Logo

আইন ও বিচার

আত্মরক্ষার নামে বাসা-বাড়ি প্রতিষ্ঠানে দেশীয় অস্ত্র রাখা বেআইনি প্রবণতা!

Icon

মাসুম আহম্মেদ

প্রকাশ: ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:১৮

আত্মরক্ষার নামে বাসা-বাড়ি প্রতিষ্ঠানে দেশীয় অস্ত্র রাখা বেআইনি প্রবণতা!

দেশীয় অস্ত্র

অপরাধের ভয়, অনিরাপত্তার অনুভূতি এবং সামাজিক অস্থিরতার বাস্তবতা- সব মিলিয়ে আজ অনেক নাগরিকই নিজের বাড়ি বা প্রতিষ্ঠানকে `নিরাপদ দুর্গে' পরিণত করতে চাইছেন। এই চাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো, আত্মরক্ষার নামে অনেকেই আইনকে পাশ কাটিয়ে অস্ত্র বা অস্ত্রসাদৃশ বস্তু ঘরে রাখার প্রবণতার দিকে ঝুঁকছেন। প্রশ্ন উঠছে- বাংলাদেশের আইন কি তা সমর্থন করে? উত্তরটি স্পষ্ট এবং দ্ব্যর্থহীন : ‘না’।

দেশে অস্ত্র বিষয়ক আইন অত্যন্ত কঠোর এবং সুস্পষ্ট। আত্মরক্ষার যুক্তি দেখিয়ে আইন ভাঙার কোনো সুযোগ নেই। বরং অস্ত্র রাখার নামে বেআইনি প্রবণতা সমাজকে নিরাপদ না করে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে- এ সত্য আমাদের স্বীকার করতেই হবে।

বাংলাদেশে অস্ত্র সংক্রান্ত মূল আইনটি প্রণীত হয়েছে ঔপনিবেশিক আমলে- ১৮৭৮ সালের অস্ত্র আইন। সময় বদলালেও এই আইনের মূল দর্শন আজও প্রাসঙ্গিক : রাষ্ট্রের অনুমতি ছাড়া কোনো ব্যক্তি অস্ত্র রাখবে না। আগ্নেয়াস্ত্র তো বটেই, অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে- এমন যেকোনো সামগ্রীই আইনের আওতাভুক্ত।

এখানেই একটি বড় ভুল ধারণা কাজ করে। অনেকেই মনে করেন, দেশীয় বা ঘরে তৈরি অস্ত্র- যেমন লাঠি, দা, ছুরি, শাবল, বল্লম, তলোয়ার- এসব যেহেতু ঐতিহ্যগত বা দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত, তাই এগুলো আইনগতভাবে নিষিদ্ধ নয়। বাস্তবে আইন এই সরল বিভাজন মানে না। বস্তুর চেয়ে উদ্দেশ্য ও ব্যবহারই এখানে মুখ্য।

রান্নাঘরের ছুরি, কৃষিকাজের দা বা গৃহস্থালির লাঠি- এসব সাধারণভাবে অপরাধ নয়। কিন্তু যখন এগুলোকে ইচ্ছাকৃতভাবে ‘আত্মরক্ষার অস্ত্র’ হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়, কিংবা বাড়ির বাইরে বহন করা হয়, তখনই আইন প্রশ্ন তোলে। পরিস্থিতি, বহনের ধরন এবং উদ্দেশ্য সন্দেহজনক হলে সেই সাধারণ বস্তুই হয়ে ওঠে অপরাধের আলামত। এই বাস্তবতাটি অনেকেই এড়িয়ে যেতে চান। অথচ আদালত ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বারবার স্পষ্ট করেছে- আত্মরক্ষার অজুহাতে অস্ত্র মজুতের কোনো আইনগত বৈধতা নেই।

লাইসেন্স ছাড়া অস্ত্র : শূন্য সহনশীলতা

আইন এখানে একচুলও নরম নয়। আগ্নেয়াস্ত্র, বৈদ্যুতিক শক ডিভাইস, টেজার বা এ ধরনের যেকোনো অস্ত্র লাইসেন্স ছাড়া রাখা বা বহন করা সরাসরি অপরাধ। এমনকি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কারখানা বা অফিসের নিরাপত্তার অজুহাতও এখানে গ্রহণযোগ্য নয়।

লাইসেন্সের বিষয়টি অনেকেই সহজভাবে নেন। বাস্তবে অস্ত্রের লাইসেন্স পাওয়া অত্যন্ত কঠিন, সীমিত এবং কঠোর যাচাইয়ের মাধ্যমে প্রদান করা হয়। এটি কোনো সাধারণ নাগরিক সুবিধা নয়, বরং ব্যতিক্রমী পরিস্থিতির জন্য নির্ধারিত একটি নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা।

আত্মরক্ষার অধিকার: আছে, কিন্তু সীমাহীন নয়

বাংলাদেশের দণ্ডবিধি নাগরিকের আত্মরক্ষার অধিকার স্বীকার করে- এটি গুরুত্বপূর্ণ। তবে এই অধিকারকে অনেকেই ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেন। আত্মরক্ষা মানে প্রতিশোধ নয়, আগাম প্রস্তুতি নয়, কিংবা অস্ত্র মজুত নয়। আত্মরক্ষা মানে হলো-তাৎক্ষণিক ও অনিবার্য আক্রমণ থেকে নিজেকে বাঁচানোর প্রয়োজনীয় প্রতিরোধ।

আইন এখানে একটি স্পষ্ট সীমারেখা টেনে দেয়। প্রতিরোধ হতে হবে যুক্তিসঙ্গত, প্রয়োজনীয় এবং পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ বা আক্রমণাত্মক আচরণ আত্মরক্ষার অধিকারকে বাতিল করে দেয় এবং সেটি অপরাধে পরিণত হয়।

