Logo

জাতীয়

সেমিনারে বক্তারা

অসাধু কসমেটিকস আমদানিকারকদের দৌরাত্ম্যে রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার

Icon

বাংলাদেশের প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ জুলাই ২০২৫, ১৯:৩৭

অসাধু কসমেটিকস আমদানিকারকদের দৌরাত্ম্যে রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার

অসাধু আমদানিকারকদের দৌরাত্ম্যে চরম হুমকির মুখে পড়েছে দেশীয় শিল্প। এই দৌরাত্ম্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার কসমেটিকস ও স্কিনকেয়ার খাত। এতে একদিকে যেমন বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার, অন্যদিকে জনস্বাস্থ্যও পড়ছে গুরুতর ঝুঁকিতে। মানসম্মত পণ্য নিশ্চিত করতে দেশীয় শিল্পের সুরক্ষায় কঠোর নজরদারি এবং এই অশুভ দাপট বন্ধ করা জরুরি।

বৃহস্পতিবার (৩ জুলাই) রাজধানীর কারওয়ান বাজারে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এক সেমিনারে এসব কথা বলেন বক্তারা। অ্যাসোসিয়েশন অব স্কিন কেয়ার বিউটি প্রোডাক্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অব বাংলাদেশ (এএসবিএমইবি) আয়োজিত সেমিনারের শিরোনাম ছিল— ‘কসমেটিকস ও স্কিনকেয়ার শিল্পখাতের রপ্তানি সম্ভাবনা : ভেজাল ও নিম্নমানের পণ্য আর নয়’।

সেমিনারের প্রধান অতিথি জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলিম আখতার খান হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ভোক্তার স্বার্থ রক্ষায় কোনোভাবেই পিছপা হবে না অধিদপ্তর। ভোক্তারা যেন প্রতারিত না হন, সে বিষয়ে সব পক্ষকে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে। ভেজাল ও নিম্নমানের পণ্যকে ‘বিষফোঁড়া’ আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, এই সমস্যা সমাধানে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। দেশের অর্থনীতির ভিত মজবুত করতে দেশেই উৎপাদিত মানসম্পন্ন পণ্যের ব্যবহার বাড়ানোর আহ্বান জানান তিনি।

এফবিসিসিআই’র সাবেক পরিচালক ইসহাকুল হোসেন সুইট বলেন, দেশীয় উৎপাদনে সক্ষমতা তৈরি হওয়া সত্ত্বেও যদি অসৎ উপায়ে আমদানি বন্ধ করা না যায়, তাহলে শিল্পায়ন, বিনিয়োগ সুরক্ষা, নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং দেশীয় উৎপাদনশীলতা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। এতে দেশ আমদানিনির্ভরতা থেকে মুক্তি না পেয়ে বরং অসাধু চক্রের কবলে পড়ে যেতে পারে। তিনি ব্যবসার পরিবেশ নিশ্চিত করতে নিয়ম-নীতি সহজ করার আহ্বান জানান।

ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম অব বাংলাদেশের (আইবিএফবি) সহ-সভাপতি এমএস সিদ্দিকী বলেন, দেশীয় শিল্প রক্ষায় এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকার যদি অসাধু আমদানিকারকদের নিয়ন্ত্রণ না করে, তাহলে দেশীয় শিল্প টিকে থাকবে না। এর ফলে লক্ষাধিক মানুষ বেকার হয়ে পড়বে, যা বড় ধরনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকট তৈরি করবে। দুষ্ট চক্রের প্রভাব দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না; বরং সরকারকে এর জন্য বড় মাশুল দিতে হবে।

এসএমই ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি আলি জামান বলেন, নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের কোনো কোনো মহলের ভূমিকা রহস্যজনক ও দেশীয় শিল্পবিরোধী। এর ফলে স্থানীয় বিনিয়োগ চরম অসম প্রতিযোগিতা ও ঝুঁকির মুখে পড়ছে। তার মতে, শিল্পায়নবিরোধী এ মনোভাব বর্তমান সরকারের কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের অগ্রাধিকার নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বর্তমানে দেশে কসমেটিকস শিল্পের প্রসার ঘটছে—এ প্রেক্ষাপটে আমদানির লাগাম টেনে ধরার এখনই সময়।

চিত্রনায়ক মামনুন হাসান ইমন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য তুলে ধরে বলেন, শুধুমাত্র কালার কসমেটিকস খাতে চলতি বছরে আমদানি হয়েছে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার। কিন্তু আন্ডার ইনভয়েসিং ও ওজনে কারচুপি না হলে প্রকৃত পরিমাণ দাঁড়ানোর কথা ছিল ন্যূনতম এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ, শুধু আমদানিতেই প্রায় ১১শ কোটি টাকার শুল্ক ও কর ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া অনেক আমদানিকারক নিয়মিত ভ্যাট পরিশোধ করছেন না। গত অর্থবছরে এই খাতের আমদানিতে সরকার ভ্যাট-ট্যাক্স পেয়েছে মাত্র ১৭ কোটি টাকা। বিপরীতে দেশীয় শিল্পের একটি প্রতিষ্ঠান একাই দিয়েছে ১০০ কোটির বেশি।

ভোক্তা অধিদপ্তরের পরিচালক ফকির মোহাম্মদ মুনাওয়ার হোসেন বলেন, দেশে কসমেটিকস ও স্কিনকেয়ার খাতের বাজার অনেক বড় হয়েছে। অভিযানের সময় দেখা যায়, বিশেষ করে আমদানিকৃত বিউটি ও স্কিনকেয়ার পণ্য নিয়ে আইন লঙ্ঘনের হিড়িক চলছে। অভিযোগেরও শেষ নেই।

ত্বক বিশেষজ্ঞ ডা. শারমিনা হক বলেন, বর্তমানে মানহীন ও ভেজাল কসমেটিকস পণ্যের ছড়াছড়ি চলছে। এসব পণ্য ব্যবহার করে ভোক্তারা প্রতারিত হচ্ছেন এবং মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন। তাই স্থানীয় উৎপাদনকে নীতিগত সহায়তা দিয়ে মানসম্পন্ন পণ্য সুলভমূল্যে বাজারজাত করা জরুরি। গ্লোবাল ব্র্যান্ডের উৎপাদন সম্প্রসারণে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানি সহজ করা এবং সরাসরি আমদানি করা কসমেটিকস পণ্যের শুল্কহার বাড়ানো উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন।

এএসবিএমইবি’র সাধারণ সম্পাদক জামাল উদ্দিন বলেন, কসমেটিকস খাতে বর্তমানে লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে। কিন্তু সরকারের নীতিগত সহায়তার অভাবে এই শিল্পের প্রসার আটকে আছে। দেশীয় শিল্প বিকাশের মাধ্যমে একদিকে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হয়, অন্যদিকে রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব। তাই স্থানীয় বিনিয়োগ সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার তালিকার শীর্ষে রাখতে হবে। একইসঙ্গে কসমেটিকস আমদানিকারকদের বিরুদ্ধে বিপুল শুল্ক, কর ও ভ্যাট ফাঁকির যে অভিযোগ উঠেছে, তা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মাধ্যমে তদন্তের দাবি জানান তিনি।

সেমিনারে বক্তারা আরও বলেন, রাতারাতি মোটা অঙ্কের অর্থ হাতাতে মিথ্যা ঘোষণা, আন্ডার ইনভয়েসিং, শুল্ক ফাঁকি ও বাজারে মেয়াদোত্তীর্ণ মানহীন পণ্য ছাড়ার মতো অপরাধ করছে এক শ্রেণির অসাধু আমদানিকারক। এনবিআরের নতুন শুল্ক নীতিকে প্রতিহত করতেই তারা মরিয়া হয়ে উঠেছে। এ চক্রের দৌরাত্ম্যই দেশীয় কসমেটিকস শিল্প বিকাশে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

আমদানি-রপ্তানি

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর