মরণোত্তর চক্ষু ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দান
বাংলাদেশের আইন ও সামাজিক বাস্তবতা
আইন ও আদালত ডেস্ক
প্রকাশ: ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:৩২
চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে আজ মানুষের মৃত্যুও অন্যের জীবনে আলো জ্বালাতে পারে। মরণোত্তর চক্ষু কিংবা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দান এমন এক মানবিক উদ্যোগ, যা একজন মৃত ব্যক্তিকেও বহু মানুষের আশার প্রতীকে পরিণত করে। তবে বাংলাদেশে এ বিষয়ে আগ্রহ বাড়লেও আইনগত কাঠামো ও সামাজিক সচেতনতার অভাব এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশে মরণোত্তর অঙ্গ ও চক্ষু দানের মূল আইন হলো ‘মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন আইন, ১৯৯৯’, যা পরবর্তীতে ২০১৮ সালে সংশোধিত হয়। এই আইন অনুযায়ী, নির্দিষ্ট শর্ত সাপেক্ষে জীবিত বা মৃত ব্যক্তির দেহ থেকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও চক্ষু সংগ্রহ এবং প্রতিস্থাপন বৈধ।
আইনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি জীবদ্দশায় লিখিতভাবে সম্মতি দিলে তাঁর মৃত্যুর পর চক্ষু বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দান করা যেতে পারে। এমনকি ব্যক্তি জীবিত অবস্থায় সম্মতি না দিলেও, তাঁর মৃত্যুর পর নিকটাত্মীয়দের সম্মতির ভিত্তিতে চক্ষু বা নির্দিষ্ট অঙ্গ সংগ্রহ করা সম্ভব। তবে এই প্রক্রিয়া অবশ্যই সরকার অনুমোদিত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান ও নিবন্ধিত চিকিৎসকের মাধ্যমে সম্পন্ন হতে হবে।
এ আইনে অঙ্গ বাণিজ্যকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কোনো ধরনের অর্থনৈতিক লেনদেন, দালালি বা জোরপূর্বক অঙ্গ সংগ্রহ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অপরাধ প্রমাণিত হলে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড- উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এর মাধ্যমে আইনপ্রণেতারা একটি মানবিক উদ্যোগকে বাণিজ্যিক শোষণ থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন।
বিশেষ করে চক্ষু দান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কর্নিয়া প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে হাজারো অন্ধ মানুষ নতুন করে দেখার সুযোগ পেতে পারে। অথচ দেশে কর্নিয়া দাতার সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত কম। সামাজিক কুসংস্কার, ধর্মীয় ভুল ধারণা এবং আইন সম্পর্কে অজ্ঞতাই এর প্রধান কারণ।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও অঙ্গ ও চক্ষু দান নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। অথচ দেশের প্রধান ধর্মগুলোর বিশিষ্ট আলেম ও ধর্মীয় চিন্তাবিদরা বারবার বলেছেন- মানবকল্যাণে অঙ্গ দান নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য। আইনও কোনো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত না দিয়ে মানবিকতার ভিত্তিতেই এ বিধান প্রণয়ন করেছে।
তবে বাস্তবতা হলো, আইন থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগ ও জনসচেতনতা এখনো সীমিত। হাসপাতালগুলোতে অঙ্গ সংগ্রহ ও সংরক্ষণের অবকাঠামো দুর্বল, প্রশিক্ষিত জনবল কম, আর সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয় ও ভুল ধারণা প্রবল। ফলে সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও মরণোত্তর অঙ্গ ও চক্ষু দান কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় এগোচ্ছে না।
এ অবস্থায় প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ। গণমাধ্যমে নিয়মিত প্রচার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সচেতনতামূলক আলোচনা, ধর্মীয় নেতাদের ইতিবাচক ভূমিকা এবং হাসপাতাল ব্যবস্থার আধুনিকায়ন- সবকিছু একসঙ্গে এগোতে হবে। পাশাপাশি আইন বাস্তবায়নে কঠোর নজরদারি নিশ্চিত করতে হবে, যাতে অঙ্গ বাণিজ্যের মতো অমানবিক অপরাধ মাথাচাড়া দিতে না পারে।
মরণোত্তর চক্ষু ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দান কেবল একটি আইনগত বিষয় নয়; এটি মানবতার এক উচ্চতম প্রকাশ। একটি মৃত্যুই পারে বহু জীবনকে নতুন সম্ভাবনা দিতে। আইন সেই সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে- এখন দায়িত্ব আমাদের সামাজিক ও নৈতিক বোধের।

