অসহায় বাবা-মা ও বৃদ্ধাশ্রম : আইনের চোখে সন্তানের দায়িত্ব
আইন ও আদালত ডেস্ক
প্রকাশ: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:৪৬
একটি সভ্য সমাজের নৈতিক মানদণ্ড বোঝা যায় সে সমাজ তার প্রবীণদের সঙ্গে কেমন আচরণ করে তা দিয়ে। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশেও একটি উদ্বেগজনক প্রবণতা দৃশ্যমান-
অসহায় বাবা-মাকে জোর করে বা অবহেলাজনিতভাবে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে যাওয়া। কেউ কেউ এটিকে আধুনিক জীবনের অনিবার্য বাস্তবতা হিসেবে ব্যাখ্যা করতে চান। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আইন কি একে সমর্থন করে? উত্তর স্পষ্ট “না ।
বাংলাদেশে বাবা-মার ভরণপোষণ কেবল সামাজিক বা নৈতিক দায়িত্ব নয়, এটি আইনগত বাধ্যবাধকতা। এ বিষয়ে প্রণীত হয়েছে “পিতা-মাতা ভরণপোষণ আইন, ২০১৩”। এই আইনের মূল উদ্দেশ্য হলো- সন্তান যেন কোনো অবস্থাতেই তাদের জন্মদাতা বাবা-মাকে অবহেলা করতে না পারে এবং তাদের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত থাকে।
আইনটি স্পষ্টভাবে বলছে, প্রত্যেক সন্তানের দায়িত্ব তার বাবা-মার ভরণপোষণ করা। শুধু অর্থনৈতিক সহায়তা নয়, বরং সম্মানের সঙ্গে তাদের নিজের বাসস্থানে রাখাও এর অন্তর্ভুক্ত। এই আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান হলো, সন্তানেরা বাবা-মাকে জোরপূর্বক বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতে বা সেখানে রেখে আসতে পারবে না। এমনকি বাবা-মা জীবিত থাকা অবস্থায় তাদের অমতে আলাদা কোথাও রাখা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।
আইনে আরও বলা হয়েছে, বাবা-মার সম্মতি ব্যতীত কোনো সন্তান যদি তাদের বৃদ্ধাশ্রমে পাঠায় বা সেখানে রেখে আসে, তাহলে সেটি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এ অপরাধের জন্য সন্তানের সর্বোচ্চ তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা কিংবা উভয় দণ্ড হতে পারে। অর্থাৎ এটি কোনো সামান্য সামাজিক ব্যত্যয় নয়; এটি সরাসরি ফৌজদারি অপরাধ।
এখানে একটি বিষয় পরিষ্কারভাবে বোঝা দরকার- আইন বৃদ্ধাশ্রমের অস্তিত্বকে পুরোপুরি অস্বীকার করে না। যদি বাবা-মা নিজেরাই স্বেচ্ছায়, পূর্ণ সম্মতিতে এবং বিশেষ প্রয়োজনের কারণে বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে চান, সে ক্ষেত্রে আইনি বাধা নেই। কিন্তু সন্তানের দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার হাতিয়ার হিসেবে বৃদ্ধাশ্রম ব্যবহার করার কোনো সুযোগ আইন দেয় না।
দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, অনেক ক্ষেত্রেই বাবা-মা প্রতিবাদ করার শক্তি বা মানসিক সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। সামাজিক লজ্জা, সন্তানের ভবিষ্যৎ নষ্ট হওয়ার ভয় কিংবা নিঃসঙ্গতার কারণে তারা নীরবে সব মেনে নেন। এই নীরবতাই অনেক সময় সন্তানদের অপরাধকে আড়াল করে দেয়। কিন্তু আইন নীরবতার সুযোগে অবহেলাকে বৈধতা দেয় না।
এ বিষয়টি কেবল আইন প্রয়োগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না।
এটি আমাদের সামাজিক মূল্যবোধের প্রশ্ন। যে বাবা-মা সন্তানকে মানুষ করেছেন, শিক্ষা দিয়েছেন, নিজের সুখ বিসর্জন দিয়ে ভবিষ্যৎ গড়েছেন-
তাদের শেষ জীবনে পরিত্যক্ত করে দেওয়া কোনো সভ্য সমাজে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
বিকেপি/এমবি

