Logo

জাতীয়

দেশে ক্রিপ্টোকারেন্সির ভয়ঙ্কর নেটওয়ার্ক

Icon

মাসুম আহম্মেদ

প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:২৫

দেশে ক্রিপ্টোকারেন্সির ভয়ঙ্কর নেটওয়ার্ক

দেশে নিয়ন্ত্রিত কাঠামো ছাড়া দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে ক্রিপ্টোকারেন্সি। বিশেষ করে বিটকয়েনভিত্তিক নেটওয়ার্ক। অনলাইনে বিজ্ঞাপন, উচ্চ মুনাফার প্রতিশ্রুতি এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমভিত্তিক লেনদেনের প্রবণতার কারণে অনেক তরুণ-তরুণী এই ব্যবসার দিকে ঝুঁকছেন। তবে আইনগত অস্পষ্টতা, অননুমোদিত লেনদেন, আর্থিক প্রতারণা এবং সাইবার বুলিংয়ের ঝুঁকি আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৭ সাল থেকেই স্পষ্টভাবে ঘোষণা করে আসছে যে, বিটকয়েন বা যেকোনো ধরনের ক্রিপ্টোকারেন্সি দেশে বৈধ মুদ্রা নয়, এর লেনদেন বা প্রচারও আইনত নিষিদ্ধ। পরবর্তীতে ২০২১ সালে আরেকটি নির্দেশনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার, লেনদেন, মাইনিং, ট্রেডিং বা এ-সংক্রান্ত প্রচার মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, বিদেশি মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন এবং সন্ত্রাস অর্থায়ন প্রতিরোধ আইনের আওতায় অপরাধ হিসেবে বিবেচ্য হতে পারে। এ অবস্থার কারণে দেশে এখনো কোনো অনুমোদিত ক্রিপ্টো এক্সচেঞ্জ, ট্রেডিং প্ল্যাটফর্ম বা সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠান অনুমোদন পায়নি।

অবৈধ নেটওয়ার্কে তরুণ সমাজ, অনেকে হারাচ্ছেন সর্বস্ব : অননুমোদিত ফেসবুক গ্রুপ, টেলিগ্রাম চ্যানেল, ব্যক্তিগত ইনবক্সে ‘পিয়ার-টু-পিয়ার লেনদেন- এসবের মাধ্যমে তরুণরা উচ্চ লাভের প্রলোভনে ক্রিপ্টোতে বিনিয়োগ করছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে গতকাল ধানমন্ডির একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন ছাত্রছাত্রী বাংলাদেশের খবরকে জানান, প্রথমে উচ্চ মুনাফা দেখানো হয়, পরে হুট করে অ্যাকাউন্ট ব্লক করে দেয়। সিগন্যাল গ্রুপ বা ‘নেটওয়ার্ক মার্কেটিং’-এর নামে পনজি মডেলে টাকা তোলা হয়। প্রতারণার শিকার হয়ে কেউ কেউ সর্বস্ব হারাচ্ছেন।

আকর্ষণের আড়ালে লুকানো ঝুঁকি : ডিজিটাল অর্থনীতির বিস্তার যত বাড়ছে, ততই নতুন নতুন বিনিয়োগমুখী ব্যবসার নাম সামনে আসছে। এর মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে আলোচনায় এসেছে তথাকথিত ‘কারেন্সি নেটওয়ার্ক ব্যবসা’। কেউ বলছেন এটি ভবিষ্যতের আয়ের সুযোগ, আবার অনেক বিশেষজ্ঞ একে দেখছেন প্রতারণার নতুন রূপ হিসেবে। ফলে এই ব্যবসা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যেও তৈরি হয়েছে বিভ্রান্তি।

কারেন্সি নেটওয়ার্ক নামটি ব্যবহার করে কেউ কেউ ডিজিটাল কারেন্সি ট্রেডিংয়ের কথা বলেন, আবার কেউ নেটওয়ার্ক মার্কেটিং বা এমএলএম পদ্ধতিতে নতুন সদস্য সংগ্রহের মাধ্যমে আয়ের সুযোগ দেখান।

অনলাইন প্ল্যাটফর্ম বা অ্যাপে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জমা রেখে আয় হবে- এমন প্রতিশ্রুতিই এখানে সাধারণ। কিছু কোম্পানি দেশে ক্রিপ্টোকারেন্সির আবার সদস্য সংগ্রহের বিনিময়ে বোনাস দেওয়ার দাবি করে।

