শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় নিয়ে যা বলছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো
ডিজিটাল ডেস্ক
প্রকাশ: ১৮ নভেম্বর ২০২৫, ১৩:১৩
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের অনুপস্থিতিতে বিচার এবং মৃত্যুদণ্ডের রায় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো।
পৃথক পৃথক বিবৃতিতে মানবাধিকার নিয়ে এমন উদ্বেগ প্রকাশ করেছে তারা।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দুইজনের অনুপস্থিতিতেই বিচার করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে এবং তাদের পছন্দের আইনজীবী দেওয়ার সুযোগ ছিল না যেটি গুরুতর মানবাধিকার উদ্বেগ তৈরি করেছে।
অন্যদিকে, জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয়, এ মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরোধিতা করেছে, কেননা দীর্ঘদিন ধরেই এই ধরনের সাজা বাতিলের আহ্বান জানিয়ে আসছে জাতিসংঘ।
একইসাথে তারা বাংলাদেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে।
তবে এ রায়কে ‘ভুক্তভোগীদের জন্য একটি মুহূর্ত’ বলে উল্লেখ করেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয়।
এছাড়া, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল দুই জনের অনুপস্থিতিতে বিচারের ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ গতি এবং রায় এ মামলার ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে ‘উল্লেখযোগ্য উদ্বেগ’ তৈরি করে বলে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
মৃত্যুদণ্ডের রায়ে সঠিক বিচার নিয়ে উদ্বেগ বাড়বে: হিউম্যান রাইটস ওয়াচ
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এ মামলায় অভিযুক্ত পুলিশের সাবেক প্রধান চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন প্রসিকিউশনের সাক্ষী হওয়ায় তাকে ন্যুনতম পাঁচ বছরের সাজা দেওয়া হয়েছে।
সংস্থাটির ডেপুটি এশিয়া ডিরেক্টর মিনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, ‘হাসিনার দমন-পীড়নমূলক শাসনামলের ওপরে বাংলাদেশের মানুষের দীর্ঘদিন ধরেই ক্ষোভ-হতাশা রয়েছে, কিন্তু এরপরও সকল ফৌজদারি কার্যক্রমে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের সব মানদণ্ড পূরণ করতে হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘নিরপেক্ষ তদন্ত এবং বিশ্বাসযোগ্য বিচারের মাধ্যমে হাসিনার প্রশাসনের অধীনে ভয়াবহ নির্যাতনের জন্য দায়ীদের জবাবদিহি করা উচিত।’
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এ বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার প্রশাসনের নির্যাতনের জন্য দায়ীদের যথাযথভাবে জবাবদিহি করা উচিত, কিন্তু প্রসিকিউশন আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের মানদণ্ড পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
যার মধ্যে রয়েছে আত্মপক্ষ সমর্থন, সাক্ষীদের বিরুদ্ধে জিজ্ঞাসাবাদের পূর্ণাঙ্গ সুযোগ এবং নিজের পছন্দমতো আইনজীবী নিয়োগ।
এ মৃত্যুদণ্ডের রায়ের ফলে সঠিক বিচার নিয়ে উদ্বেগ আরো অনেক বেড়ে যাবে বলে মনে করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হাসিনা সরকারের গুরুতর অধিকার লঙ্ঘনের জন্য ন্যায়বিচার এবং জবাবদিহিতার প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তবে হাসিনা সরকারের অধীনেও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা দায়েরের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। যেখানে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্বিচারে গ্রেফতার ও আটক, অন্যায়ভাবে বিচার করা এবং কিছু ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।
এইচআরডব্লিউ বলছে, জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার কার্যালয় এবং বাংলাদেশ সরকার ২০২৫ সালের জুলাই মাসে ‘মানবাধিকারের প্রচার ও সুরক্ষায় সহায়তা করার লক্ষ্যে’ দেশে একটি মিশন খোলার জন্য তিন বছরের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যারা ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তাদেরও ন্যায়বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা চাওয়া উচিত। এই ধরনের সহায়তার জন্য মৃত্যুদণ্ডের ওপর স্থগিতাদেশ প্রয়োজন, বলেছে সংস্থাটি।
বাংলাদেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দিয়েছে জাতিসংঘ
এদিকে মৃত্যুদণ্ডের এই রায়ের বিরোধিতা করলেও বাংলাদেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দিয়েছে জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস অফিস (ওএইচসিএইচআর)।
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় জাতিসংঘের এ সংস্থা যেকোনো পরিস্থিতিতে মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা করেছে।
সংস্থাটি বলছে, গত বছরের জুলাইয়ে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যে ছাত্র আন্দোলন হয় তাতে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী সহিংসভাবে দমন করে। এক পর্যায়ে পদত্যাগের পর শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান।
জাতিসংঘের নেতৃত্বে পরিচালিত এক তদন্তে দেখা গেছে, গত বছরের জুলাই- অগাস্টে এক হাজার ৪০০ জন নিহত হয়েছে যাদের মধ্যে অনেক শিশুও ছিল। আহত হয়েছেন হাজার হাজার।
জাতিসংঘের এ মানবাধিকার কার্যালয় এ রায়কে ‘ভুক্তভোগীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত’ বলে উল্লেখ করেছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় বিবৃতিতে আরো বলেছে, জাতিসংঘ ধারাবাহিকভাবে এমন কার্যক্রমের আহ্বান জানিয়ে আসছে যা ‘নিঃসন্দেহে’ যথাযথ প্রক্রিয়া এবং ন্যায়বিচারের সকল আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পূরণ করে।
দীর্ঘদিন ধরেই মৃত্যুদণ্ডের বিধান বাতিলের দাবিতে জাতিসংঘে একাধিক প্রস্তাব পাস করা হয়েছে।
বিবৃতিতে জাতিসংঘের এ মানবাধিকার কার্যালয় বলছে, মিজ হাসিনা এবং মি. খানের অনুপস্থিতিতে বিচার হয়েছে এবং মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়া হয়েছে, যেটি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডকে ‘বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ’ করে তুলেছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ভলকার টুর্ক আশা প্রকাশ করেছেন, বাংলাদেশ এখন ‘জাতীয় সংহতি ও উত্তরণের পথ হিসেবে সত্য-প্রকাশ, ক্ষতিপূরণ এবং ন্যায়বিচারের’ একটি ব্যাপক প্রক্রিয়া নিয়ে এগিয়ে যাবে।
এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সবাইকে শান্ত থাকা এবং সংযম প্রদশর্নের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
মৃত্যুদণ্ডের রায় মানবাধিকার লঙ্ঘন: অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল
এদিকে, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মৃত্যুদণ্ডকে অমানবিক সাজা, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং কোনো বিচারিক প্রক্রিয়ায় এর স্থান নেই বলে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
এক বিবৃতিতে সংগঠনটির মহাসচিব অ্যাগনেস ক্যালামাহ বলেছেন, ‘২০২৪ সালের জুলাই- অগাস্টে ছাত্রদের নেতৃত্বে আন্দোলনের সময় সংঘটিত সহিংসতা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য যারা ব্যক্তিগতভাবে দায়ী তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত এবং সঠিক বিচারের মাধ্যমে তাদের বিচার করা উচিত। তবে এ বিচার ও সাজা নিরপেক্ষ বা ন্যায়সঙ্গত কোনোটাই নয়। ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার এবং জবাবদিহিতা প্রয়োজন, কিন্তু মৃত্যুদণ্ড মানবাধিকার লঙ্ঘনকে আরো জটিল করে তোলে। এটি চূড়ান্ত নিষ্ঠুর, অবমাননাকর এবং অমানবিক শাস্তি এবং কোনো বিচার প্রক্রিয়ায় এর স্থান নেই।’
সংস্থাটি বলছে, ২০২৪ সালের জুলাই থেকে অগাস্টের মধ্যে এক হাজার ৪০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত এবং হাজার হাজার আহত হয়েছে। বেঁচে যাওয়া এবং ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের মান পূরণকারী, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার পরিচালনা করা প্রয়োজন।
‘কিন্তু এর পরিবর্তে, এই বিচার এমন একটি আদালতের সামনে পরিচালিত হয়েছে যার স্বাধীনতার অভাব এবং অন্যায্য বিচারের ইতিহাসের জন্য অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল দীর্ঘদিন ধরে সমালোচনা করে আসছে।’
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তাদের বিবৃতিতে আরো বলেছে, আসামিদের অনুপস্থিতিতে বিচারের অনাকাঙ্ক্ষিত গতি এবং রায় এই জটিল মামলার ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উদ্বেগ তৈরি করে। যদিও শেখ হাসিনার পক্ষে আদালত আইনজীবী নিয়োগ দিয়েছিলেন তবুও তার প্রতিরক্ষামূলক প্রস্তুতির জন্য সময় অপর্যাপ্ত ছিল।
পরস্পরবিরোধী সাক্ষ্যপ্রমাণের ওপর আসামিপক্ষকে জেরা করার অনুমতি দেওয়া হয়নি এমন প্রতিবেদনগুলো এই ধরনের অন্যায্য বিচারের সূচক বা লক্ষণগুলোকে আরো বৃদ্ধি করে বলে মনে করে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
‘এটি কোনো সুষ্ঠু বিচার ছিল না। ২০২৪ সালের জুলাইয়ের ভুক্তভোগীরা আরও ভালো কিছু পাওয়ার যোগ্য। বাংলাদেশের এমন একটি ন্যায়বিচার প্রক্রিয়া প্রয়োজন যা পক্ষপাতের সন্দেহের বাইরে, সম্পূর্ণরূপে ন্যায্য ও নিরপেক্ষ হবে এবং মৃত্যুদণ্ডের মাধ্যমে আরও মানবাধিকার লঙ্ঘনের আদেশ দেবে না। তবেই প্রকৃত এবং অর্থপূর্ণ সত্য, ন্যায়বিচার এবং ক্ষতিপূরণ প্রদান করা সম্ভব হবে,’ বলা হয়েছে বিবৃতিতে।
এমবি

