নেতাকর্মীদের বিরূপ মন্তব্য ও কুৎসা রটনার আইনগত ভিত্তি কী?
আইন ও আদালত ডেস্ক
প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:৫৬
দেশে রাজনৈতিক পরিবেশ দীর্ঘদিন ধরেই উত্তেজনা, দলাদলি, পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং প্রতিপক্ষকে তীর্যকভাবে আক্রমণ করার সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত। রাজনৈতিক বিতর্ক গণতন্ত্রের স্বাভাবিক অংশ হলেও, যখন তা ব্যক্তিগত আক্রমণ, মিথ্যা তথ্যপ্রচার, কুৎসা-রটনা বা মানহানিতে রূপ নেয়-তখন তা আইনগতভাবে অপরাধ এবং সামাজিকভাবে ক্ষতিকর। প্রশ্নটি হলো- এমন কর্মকাণ্ড আইনগতভাবে কি অন্যায়? এবং বাংলাদেশের বর্তমান আইনগত-রাজনৈতিক বাস্তবতা এই বিষয়কে কীভাবে বিবেচনা করে।
Penal Code, ১৮৬০ অনুযায়ী মানহানি (Defamation)- দেশের ফৌজদারি আইন (Penal Code ১৮৬০) এর ধারা ৪৯৯ মানহানির স্পষ্ট সংজ্ঞা দেয়। এ তে বলা হয়- কেউ যদি মুখে বলা, লেখা, মুদ্রিত, কিংবা ইঙ্গিত, ছবি বা অন্য দৃশ্যমান মাধ্যম ব্যবহার করে, কোনো ব্যক্তির সুনাম ক্ষতিগ্রস্ত করার উদ্দেশ্যে বা এমন মন্তব্য করে যা তার সুনামে ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি করে তাহলে এটি মানহানি হিসেবে গণ্য হবে। এটি নির্দেশ করে যে রাজনৈতিক বক্তৃতায়, টেলিভিশনের বিতর্কে, সংবাদমাধ্যমে বা সামাজিক মাধ্যমে- যেকোনো ধরনের অপবাদ, মিথ্যা অভিযোগ বা কুৎসা রটানো আইনের আওতায় অপরাধ।
শাস্তি (Penal Code ৫০০ ধারা) মানহানি প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ ২ বছর কারাদণ্ড, জরিমানা, অথবা উভয়দণ্ড হতে পারে।
মানহানির ব্যতিক্রম : ধারা ৪৯৯-এ কয়েকটি ব্যতিক্রমও উল্লেখ আছে যেমন, জনস্বার্থে সৎ উদ্দেশ্যে মন্তব্য, সঠিক তথ্যভিত্তিক সমালোচনা, সরকারি কর্মচারীর কার্যক্রমের সদুদ্দেশ্যমূলক সমালোচনা ইত্যাদি। তবে এগুলো প্রমাণের দায়িত্ব অভিযুক্ত ব্যক্তির ওপর পড়ে।
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে কুৎসা-রটনা: আইন আরও কঠোর। বাংলাদেশে সামাজিক মাধ্যম রাজনৈতিক প্রচার, বিরোধিতা ও সমালোচনার অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। ফলে অনলাইনে কুৎসা-রটনা নিয়ন্ত্রণে অতিরিক্ত আইন প্রযোজ্য।
ICT Act ২০০৬ (ধারা ৫৭): অতীতের বিতর্ক- এক সময় অনলাইন মানহানির বিরুদ্ধে ওঈঞ অপঃ–এর ধারা ৫৭ ব্যবহৃত হত। এটি “অসত্য, মানহানিকর বা রাষ্ট্রদ্রোহী” কনটেন্ট প্রকাশকে অপরাধ বলত। এটি ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে- কারণ এর সংজ্ঞা ছিল অস্পষ্ট এবং রাজনৈতিক হয়রানির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
Digital Security Act (DSA) ২০১৮: অনলাইনে মানহানি- ২০১৮ সালে উঝঅ প্রণয়ন হলে এর ধারা ২৯-এ অনলাইনে মানহানির অপরাধ রাখা হয়। এর শাস্তি ছিল সর্বোচ্চ ৩ বছর কারাদণ্ড, জরিমানা, অথবা উভয়ই। পুনরায় অপরাধে শাস্তি আরও বাড়ত। এই আইনও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিক ও নাগরিকদের বিরুদ্ধে বহুল ব্যবহৃত হয়- যা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করে।
Cyber Security Act (CSA) ২০২৩: সংশোধিত আইন : ২০২৩ সালে সরকার উঝঅ সংশোধন করে Cyber Security Act প্রণয়ন করে। এতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হলো- মানহানির জন্য কারাদণ্ড বাদ, জরিমানাই প্রধান শাস্তি (সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা) জরিমানা দিতে না পারলে ৩-৬ মাস কারাদণ্ড হতে পারে। অর্থাৎ অনলাইনে কুৎসা-রটনা এখনো অপরাধ, তবে শাস্তি তুলনামূলক কম কঠোর।
রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের বক্তব্য কেন আইনত অপরাধের পর্যায়ে পড়তে পারে? : বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতারা নিয়মিত প্রতিপক্ষকে অভিযুক্ত করেন। যেমন: দুর্নীতি, রাষ্ট্রবিরোধী কাজ, সন্ত্রাস, দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র, ব্যক্তিগত চরিত্রহানিকর মন্তব্য ইত্যাদি। তবে যখন মন্তব্য মিথ্যা হয়, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়, প্রমাণহীন হয়, ব্যক্তিগত জীবনে আঘাত করে, প্রতারণা বা বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা থাকে, বক্তব্যের ফলে ব্যক্তির সামাজিক বা রাজনৈতিক ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তখন তা স্পষ্টভাবে মানহানি। উদাহরণ হিসেবে কোনো রাজনৈতিক নেতা প্রতিপক্ষকে “দেশদ্রোহী” বললে প্রমাণ ছাড়া “চোর, ডাকাত, দুর্নীতিবাজ” বলা, ব্যক্তির পারিবারিক বা ব্যক্তিগত জীবনের অপপ্রচার, সামাজিক মাধ্যমে কুরুচিপূর্ণ ট্রল বা ভুয়া ছবি ছড়ানো ইত্যাদি Penal Code I Cyber Security Act- দুটিই লঙ্ঘন করতে পারে। দেশে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মানহানির আইন থাকলেও এর বাস্তব প্রয়োগ জটিল। আইনের প্রয়োগে পক্ষপাতের অভিযোগ। প্রায়শই দেখা যায় ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলাগুলো কম এগোয়, বিরোধী দলের সদস্যরা বেশি মামলার সম্মুখীন হয়, অনেক মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে করা হয়, প্রকৃত ভুক্তভোগী ন্যায়বিচার পেতে দেরি করেন। ফলে আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। আইন অনেক সময় এমনভাবেই ব্যবহৃত হয়, যেখানে সমালোচনা ও অপমানের মধ্যে সীমারেখা অস্পষ্ট, রাজনৈতিক প্রতিবাদও “মানহানি” হিসেবে মামলা হয়, সাংবাদিকরা তদন্ত করতে ভয় পান, সাধারণ ব্যবহারকারীরা সামাজিক মাধ্যমে নিজেদের মত দেওয়ায় আতঙ্কে থাকেন।এতে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার চর্চার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়।
সামাজিক মাধ্যম: কুৎসা-রটনার প্রধান ক্ষেত্র- রাজনৈতিক তর্ক ও প্রচার এখন সবচেয়ে বেশি হয় ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার. টিকটক, অনলাইন নিউজ পোর্টাল, ব¬গ। এখানে ফেক আইডি, বিভ্রান্তিকর পোস্ট, ভাইরাল ভিডিও- রাজনৈতিক কুৎসা ছড়ানোর নতুন হাতিয়ার। আইন অনুযায়ী, অনলাইনে ভুল তথ্য, ইচ্ছাকৃত অপপ্রচার, ভুয়া ছবি/ভিডিও, ব্যক্তিকে হেয় করা সবই দণ্ডনীয়।
সংবিধান প্রত্যেক নাগরিককে মতপ্রকাশের অধিকার দিয়েছে কিন্তু সেই স্বাধীনতার অপব্যবহার করে কুৎসা-রটনা, মিথ্যা তথ্য, অপবাদ বা মানহানি করার অধিকার দেয়নি। দেশে রাজনৈতিক আলোচনার মাত্রা উন্নত করতে এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি সবল করতে এই বিষয়ে অধিক সচেতনতা ও আইনের ন্যায়সঙ্গত প্রয়োগ অপরিহার্য।
বিকেপি/এমবি