এই কেউ আবার সম্ভাবনাও দেখছেন। ডিজিটাল কারেন্সির বিশ্ববাজার দিন দিন বড় হচ্ছে। প্রযুক্তির এই নতুন ধারা ভবিষ্যতে আরও প্রসারিত হবে- এমনটাই ধারণা বিশেষজ্ঞদের। অল্প পুঁজিতে ট্রেডিং শেখা যায় এবং সঠিক সময় সঠিক সিদ্ধান্ত হলে লাভও পাওয়া সম্ভব। তরুণদের মধ্যে তাই এই ক্ষেত্রের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে।

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, কারেন্সি নেটওয়ার্ক ব্যবসার বেশিরভাগ ক্ষেত্রই নিয়ন্ত্রণহীন। অনেক প্ল্যাটফর্ম আইনগতভাবে নিবন্ধিত নয়, আবার কেউ কেউ ‘নির্দিষ্ট লাভের নিশ্চয়তা’ দিয়ে সরাসরি মানুষের আবেগকে টার্গেট করছে। ব্লকচেইন-ভিত্তিক বিনিয়োগে এ ধরনের নিশ্চয়তা দেওয়া অসম্ভব- এ কথা বিশেষজ্ঞরা বহুবার সতর্ক করেছেন।

দামের অস্থিরতা এই বাজারের অন্যতম বড় ঝুঁকি। এক দিনে ২০-৩০ শতাংশ দর ওঠানামা হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তাছাড়া নেটওয়ার্কভিত্তিক কারেন্সির নামে যে সব কোম্পানি চলছে, সেগুলোর অনেকে পনজি বা চেইন সিস্টেমে পরিচালিত এক সময় ভেঙে পড়লে ক্ষতির বোঝা পড়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীর ওপরই।

অর্থ বিশেষজ্ঞদের মতে, কারেন্সি নেটওয়ার্ক ব্যবসায় বিনিয়োগের আগে যে বিষয়গুলো অবশ্যই বিবেচনা করা উচিত- কোনো প্ল্যাটফর্ম ‘নির্দিষ্ট আয়’ বা ‘গ্যারান্টি’ দিলে সন্দেহ করুন।

কারো কথায় বা ফাঁকা প্রতিশ্রুতিতে টাকা দিবেন না। প্ল্যাটফর্মটি আইনগতভাবে বৈধ কি না-যাচাই করুন। নিজের সামর্থের বেশি বিনিয়োগ করবেন না। নেটওয়ার্ক বা রেফারেল-ভিত্তিক স্কিমে বিশেষ সতর্ক থাকুন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা আদালতের আইনজীবী কেএম খাইরুল আলম এবং একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ বাংলাদেশের খবরকে মুঠোফোনে বলেন, ‘ডিজিটাল অর্থনীতি নিঃসন্দেহে ভবিষ্যতের পথ। তবে নতুন পথ মানেই নতুন ঝুঁকি। কারেন্সি নেটওয়ার্ক ব্যবসা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। লাভের লোভে অনেকেই ঝুঁকি ভুলে যান, আর সেখানেই ঘটে বড় ক্ষতি। তাই অন্ধভাবে দৌড় না দিয়ে, তথ্য-প্রমাণ যাচাই করে, নিজের বোঝাপড়া তৈরি করে তবেই এ ধরনের ব্যবসায় যুক্ত হওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।’

আন্তর্জাতিক গবেষণায়ও দেখা গেছে, অনিয়ন্ত্রিত বা ছদ্মনামভিত্তিক লেনদেনে ফিশিং, ভুয়া ওয়ালেট, পনজি স্কিম ও প্রতারণার হার অত্যন্ত বেশি। বিশেষ করে যেসব দেশে সরকারি নিয়ন্ত্রণ নেই, সেখানে স্ক্যামাররা আরও সক্রিয়।

সাইবার বুলিংয়ে সামাজিক ক্ষতি বাড়ছে : অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি মানসিক ও সামাজিক ক্ষতিও বাড়ছে। একাধিক ব্যবহারকারী জানাচ্ছেন ক্রিপ্টো নেটওয়ার্কে যুক্ত হওয়ার পর লেনদেন ব্যর্থ হলে বা প্রতারণার প্রমাণ চাইলে তাদের হুমকি, অপমান, মানহানি, এমনকি সাইবার বুলিংয়ের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