অস্ত্রায়ন কি সত্যিই নিরাপত্তা আনে? : 

সমাজে একটি বিপজ্জনক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে- নিরাপত্তার সমাধান হিসেবে অস্ত্রকে ভাবা। বাস্তব অভিজ্ঞতা বলে, ব্যক্তিগত অস্ত্রায়ন নিরাপত্তা বাড়ায় না; বরং সহিংসতার ঝুঁকি বাড়ায়। ঘরে অস্ত্র থাকলে দুর্ঘটনা, ভুল ব্যবহার বা হঠাৎ উত্তেজনায় মারাত্মক পরিণতির আশঙ্কা বহুগুণ বেড়ে যায়। বিশেষ করে পরিবারে শিশু, কিশোর বা মানসিকভাবে দুর্বল সদস্য থাকলে অস্ত্র ঘরে রাখা নিঃসন্দেহে ঝুঁকিপূর্ণ। সমাজকে নিরাপদ করতে হলে অস্ত্র নয়, দরকার শৃঙ্খলা, আইন প্রয়োগ ও সামাজিক সচেতনতা।

প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা: অস্ত্র নয়, ব্যবস্থাপনাই সমাধান : 

ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা অফিসের নিরাপত্তার প্রশ্নে অস্ত্র নয়- আইনসম্মত ব্যবস্থাপনাই কার্যকর পথ। প্রশিক্ষিত নিরাপত্তাকর্মী, সিসিটিভি, প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ, পর্যাপ্ত আলো এবং স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয়- এসবই প্রমাণিত ও নিরাপদ সমাধান।

আইনের বাইরে গিয়ে কোনো প্রতিষ্ঠান অস্ত্রের পথ বেছে নিলে তা শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানের জন্যই আইনি ঝুঁকি ও সুনামহানির কারণ হয়।

The Arms Act, ১৮৭৮ অনুসারে, কোনও ব্যক্তি লাইসেন্স ছাড়া আগ্নেয়াস্ত্র বা অস্ত্র, বোঝাই যাক সেটা দেশীয় হোক বা তৈরি করা, তা রাখা, বহন বা ইজারা রাখা যোগ্য নয়। লাইসেন্স ছাড়া অস্ত্র রাখা অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। 

অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র রাখা বা কোনো অস্ত্র নিজ হাতে তৈরি করেও তা রাখলে তা বেআইনিভাবে রাখা হবে। লাইসেন্স ছাড়া নিজ বাড়িতে অস্ত্র রাখা আইনত অপরাধ এবং এর শাস্তি হিসেবে দীর্ঘ সময়ের কারাদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। 

আইন অনুযায়ী ব্যক্তির কাছে আত্মরক্ষার অধিকার থাকলেও (যেমন নিজেকে বা অপরের জীবন রক্ষার জন্য অবশ্যই সীমাবদ্ধ পরিস্থিতিতে প্রতিরোধ করা যায়), কোনো ধরনের অস্ত্র রাখার জন্য আলাদা লাইসেন্স নিতে হয়। লাইসেন্স ছাড়া অস্ত্র রাখা বা ব্যবহার করা হচ্ছে বলে আইন ভঙ্গ হয়।

দেশীয় অস্ত্র বা তৈরিকৃত ডিভাইস (homemade weapon) : 

আইনটি আগ্নেয়াস্ত্রের ধরণ খুব বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করে (অস্ত্রধারী যন্ত্র, গুপ্তাগ্নি করে ব্যবহৃত যন্ত্র ইত্যাদি)। তাই নিজের তৈরি অস্থায়ী বা দেশীয় অস্ত্র/ডিভাইস-  যেমন তোলা ছোট বন্দুক, ট্রাপ গান, ইত্যাদি থাকলে তা আগ্নেয়াস্ত্রের শ্রেণীতে পড়ে এবং অবৈধ বিবেচিত হয় যদি লাইসেন্স না থাকে। আত্মরক্ষার জন্য কেনা বা ব্যবহার করতে হলে সরকারি লাইসেন্স নিতে হবে। 

লাইসেন্সপ্রাপ্ত অবস্থা ছাড়া অস্ত্র নিরাপত্তা গ্যাজেট বা জারি অনুমোদিত ডিভাইস (যেমন পিপার স্প্রে, লাইট, সাইরেন ইত্যাদি) রাখলে এবং সেগুলি ব্যবহারের নিয়ম মেনে চললে আইনের উর্ধ্বে থাকা যায় (কিছু আইনী সীমা সাপেক্ষে)- যদিও আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স ছাড়া নেতৃত্বাধীন কিছু ডিভাইসও আইনত অনুমোদিত নয়।

নিরাপত্তা মানুষের মৌলিক চাহিদা- এ নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পথ যদি আইন ভাঙার মধ্য দিয়ে যায়, তবে সেই নিরাপত্তা টেকসই হয় না। আত্মরক্ষার নামে অস্ত্র মজুত সমাজকে আরও অস্থির করে তোলে, আইনের শাসনকে দুর্বল করে এবং সাধারণ নাগরিককে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়। 

আত্মরক্ষা নয়, আইনই শেষ কথা।

অস্ত্র নয়- আইন, সচেতনতা ও দায়িত্বশীল আচরণই হোক আমাদের নিরাপত্তার মূল ভিত্তি। এ আহ্বান কেবল সতর্কবার্তা নয়, বরং একটি সামাজিক দায়িত্বের স্মরণ করিয়ে দেওয়া।

বিকেপি/এনএ

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

আইনি প্রশ্ন ও উত্তর আইন ও আদালত

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর