গ্রাম্য সালিশ : আইনের নামে অবিচারের চর্চা
অ্যাড. শাহ আলম
প্রকাশ: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১:৩৪
দেশের গ্রামীণ সমাজে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ নিষ্পত্তির একটি প্রচলিত ব্যবস্থা হলো গ্রাম্য সালিশ।
পারিবারিক কলহ, জমি সংক্রান্ত বিরোধ কিংবা সামাজিক দ্বন্দ্ব মেটাতে এই সালিশ বহু ক্ষেত্রে দ্রুত ও কম খরচে সমাধান এনে দিয়েছে- এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, সাম্প্রতিক সময়ে সালিশের নামে সংঘটিত নানা অবিচার এই ব্যবস্থার নৈতিক ও আইনি বৈধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে।
আইনগতভাবে বাংলাদেশে “গ্রাম্য সালিশ” বলতে অনানুষ্ঠানিক সালিশ বোঝালেও, রাষ্ট্র স্বীকৃত ব্যবস্থা হলো গ্রাম আদালত, যা গ্রাম আদালত আইন অনুযায়ী ইউনিয়ন পরিষদের আওতায় পরিচালিত হয়। এর বাইরে ব্যক্তিগত বা সামাজিক সালিশ কোনোভাবেই আদালতের বিকল্প নয় এবং সেখানে কাউকে শাস্তি দেওয়া, জরিমানা আরোপ, সামাজিক বয়কট বা শারীরিক নিপীড়নের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আইনগত ক্ষমতা নেই।
অথচ বাস্তবে দেখা যায়, অনেক ক্ষেত্রে সালিশকারীরা নিজেদের আইন ও আদালতের ঊর্ধ্বে মনে করে নারীর ওপর ফতোয়ার নামে নির্যাতন, জোরপূর্বক তালাক, অর্থদণ্ড, এমনকি শারীরিক শাস্তির মতো নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিচ্ছেন। এসব কর্মকাণ্ড শুধু মানবাধিকারের লঙ্ঘন নয়, বরং সংবিধান ও প্রচলিত আইনের সরাসরি অবমাননা।
বিশেষভাবে উদ্বেগজনক হলো- এই অবিচারের শিকার অধিকাংশই নারী, দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী।
আইনের আশ্রয় নেওয়ার অজ্ঞতা, সামাজিক চাপ ও প্রভাবশালীদের ভয়ে তারা নীরবে এই অন্যায় মেনে নিতে বাধ্য হন। ফলে সালিশ নামের এই অনানুষ্ঠানিক ব্যবস্থা অনেক ক্ষেত্রে ন্যায়বিচারের বদলে ক্ষমতার অপব্যবহারের হাতিয়ারে পরিণত হচ্ছে।
এ অবস্থায় প্রয়োজন স্পষ্ট অবস্থান। রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে যে, গ্রাম আদালতের বাইরে কোনো সালিশ আইনবহির্ভূত শাস্তি দিতে পারবে না। একই সঙ্গে গ্রাম পর্যায়ে আইনি সচেতনতা বাড়াতে হবে, যাতে মানুষ জানে- ন্যায়বিচার পাওয়ার একমাত্র পথ আদালত ও আইনসম্মত প্রতিষ্ঠান।
গ্রাম্য সালিশ পুরোপুরি বাতিলের দাবি নয়; বরং এর সীমা নির্ধারণ জরুরি। সালিশ হতে পারে সমঝোতার মাধ্যম, কিন্তু বিচার নয়।
ন্যায়বিচার তখনই প্রতিষ্ঠিত হবে, যখন আইন থাকবে সর্বোচ্চ ক্ষমতার আসনে- কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ইচ্ছায় নয়।
লেখক : অ্যাড. শাহ আলম, ঢাকা জজ কোর্ট
বিকেপি/এমবি