বাংলাদেশ খবরের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, যদিও নামিদামি ব্যবসায়ী বা রাজনৈতিক ব্যক্তি জড়িত থাকার নির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি, তবে ক্ষতিগ্রস্তরা দাবি করেন, বড় নেটওয়ার্কগুলোতে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের উল্লেখ করে চাপ সৃষ্টি করা হয় অথবা সামাজিক বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করা হয়।

বিশ্বের অনেক দেশে ক্রিপ্টোকারেন্সিকে নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, সিঙ্গাপুরসহ বহু দেশ এক্সচেঞ্জ লাইসেন্সিং বাধ্যতামূলক করেছে।

আন্তর্জাতিক এক গবেষণা বলছে, অনিয়ন্ত্রিত বাজারে পনজি স্কিম, ফিশিং ওয়েবসাইট ও প্রতারণা সবচেয়ে বেশি ঘটে; কিন্তু ভালোভাবে নিয়ন্ত্রিত দেশে ক্ষতির হার তুলনামূলক কম। বাংলাদেশ এখনো এমন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি, ফলে বাজার সম্পূর্ণভাবে ‘গ্রে-জোনে’ অবস্থান করছে।

আইনগত ঝুঁকি- শাস্তির মুখে পড়তে পারেন ব্যবহারকারীরা : বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, অননুমোদিতভাবে ক্রিপ্টো লেনদেন করলে যেসব আইনের আওতায় শাস্তি হতে পারে তা হলো- ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন অ্যাক্ট-১৯৪৭, মানি লন্ডারিং প্রিভেনশন অ্যাক্ট-২০১২, অ্যান্টি-টেরোরিস্ট অ্যাক্ট-২০০৯, আইসিটি অ্যাক্টের বিভিন্ন ধারা (প্রতারণা, সাইবার অপরাধ, অননুমোদিত লেনদেন)। এ কারণে, কেউ প্রতারিত হলে আইনগত প্রতিকার পাওয়াও অত্যন্ত কঠিন।

কেন বাড়ছে ঝুঁকি : ঝুঁকি বাড়ছে বিভিন্ন কারণে যেমন- ক্রিপ্টোকারেন্সির বিষয়ে কোনো সরকারিভাবে অনুমোদিত এক্সচেঞ্জ নেই। ব্যবহারকারীদের অল্প জ্ঞান, প্রলোভন ও লোভনীয় প্রচার, সোশ্যাল মিডিয়াভিত্তিক ছদ্মনামযুক্ত লেনদেন, পনজি ও প্রতারণামূলক স্কিম ছড়ানোর সুবিধা, আইন প্রয়োগ ও ট্রেসিং জটিল বলে অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। এছাড়া রয়েছে বাংলাদেশের তরুণদের আর্থিক ঝুঁকি সম্পর্কে অপর্যাপ্ত সচেতনতা।

অবশ্য এসব নিয়ে কাজ করেন এরকম বেশ কয়েকজন বাংলাদেশের খবরের প্রশ্নের জবাবে এই প্রতিবেদককে জানান, বাংলাদেশ চাইলেই আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার আলোকে ৩টি পদক্ষেপ নিতে পারে। স্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন, নিয়ন্ত্রিত এক্সচেঞ্জ অনুমোদন করা, কেওয়াইসি-এএমএল বাধ্যতামূলক করা, এবং নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য আরোপ করা। এছাড়া অননুমোদিত নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ। সাইবার অপরাধ ইউনিট ও আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয় নিশ্চিত করা।

জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে করা যেতে পারে তরুণদের বিনিয়োগ-শিক্ষা, প্রতারণা শনাক্তকরণ প্রশিক্ষণ, ও ডিজিটাল নিরাপত্তা প্রচার করা।

বাংলাদেশে ক্রিপ্টোকারেন্সির অননুমোদিত ব্যবসা দ্রুত বাড়ছে এবং এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে প্রতারণা, আর্থিক ক্ষতি, সাইবার বুলিং ও মানসিক সংকট।

আইনগতভাবে নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও একশ্রেণির তরুণ সমাজ ও সাধারণ মানুষ এই নেটওয়ার্কে যুক্ত হচ্ছেন- যা ভবিষ্যতে আরও বড় আর্থ-সামাজিক ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন আইন প্রয়োগ, নিয়ন্ত্রণ, জনসচেতনতা ও ডিজিটাল শিক্ষাই এখন একমাত্র সমাধান।

আইএইচ/ 

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

বাংলাদেশ ব্যাংক

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর