প্রাইভেসির অতিরিক্ত খোঁচা : রাস্তাঘাটে মোবাইল চেকিং সুরক্ষা, না হয়রানি
মাসুম আহম্মেদ
প্রকাশ: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:৫৬
রাজধানী ঢাকার প্রবেশপথ থেকে শুরু করে বিভিন্ন চেকপোস্ট পর্যন্ত নিত্যদিনের জীবনযাত্রা যেন দাঁড়িয়েছে পুলিশের নামে "মোবাইল চেকিং"-এর বালাই নিয়ে। রাস্তাঘাটে থামিয়ে পথচারীদের মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেবে, গ্যালারি, কললিস্ট, মেসেজখানা দেখবে- এমন চিত্র এখন কমন দৃশ্য। এটা কি নাগরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে, নাকি জনজীবনের মৌলিক অধিকারকে হেনস্তা করছে? আর আইনের ক্ষমতায় কতটুকু এই কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ?
আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দেখা যায়, বাংলাদেশে মোবাইল ফোনে কোনো তল্লাশি বা ডাটা দেখা-শোনা করার জন্য পুলিশের কাছে কাছে স্পষ্ট কোনো অনুমোদিত ক্ষমতা নেই, যদি না সেটি নির্দিষ্ট অভিযুক্তের ওপর বৈধ অনুসন্ধান। তদন্তের অংশ হিসেবে এবং যুক্তিসংগত সন্দেহ বা আদালতের আদেশে করা হয়। সাধারণ মানুষকে রাস্তায় থামিয়ে মোবাইল ফর্মালভাবে খোলা, তাদের ব্যক্তিগত তথ্য দেখা বা পড়া, আইনগতভাবে অনুমোদিত নয়। এমন কার্যকলাপ নাগরিকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও যোগাযোগের অধিকারকে ক্ষতিগ্রস্থ করে এবং তা সংবিধানের মৌলিক হকগুলোর বিরুদ্ধেও- যেখানে প্রত্যেক নাগরিকের ব্যক্তিগত জীবন এবং যোগাযোগের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার স্পষ্টভাবে রাখা হয়েছে।
আইনি বিশ্লেষকরা উল্লেখ করেন, শুধুমাত্র "যুক্তিসংগত সন্দেহ" (reasonable suspicion) বা কার্যকর অনুসন্ধানের প্রেক্ষাপটে পুলিশ কোনো ব্যক্তির মালিকানাধীন ডিভাইস-এ তল্লাশি করতে পারে, এবং তা সাধারণ নাগরিকের চলাচলের স্বাধীনতা বা পথেই করা উচিত নয়। আর হাইকোর্টের নির্দেশনায়ও সরাসরি বা অহেতুক মোবাইল হস্তক্ষেপে সীমাবদ্ধতা আরোপিত হয়েছে। তবুও সাম্প্রতিক ঢাকার প্রবেশপথে ও ব্যস্ত সড়কে এই অনুপস্থিত আইনি ভিত্তি থাকতেই পুলিশ সদস্যদের অজুহাতে অনেক সময় মানুষের মোবাইল দেখা বা নিবার্চক যোগাযোগের তথ্য খোঁজা হয়। অনেক সাধারণ মানুষ জানেন না যে প্রত্যেক নাগরিকের উপর অত্যধিক হস্তক্ষেপ করা ভুল এবং নজিরভূতভাবে আইনেরও উল্লচ্ছন।
সার্বিকভাবে বিচার করলে দেখা যায়, নাগরিক নিরাপত্তা ও গোপনীয়তার মধ্যে একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রাখা জরুরি। পুলিশ অবশ্যই আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করতে পারে, তবে তা আইন ও সংবিধানের বাধ্যতামূলক শর্তগুলো মেনে করতে হবে। মনে রাখতে হবে- নাগরিকদের মোবাইল ফোন, মেসেজ, ফটো বা যোগাযোগের তথ্য পুলিশ ইচ্ছে মতো দেখতে পারে না; এটি হচ্ছে ব্যক্তিগত মৌলিক অধিকার।
আইনি প্রতিকার কী?:
এ ধরনের অব্যাহত হয়রানি বা আইনবহির্ভূত মোবাইল তল্লাশির শিকার হলে নাগরিকদের জন্য কিছু কার্যকর আইনি পথ খোলা আছে-
থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের:
অভিযুক্ত পুলিশ সদস্য বা ইউনিটের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ জমা দিয়ে তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে আনতে পারেন।
আইনগত নোটিস বা মামলা:
মোবাইল তল্লাশি বা তথ্য হস্তক্ষেপ করে থাকলে সেই কর্মকাণ্ডকে যুক্তরাষ্ট্রিক অধিকার ও গোপনীয়তা হানির অভিযোগে আদালতে বহাল করতে পারেন।
সুপ্রীম কোর্টে মৌলিক অধিকার হেফাজতের পিটিশন:
যদি মনে হয় সংবিধানভিত্তিক মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে, তাহলে উচ্চ আদালতে মৌলিক অধিকার পিটিশন দায়ের করার সুযোগ আছে।
অধিকার সংস্থা ও মানবাধিকার সংগঠনের সহায়তা:
সাধারণ নাগরিকদের জন্য বিভিন্ন সংগঠন আইনি সহায়তা বা পরামর্শ দিতে প্রস্তুত থাকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সমাজে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে সেই দায়িত্ব পালন করার সময় নাগরিকের মৌলিক অধিকার, গোপনীয়তা ও স্বাধীনতা- এগুলি যেন ধুলোয় মাড়িয়ে ফেলা হয় না- এটা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আইনের শাসন মানে শুধু অপরাধীর খোঁজ নয়; তা হচ্ছে সবার জন্য সমানভাবে নিরাপদ এবং সম্মানজনক জীবনের ব্যবস্থা। আইনের ফাঁক বা অজুহাতের নামে কোনো হেনস্থা না হওয়া পর্যন্ত জনগণের ন্যায্য অধিকার রক্ষাই একটি গণতান্ত্রিক সমাজের প্রকৃত নিরাপত্তা।
বিকেপি/এমবি

