্পারিং, মিটার খুলে ফেলা, টেম্পার করা, পার্শ্ব সংযোগ ৩ বছর কারাদণ্ড, অথবা ৫ লক্ষ টাকা জরিমানা।

ধারা ৪৩- অপরাধে সহায়তা বা সহযোগিতা:

যদি বিদ্যুৎ বিভাগের কোনো কর্মচারী/কর্মকর্তা চাঁদা নেন বা অবৈধ সংযোগ দিতে সহযোগিতা করেন তিনিও “সহযোগী অপরাধী” হিসেবে একই শাস্তির মুখোমুখি হবেন। অর্থাৎ শুধু গ্যারেজ মালিক নয়, যিনি সংযোগ বজায় রাখেন তিনিও দোষী।

অবৈধ গ্যারেজ ও চার্জিং স্টেশনের বিরুদ্ধে করণীয় : 

আইন প্রয়োগে কঠোরতা করে অবৈধ সংযোগ শনাক্ত করে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। জরিমানাসহ ফৌজদারি মামলা করতে হবে। গ্যারেজের লাইন, তার, ব্যাটারি চার্জার বাজেয়াপ্ত করা। বিদ্যুৎ বিভাগের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। অভিযোগ পাওয়া মাত্র সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত । চাঁদা আদায়ের প্রমাণ পাওয়া গেলে সরাসরি সাসপেনশন ও মামলা করতে হবে। লাইসেন্সবিহীন চার্জিং পয়েন্ট তালিকাভুক্ত করে এদের বিরুদ্ধে আইনি এাকশন নিতে হবে। 

বৈধ চার্জিং স্টেশন স্থাপন- সরকারি অনুমোদিত চার্জিং স্টেশন দ্রুত বাড়াতে হবে। বাণিজ্যিক হারে মিটার সংযোগ দিতে হবে গ্যারেজগুলোতে। রিকশা চার্জিং যেন বাসাবাড়ির লাইনে নিষিদ্ধ হয়।

পাশের গ্যারেজে অবৈধ লোড ব্যবহৃত হলে ১৬১১৭ বা সংশ্লিষ্ট বিতরণ সংস্থায় অভিযোগ করতে হবে। লোডশেডিংয়ের মূল কারণ বুঝে সচেতন হতে হবে।

এই সমস্যা দীর্ঘদিন ধরে চলার পেছনে কারণ গুলি হল অবৈধ সুবিধাভোগীদের প্রভাব।  যারা অবৈধভাবে চার্জিং ব্যবসা করছে, তারা চাঁদা দিয়ে প্রভাবশালী মহলের সুরক্ষায় থাকে।বিদ্যুৎ বিভাগের কিছু কর্মচারীর যোগসাজশ মাসিক সুবিধা পেলে কেউই লাইন কাটতে যায় না। বৈধ চার্জিং কাঠামোর অভাব। নগরে সরকারি অনুমোদিত চার্জিং স্টেশন সীমিত। গ্যারেজ মালিকরা দাবি করেন, ‘লাইসেন্স নিতে গেলে ঝামেলা- অবৈধভাবে করাই সহজ।’

ব্যাটারি রিকশা নিয়ন্ত্রণে নীতিমালার ঘাটতি : 

দেশে ব্যাটারি রিকশা নিবন্ধন, ট্রাফিক নিয়ম, লাইসেন্স- কোনোটারই নির্দিষ্ট কাঠামো নেই। আইন আছে, বাস্তবায়ন নেই- 

দুর্ভোগের শিকার সাধারণ মানুষ। রাজধানীতে ব্যাটারি রিকশা চার্জিং গ্যারেজের অবৈধ বিদ্যুৎ ব্যবহারের সমস্যা এখন আর স্থানীয় সমস্যা নয়-এটি জাতীয় বিদ্যুৎ নিরাপত্তা ও শহুরে অবকাঠামোর ওপর সরাসরি হুমকি।

অবৈধ সংযোগের কারণে বিদ্যুতের বিপুল আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে, তেমনি লোডশেডিংয়ে ভোগান্তি  বাড়ছে, আবার বিদ্যুৎ বিভাগের ভেতরের দুর্নীতিও স্পষ্ট হচ্ছে।

আইন অত্যন্ত কঠোর হলেও প্রয়োগ দুর্বল। ফলে অপরাধীরা অপরাধ করে পার পেয়ে যাচ্ছে, আর ভোগান্তি  পোহাচ্ছেন সাধারণ মানুষ।

এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান একটাই-

কঠোর আইন প্রয়োগ, স্বচ্ছ প্রশাসন ও বৈধ চার্জিং স্টেশন গড়ে তোলা। নচেৎ রাজধানীর আড়ালে চলতে থাকা এই “অবৈধ পাওয়ার ব্যবসা” আরও বেড়ে যাবে- আর সেটির মূল্য দিতে হবে বৈধ গ্রাহকদেরই।

এনএ

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর