জেলখানায় ডিভিশন প্রথা : আইন, বাস্তবতা ও সংস্কারের প্রশ্ন
মাসুম আহম্মেদ
প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:১৫
দেশের কারাগার ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরেই নানা কাঠামোগত সংকট, মানবাধিকার প্রশ্ন এবং প্রশাসনিক বৈষম্যের অভিযোগে আলোচিত। এর মধ্যে সবচেয়ে বিতর্কিত ও সংবেদনশীল একটি বিষয় হলো জেলখানায় কয়েদি ও সাজাপ্রাপ্তদের তথাকথিত “ডিভিশন” ব্যবস্থা। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া এই ডিভিশন প্রথা আজও আমাদের কারাগার ব্যবস্থায় নানা রূপে বিদ্যমান, যদিও সংবিধান, আদালতের রায় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ড এ ব্যবস্থার মৌলিক দর্শনের সঙ্গে ক্রমশ সাংঘর্ষিক হয়ে উঠছে।
আমাদের দেশের কারাগার ব্যবস্থার আইনগত ভিত্তি মূলত প্রিজনস অ্যাক্ট, ১৮৯৪ এবং এর আলোকে প্রণীত বাংলাদেশ জেল কোড। ব্রিটিশ আমলে এই আইন ও বিধিমালার উদ্দেশ্য ছিল শাসক শ্রেণি ও তথাকথিত “ভদ্র শ্রেণির” বন্দিদের সাধারণ অপরাধীদের থেকে আলাদা সুবিধা দেওয়া। সে সময় শিক্ষাগত যোগ্যতা, সামাজিক মর্যাদা ও পেশার ভিত্তিতে বন্দিদের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ডিভিশনে ভাগ করা হতো।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও কারাগারের এই শ্রেণিভিত্তিক কাঠামো পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়নি। বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা রূপ বদলে আজও নানা বিতর্কের জন্ম দিচ্ছে।
আইনগতভাবে কারাগারে বন্দিরা মূলত দুই শ্রেণিতে বিভক্ত- ১. আন্ডার ট্রায়াল বা বিচারাধীন বন্দি (রিমান্ড বা মামলার নিষ্পত্তির অপেক্ষায় থাকা), ২. সাজাপ্রাপ্ত বন্দি।
জেল কোড অনুযায়ী, বিচারাধীন বন্দিদের দোষী সাব্যস্ত করা যায় না এবং তাদের নির্দোষ হিসেবে বিবেচনার নীতিই প্রযোজ্য। অথচ বাস্তবে দেখা যায়, অনেক ক্ষেত্রে বিচারাধীন বন্দিরা সাজাপ্রাপ্তদের মতোই কঠোর ও মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হন।
সাজাপ্রাপ্ত বন্দিদের ক্ষেত্রেও ডিভিশনের প্রশ্ন আসে। ঐতিহাসিকভাবে প্রথম ডিভিশনের বন্দিরা আলাদা কক্ষ, উন্নত খাবার, বিছানা, পত্র-পত্রিকা, বই পড়ার সুযোগসহ নানা সুবিধা পেয়ে থাকেন। বিপরীতে সাধারণ বন্দিরা অতিরিক্ত ভিড়, অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে দিন কাটান।
সংবিধান ও মানবাধিকারের আলোকে ডিভিশন : বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, “আইনের দৃষ্টিতে সকল নাগরিক সমান।” একই সঙ্গে ৩১ ও ৩২ অনুচ্ছেদে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। এই সাংবিধানিক নিশ্চয়তার সঙ্গে কারাগারের ডিভিশন প্রথার মৌলিক ধারণা স্পষ্টতই সাংঘর্ষিক।
এছাড়া বাংলাদেশ যেসব আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদের পক্ষভুক্ত- বিশেষ করে আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সনদ (ওঈঈচজ)- সেখানে বন্দিদের সঙ্গে মানবিক আচরণ ও বৈষম্যহীন ব্যবস্থার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘের নেলসন ম্যান্ডেলা রুলস-এও স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, বন্দিদের ব্যবস্থাপনায় সামাজিক বা অর্থনৈতিক অবস্থানের ভিত্তিতে বিশেষ সুবিধা দেওয়া অনুচিত।
আদালতের ভূমিকা ও সাম্প্রতিক দৃষ্টিভঙ্গি :
বাংলাদেশের উচ্চ আদালত বিভিন্ন সময়ে জেলখানায় ডিভিশন প্রথা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। আদালত একাধিক রায়ে বলেছেন, কেবলমাত্র সামাজিক মর্যাদা বা পেশার কারণে কোনো বন্দিকে আলাদা সুবিধা দেওয়া সংবিধানসম্মত নয়। বিশেষ পরিস্থিতিতে যেমন নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য বা শারীরিক অক্ষমতার কারণে- ভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে, তবে তা “ডিভিশন” হিসেবে নয়, বরং মানবিক ও প্রশাসনিক প্রয়োজনে।
এই বিচারিক দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট করে দেয় যে ডিভিশন প্রথা তার প্রচলিত অর্থে আর গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো- বাস্তবে তা কতটা কার্যকর হচ্ছে?
বাস্তবতা- আইন একদিকে, চর্চা আরেকদিকে :
বাস্তব চিত্র ভিন্ন। রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বা প্রভাবশালী আসামিদের ক্ষেত্রে এখনো বিশেষ সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ নিয়মিত শোনা যায়। কখনো “বিশেষ শ্রেণি”, কখনো “ভিআইপি বন্দি” কিংবা কখনো “নিরাপত্তাজনিত ব্যবস্থা”- নাম বদলালেও মূল বৈষম্য থেকেই যায়।
অন্যদিকে সাধারণ বন্দিরা চরম ভিড়ের মধ্যে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। দেশের কারাগারগুলোতে ধারণক্ষমতার তুলনায় অনেক বেশি বন্দি থাকার ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকি, মানসিক চাপ এবং পুনর্বাসনের সুযোগ প্রায় অনুপস্থিত। কারাগার কোনো প্রতিশোধের জায়গা নয়; এটি হওয়া উচিত সংশোধন ও পুনর্বাসনের স্থান। সে লক্ষ্য অর্জনে ডিভিশন প্রথার আমূল সংস্কার জরুরি। প্রথমত, জেল কোড ও সংশ্লিষ্ট আইনসমূহকে আধুনিক ও মানবাধিকারসম্মত করতে হবে। ঔপনিবেশিক মানসিকতা থেকে বেরিয়ে এসে সমতার ভিত্তিতে বন্দি ব্যবস্থাপনার নীতি গ্রহণ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, বিচারাধীন বন্দিদের জন্য পৃথক ও মানবিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা সাজাপ্রাপ্তদের মতো আচরণের শিকার না হন। তৃতীয়ত, স্বাস্থ্য, বয়স বা বিশেষ চাহিদার ভিত্তিতে যে আলাদা ব্যবস্থা প্রয়োজন, তা স্বচ্ছ নীতিমালার আওতায় আনতে হবে, যাতে কোনো অপব্যবহার না হয়।
জেলখানায় ডিভিশন প্রথা মূলত একটি শ্রেণিভিত্তিক ও বৈষম্যমূলক ধারণা, যা স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আইন, সংবিধান ও মানবাধিকার মানদণ্ডের আলোকে এই ব্যবস্থার পুনর্মূল্যায়ন এখন সময়ের দাবি। কারাগার ব্যবস্থার সংস্কার শুধু বন্দিদের অধিকার রক্ষার প্রশ্ন নয়; এটি একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের অপরিহার্য শর্ত। রাষ্ট্র যদি সত্যিই আইনের শাসন ও সমতার নীতিতে বিশ্বাসী হয়, তবে জেলখানার দেয়ালের ভেতরেও সেই নীতির প্রতিফলন ঘটাতে হবে। অন্যথায়, ডিভিশনের নামে বৈষম্য আমাদের বিচারব্যবস্থার নৈতিক ভিত্তিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলবে।
বিকেপি/এমবি

