Logo

আইন ও বিচার

শান্তি রক্ষার আইন : ফৌজদারি কার্যবিধির ১০৭ ধারা কতটা কার্যকর?

Icon

আইন ও আদালত ডেস্ক

প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:২১

শান্তি রক্ষার আইন : ফৌজদারি কার্যবিধির ১০৭ ধারা কতটা কার্যকর?

সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। কিন্তু বাস্তবতা হলো-ব্যক্তিগত বিরোধ, জমি সংক্রান্ত দ্ব›দ্ব, পারিবারিক কলহ কিংবা রাজনৈতিক উত্তেজনাকে কেন্দ্র করে প্রায়ই সমাজে সহিংস পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এসব সংঘাত অনেক সময় বড় ধরনের অপরাধে রূপ নেওয়ার আগেই প্রশাসনের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এ প্রেক্ষাপটে ফৌজদারি কার্যবিধির ১০৭ ধারা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরোধমূলক আইন হিসেবে কাজ করে আসছে।

ফৌজদারি কার্যবিধির ১০৭ ধারা কোনো অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর শাস্তি দেওয়ার বিধান নয়। বরং ভবিষ্যতে শান্তি ভঙ্গ বা জনশৃঙ্খলা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা থাকলে আগাম ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ দেয় এই আইন। আইনটি মূলত সমাজে উত্তেজনা প্রশমিত করা এবং সহিংসতা প্রতিরোধের উদ্দেশ্যেই প্রণীত। ফলে এটি নাগরিকের স্বাধীনতা ও সামাজিক নিরাপত্তার মধ্যে একটি সূ² ভারসাম্য রক্ষা করে।

এই ধারার আওতায় যে কেউ ভুক্তভোগী ব্যক্তি, স্থানীয় বাসিন্দা কিংবা পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেটের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন। অভিযোগ পাওয়ার পর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন এবং প্রয়োজনে শান্তি বজায় রাখার মুচলেকা প্রদানের নির্দেশ দেন। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অভিযুক্ত ব্যক্তি শান্তি রক্ষার প্রতিশ্রæতি দিলে এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে মামলাটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিষ্পত্তি হয়ে যায়।

১০৭ ধারার সবচেয়ে বড় ইতিবাচক দিক হলো-এটি সংঘাতের আগেই হস্তক্ষেপের সুযোগ দেয়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা চরমে পৌঁছানোর আগেই ম্যাজিস্ট্রেটের সতর্কতা এবং আইনি বাধ্যবাধকতা পরিস্থিতি শান্ত করতে সহায়ক হয়। এতে প্রাণহানি, সম্পদের ক্ষতি ও দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক বিরোধ এড়ানো সম্ভব হয়।

তবে এই ধারার প্রয়োগ নিয়ে বিতর্কও কম নয়। অভিযোগ রয়েছে, কখনো কখনো ১০৭ ধারা হয়রানির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বিশেষ করে প্রভাবশালী মহলের চাপে কিংবা ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা থেকে কাউকে অযথা এই ধারায় জড়ানো হয় বলে অভিযোগ ওঠে। যেহেতু এটি শাস্তিমূলক মামলা নয়, তবুও অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আদালতে হাজিরা, মুচলেকা প্রদান এবং সামাজিক চাপের মুখে পড়তে হয়, যা নাগরিক অধিকার প্রশ্নে উদ্বেগ সৃষ্টি করে।

এখানে প্রশাসনের দায়িত্ব আরও সংবেদনশীল হয়ে ওঠে। ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশকে নিশ্চিত করতে হবে, যেন ১০৭ ধারার প্রয়োগ যথাযথ তদন্ত ও যুক্তিসংগত আশঙ্কার ভিত্তিতে হয়। কেবল অনুমান বা পক্ষপাতমূলক প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে কাউকে আইনি প্রক্রিয়ায় জড়ানো হলে আইনটির মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হয়।

আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, ১০৭ ধারাকে কার্যকর ও জনবান্ধব করতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়ানো জরুরি। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে তার অবস্থান ব্যাখ্যার যথাযথ সুযোগ দেওয়া এবং দ্রুত নিষ্পত্তির মাধ্যমে হয়রানি কমানো প্রয়োজন। পাশাপাশি নাগরিকদের মধ্যেও এই আইন সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে, যাতে মানুষ এটিকে শাস্তির ভয় নয়, বরং শান্তি রক্ষার একটি উপায় হিসেবে দেখতে পারে।

একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে, সমাজে ক্রমবর্ধমান সহিংসতা ও অসহিষ্ণুতার প্রেক্ষাপটে ১০৭ ধারা পুরোপুরি অকার্যকর নয়; বরং এটি সঠিকভাবে প্রয়োগ হলে একটি শক্তিশালী প্রতিরোধমূলক হাতিয়ার হতে পারে। প্রশাসনের সতর্কতা, বিচার বিভাগের দায়িত্বশীলতা এবং নাগরিক সচেতনতার সমন্বয়েই কেবল এই আইনের যথার্থ ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব।

পরিশেষে বলা যায়, ফৌজদারি কার্যবিধির ১০৭ ধারা সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষার একটি প্রয়োজনীয় আইন। তবে এর প্রয়োগে মানবিকতা, ন্যায়বিচার ও আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা বজায় রাখা আবশ্যক। শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে যেন কোনো নাগরিকের অধিকার ক্ষুণ্ন না হয়-এটাই হওয়া উচিত এই আইনের সর্বোচ্চ লক্ষ্য।

বিকেপি/এমবি 

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

আইন ও আদালত

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর